চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত টার্মিনাল বিদেশি নিয়ন্ত্রণে: জাতীয় স্বার্থ, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে বড় প্রশ্ন – ইউ এস বাংলা নিউজ




ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আপডেটঃ ১ ডিসেম্বর, ২০২৫
     ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত টার্মিনাল বিদেশি নিয়ন্ত্রণে: জাতীয় স্বার্থ, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে বড় প্রশ্ন

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৯:৪৭ 15 ভিউ
বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ—লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল—দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতি, রপ্তানি খাত, কর্মসংস্থান ও জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গত ১৭ নভেম্বর সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে আগামী ৩০ বছরের জন্য (পরবর্তীতে ৪৫ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করার সুযোগ থাকছে) টার্মিনালটির পূর্ণ পরিচালনা ও বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস-কে, যা বৈশ্বিক শিপিং জায়ান্ট মায়ার্স্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালিত হয়। এই বন্দরের একটি প্রধান টার্মিনালের দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে যাওয়াকে অনেক অর্থনীতিবিদ ও কৌশলগত বিশ্লেষক “জাতীয়

অবকাঠামোর আংশিক বিদেশিকরণ” হিসেবে দেখছেন। ⸻ লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? • চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যস্ততম এলাকার একটি এই টার্মিনাল। • বছরে কয়েক লক্ষ টিইইউ (TEU) কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা। • রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের একটি বড় অংশ এই টার্মিনাল নির্ভর। • দ্রুত কনটেইনার খালাস না হলে সরাসরি রপ্তানিতে জট, ডেমারেজ চার্জ ও বৈদেশিক ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। ⸻ চুক্তির মূল কাঠামো (প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী) • মেয়াদ: প্রাথমিকভাবে ৩০ বছর, পরে সর্বোচ্চ ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ। • বিনিয়োগ: টার্মিনাল আধুনিকায়নের নামে বিদেশি বিনিয়োগ। • পরিচালনা ও প্রযুক্তি: সম্পূর্ণ অপারেশন ও প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত এপিএম টার্মিনালসের হাতে। • রাজস্ব ভাগাভাগি: সরকার পাবে আনুমানিক ১৮–২২ শতাংশ, বাকি ৭০–৮০ শতাংশ মুনাফা বিদেশে

চলে যাবে। • যন্ত্রপাতির মালিকানা: অধিকাংশ ভারী সরঞ্জাম ও অটোমেশন সিস্টেম থাকবে এপিএম-এর মালিকানায়। ⸻ এপিএম টার্মিনালস : আন্তর্জাতিক বিতর্কের ইতিহাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এপিএম টার্মিনালস ও এর মূল কোম্পানি মায়ার্স্ক গ্রুপ অতীতে দুর্নীতি, অবৈধ লবিং ও অনিয়মের অভিযোগে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে। ১. গুয়াতেমালা বন্দর কেলেঙ্কারি ২০১৬ সালে গুয়াতেমালার সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে—স্পেনের কোম্পানি টিসিবি প্রায় ২৪.৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়ে পুয়ের্তো কুয়েটজাল বন্দরের কনসেশন নেয়। পরের বছরই মায়ার্স্ক গ্রুপ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে টিসিবি কিনে নেয়। পরবর্তীতে দুর্নীতির মামলা ও তদন্তে এপিএম টার্মিনালসকে দশ মিলিয়ন ডলারের বেশি জরিমানা দিতে হয়। ২. ব্রাজিলের ‘কার ওয়াশ’ তদন্ত ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চলা ব্রাজিলের

ঐতিহাসিক দুর্নীতি তদন্তে অভিযোগ ওঠে, মায়ার্স্ক সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি পেট্রোব্রাসের কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও সুবিধাজনক চুক্তি আদায় করেছিলেন। তদন্তের এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির কিছু সম্পদ জব্দ ও ফ্রিজ করা হয়। ৩. আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল নাইজেরিয়া, ঘানা ও ডোমিনিকান রিপাবলিকে বন্দর কনসেশন সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বচ্ছতার অভাব, ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগে এপিএম টার্মিনালস বিভিন্ন সময় সমালোচনার মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটিকে “উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ⸻ বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব ১. কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জের বড় ধাক্কা বর্তমানে ২০ ফুট কনটেইনারে গড় খরচ: • বর্তমান: ৬৫০–৭০০ ডলার • সম্ভাব্য নতুন হার: ১১০০–১২০০ ডলার অর্থাৎ ৪৫–৬০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি। ২. পোশাক

রপ্তানিতে বছরে ২০০০ কোটি টাকার বাড়তি চাপ তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশের বেশি যোগান দেয়। এই খাতে অতিরিক্ত লজিস্টিক খরচ যোগ হলে বছরে আনুমানিক ১৮০০–২০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হবে। এতে রপ্তানি পণ্যের ইউনিট মূল্য বেড়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হবে। ৩. বিদেশে অর্ডার সরে যাওয়ার ঝুঁকি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ— • ভিয়েতনাম • কম্বোডিয়া • শ্রীলঙ্কা এই দেশগুলোতে বন্দরের খরচ তুলনামূলক কম ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা দ্রুত। খরচ বেড়ে গেলে আন্তর্জাতিক বায়াররা ধীরে ধীরে ওই দেশগুলোতে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। ⸻ কর্মসংস্থান ও অটোমেশন সংকট এপিএম টার্মিনালস আধুনিক অটোমেশনভিত্তিক বন্দর পরিচালনায় অভ্যস্ত। প্রতিষ্ঠানটি নিজেই জানিয়েছে— • প্রায় ৭০

শতাংশ অপারেশন অটোমেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। • ফলে সরাসরি কাজ হারাতে পারেন ৮ থেকে ১০ হাজার স্থানীয় শ্রমিক ও কর্মচারী। • অনেক দক্ষ বন্দরকর্মীও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন সুস্পষ্ট রোডম্যাপ এখনো প্রকাশ করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা বহিঃপ্রবাহ বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে— • এই টার্মিনাল থেকে যে বিপুল অঙ্কের অপারেশনাল মুনাফা হবে, তার ৭০–৮০ শতাংশ ডলারে বিদেশে চলে যাবে। • এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় সীমিত থাকবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। ⸻ ৪৫ বছর পর কী পাবে বাংলাদেশ? চুক্তি অনুযায়ী, • ভারী যন্ত্রপাতি ও অটোমেশন সিস্টেম থাকবে এপিএম-এর মালিকানায়। • মেয়াদ শেষে সরকার পাবে মূল অবকাঠামো—জেটি, ভবন ও পুরনো

কংক্রিট কাঠামো। • প্রযুক্তিগতভাবে তখন এসব অবকাঠামো অনেকটাই অপ্রচলিত হয়ে পড়তে পারে। অনেকে এটিকে “লং টার্ম লিজের নামে জাতীয় সম্পদের ব্যবহারিক বিক্রি” বলে আখ্যা দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের আপত্তি ও প্রশ্ন অর্থনীতিবিদ ও অবকাঠামো বিশ্লেষকদের প্রশ্ন— ১. কৌশলগত অবকাঠামো কেন দীর্ঘমেয়াদে বিদেশির হাতে? ২. দেশীয় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বিকল্প সমাধান কি সম্ভব ছিল না ? ৩. ⁠কর্মসংস্থান সুরক্ষায় পরিষ্কার গ্যারান্টি কোথায়? ৪. লাভের সিংহভাগ বিদেশে যাওয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব কি সরকার যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেছে? একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর কেবল ব্যবসায়িক স্থাপনা নয়—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য আমদানি, শিল্প কাঁচামাল ও রপ্তানির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শুধু বিনিয়োগ নয়, কৌশলগত স্বার্থকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি ছিল।” ⸻ রপ্তানিকারক ও শিল্পমালিকদের প্রতিক্রিয়া একজন শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, “আমরা এখনই আন্তর্জাতিক বাজারে দামের চাপের মধ্যে আছি। বন্দরের খরচ দ্বিগুণের কাছাকাছি হলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকবে কীভাবে?” চেম্বার নেতারা বলছেন, খরচ বাড়লে ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ⸻ শ্রমিকদের উদ্বেগ বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, “আমরা চাকরি হারালে আমাদের বিকল্প কী? অটোমেশনের নামে হাজার হাজার পরিবারকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।” লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সরকার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে দেখালেও, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের বড় একটি অংশ এটিকে জাতীয় স্বার্থ, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। চুক্তির শর্তাবলি, রাজস্ব ভাগাভাগি, কর্মসংস্থান সুরক্ষা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছতা ও পুনর্মূল্যায়নের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
নোবেলের আড়ালে শ্রমিক শোষণ: জনসেবার নামে লুটপাট করে ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য গড়ার অভিযোগ ইউনূসের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত টার্মিনাল বিদেশি নিয়ন্ত্রণে: জাতীয় স্বার্থ, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে বড় প্রশ্ন ‘দেশমাতা’র মুখোশ বনাম দেশবিরোধিতার দালিলিক প্রমাণ: একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ দিনাজপুরের হাকিমপুরে আ.লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি সদস্যকে চোখ উপড়ে নির্মমভাবে হত্যা ‘আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল হয়েছে, তবে একপাক্ষিক ক্ষমা কেন চাইবে’: বিবিসিকে সজীব ওয়াজেদ জয় ‘ভারতকে যা দিয়েছি, তা তারা সারাজীবন মনে রাখবে’—প্রতিদানের প্রশ্নে শেখ হাসিনার সেই দ্ব্যর্থহীন বার্তা কি বলেছিল? ফেসবুকে ভাইরাল গুলি ছোড়া যুবক জামায়াতের কর্মী : পুলিশ পে স্কেলের বিষয়ে কমিশনের সবশেষ পদক্ষেপ ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল দুই বগির মাঝখানে ঝুলে ছিল শিশু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ইমরান খানের বেঁচে থাকার তথ্য দিলেন পিটিআই নেতা, দেশ ছাড়তে চাপ নভেম্বরে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি ৮ ব্যাংকে বিপিএলের নিলামে অংশ নিতে পারবেন না ৯ ক্রিকেটার সৌদিতে ব্যাপক ধরপাকড়, ২১ হাজার প্রবাসী গ্রেপ্তার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উত্তাল ইউরোপ, দেশে দেশে বিক্ষোভ প্রথম সারির নায়িকারাও আমার থেকে কম টাকা কামায় : সোফী নিলাম শেষে দেখে নিন বিপিএলের ৬ দলের পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড ঐশ্বরিয়াকে বিয়ে করতে চান পাকিস্তানি মুফতি ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৬৩৬