ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, সেই পুরনো স্ক্রিপ্ট
চিফ প্রসিকিউটরের হুমকি: ন্যায়বিচারের সামনে ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা
বাংলার রাজনৈতিক আকাশে মুজিব তনয়া এখনো সমান অপরিহার্য
বাউল-পালাকার-বয়াতিরা কাদের শত্রু
ক্যাঙারু কোর্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশে পুরো বিশ্বে উঠেছে নিন্দার ঝড়
বাংলাদেশের এলজিবিটি কমিউনিটিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র: পর্ব-৩
ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সেনা মোতায়েন চেয়ে সেনাসদরে সুপ্রিম কোর্টের চিঠি, আইনি এখতিয়ার বহির্ভূত
‘দেশমাতা’র মুখোশ বনাম দেশবিরোধিতার দালিলিক প্রমাণ: একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ
রাজনীতি একটি ক্ষমতার খেলা, কিন্তু দেশপ্রেম সেই খেলার ঊর্ধ্বে থাকা এক পবিত্র দায়বদ্ধতা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার এবং রাষ্ট্র—এই দুটি ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারের বিরোধিতা করা, সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া এবং রাজপথে আন্দোলন করা বিরোধী দলের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু যখন ক্ষমতার মোহ বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে আঘাতটা সরকারের বদলে রাষ্ট্রের গায়ে লাগে, তখন সেই রাজনীতি আর ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র পর্যায়ে থাকে না; তা হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা দেশবিরোধিতা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর অনুসারীরা ‘দেশমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করে থাকেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু দালিলিক প্রমাণ রয়েছে, যা এই আবেগঘন উপাধিটিকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। এর
মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সুনির্দিষ্ট দলিলটি হলো ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এ বেগম খালেদা জিয়ার নামে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয় (Op-ed), যার শিরোনাম ছিল— ‘The Thankless Role in Saving Democracy in Bangladesh’। এই নিবন্ধটি কেবল একটি রাজনৈতিক কলাম ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনার এক লিখিত দলিল। আজকের এই বিশ্লেষণে আমরা আবেগ সরিয়ে সরাসরি সেই নিবন্ধের বিষয়বস্তু এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। দেখব, যিনি নিজ দেশের স্বার্থ বিদেশিদের পায়ে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, তিনি কি আদৌ ‘দেশমাতা’ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? ১. জিএসপি সুবিধা নিয়ে চক্রান্ত: অর্থনীতির মেরুদণ্ডে কুঠারাঘাত ২০১৩ সাল
ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। রানা প্লাজা ধসের পূর্ববর্তী সেই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে লড়াই করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এ প্রকাশিত নিবন্ধে বেগম খালেদা জিয়া লিখেছিলেন: "The U.S. government should indicate that GSP benefits... are not a permanent right." (অর্থাৎ: যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত হাসিনাকে বোঝানো যে, জিএসপি সুবিধা কোনো স্থায়ী অধিকার নয়।) বিশ্লেষণ: জিএসপি (Generalized System of Preferences) সুবিধা কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো সরকারের সম্পত্তি নয়। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কের বাণিজ্য সুবিধা। এই সুবিধা সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে
যে ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই নারী—এই সুবিধা তাঁদের রুটি-রুজি নিশ্চিত করে। যখন একটি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বিদেশের মাটিতে বসে নিজ দেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের ইঙ্গিত দেন বা পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়ার আহ্বান জানান, তখন তিনি আসলে কার ক্ষতি করছেন? সরকার পরিবর্তন হলে জিএসপি সুবিধা ফিরে আসবে কি না, তা অনিশ্চিত; কিন্তু এই সুবিধা বাতিল হলে তাৎক্ষণিকভাবে বেকারত্বের অভিশাপ নেমে আসত সেই সাধারণ শ্রমিকদের ওপর। একজন ‘মা’ যেমন ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও সন্তানের খাবারে বিষ মেশাতে পারেন না, তেমনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেত্রী কখনোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির পায়ে কুঠারাঘাত করতে পারেন না। বেগম খালেদা
জিয়ার সেই আহ্বান ছিল সরাসরি খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি মারার শামিল। এটি প্রমাণ করে, সেদিন তাঁর কাছে দেশের লাখো শ্রমিকের অন্নের সংস্থানের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করাটাই মুখ্য ছিল। একে রাজনৈতিক কৌশল বলা যায় না, এটি ছিল চরম আত্মঘাতী ও দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত। ২. নিষেধাজ্ঞার আমন্ত্রণ: সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞার দলিল নিবন্ধটিতে কেবল জিএসপি সুবিধার কথাই বলা হয়নি, বরং আরও কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ওবামা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নিবন্ধে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছিল: "Targeted travel and other sanctions" (টার্গেটেড ভ্রমণ এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা) আরোপ করার জন্য। বিশ্লেষণ: একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা নির্ভর করে তার আত্মমর্যাদাবোধের ওপর। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য
বিদেশিদের কাছে নালিশ করা বা সালিশ মানা এক জিনিস, আর নিজ দেশের বা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা (Sanctions) আরোপের জন্য লিখিত অনুরোধ জানানো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন আধুনিক বিশ্বে একটি নব্য-ঔপনিবেশিক হাতিয়ার। কোনো দেশের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন বিশ্বমঞ্চে সেই দেশটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে। বেগম খালেদা জিয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই নিষেধাজ্ঞার আবেদন জানান, তখন তিনি কার্যত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, দেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখার চেয়ে বিদেশি প্রভুদের শাস্তির খড়গের ওপর তাঁর আস্থা বেশি। যিনি বিদেশিদের ডেকে এনে নিজ দেশকে অপদস্থ করার
পথ দেখান, তিনি কীভাবে ‘দেশমাতা’ হতে পারেন? এটি পরাধীন মানসিকতার পরিচায়ক। ঘরোয়া রাজনীতিতে সরকারকে কোণঠাসা করতে গিয়ে পুরো দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা নিচু করানোর এই প্রচেষ্টা কোনোভাবেই দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় পড়ে না। এটি ছিল দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি চরম উপহাস। ৩. লবিস্ট রাজনীতি ও দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি এই নিবন্ধটি প্রকাশের পর যখন বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে শুরুতে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কখনো বলা হয়েছে এটি হুবহু তাঁর লেখা নয়, কখনো বলা হয়েছে এটি লবিস্ট ফার্মের কাজ। কিন্তু পরবর্তীতে ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে যে, নিবন্ধটি বেগম খালেদা জিয়ার নামেই পাঠানো হয়েছে এবং এর দায়ভার তাঁরই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, খালেদা জিয়া দেশের বিরুদ্ধে লবিং করছেন। এই নিবন্ধটি ছিল সেই লবিং রাজনীতির এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। নিবন্ধে বারবার শেখ হাসিনার সরকারকে স্বৈরাচারী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার খারাপ হতে পারে, স্বৈরাচারীও হতে পারে—কিন্তু তার জেরে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে জিম্মি করে, দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এবং বাণিজ্য সুবিধা বাতিলের উসকানি দিয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ করা কোনো সুস্থ রাজনীতির অংশ হতে পারে না। বিএনপি বা খালেদা জিয়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন মূলত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য, যাতে বিদেশি চাপে সরকার নতি স্বীকার করে। কিন্তু দিনশেষে এই লবিং দেশের জনগণের কোনো উপকারে আসেনি, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল ও সমস্যাজর্জরিত রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করেছে। ৪. মুখোশ বনাম বাস্তবতা: ইতিহাসের কাঠগড়ায় ‘দেশমাতা’ উপাধিটি কেবল একটি আবেগি শব্দ নয়, এটি একটি গুরুদায়িত্ব। মা যেমন সন্তানকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখেন, দেশমাতাকেও দেশকে আগলে রাখতে হয়—ভেতরের ও বাইরের সব শত্রু থেকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বা ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু ২০১৩ সালের এই একটি নিবন্ধ তাঁর সেই রাজনৈতিক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। রাজনীতিতে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া কোনো ‘ভুল’ নয়, এটি ‘অপরাধ’। ১. যিনি দেশের প্রধান রপ্তানি খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারেন জিএসপি বাতিলের উসকানি দিয়ে; ২. যিনি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতে পারেন; ৩. যিনি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে জনগণের বদলে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করেন; —তিনি আর যাই হোন, ‘দেশমাতা’ হতে পারেন না। আবেগ দিয়ে মানুষকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু দলিল বা ইতিহাস বদলানো যায় না। ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এর সেই নিবন্ধটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। এটি প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার অন্ধমোহে বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য ভুলে গিয়েছিল। সরাসরি বলতে গেলে—যে হাত দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য জিএসপি বাতিলের ইঙ্গিত দেয়, যে কলম দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিদেশিদের কাছে চিঠি লেখে—সেই হাত বা কলম কোনো ‘দেশমাতা’র হতে পারে না। ইতিহাসের বিচারে ওই নিবন্ধটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল ছিল না, ছিল দেশের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আর বিশ্বাসঘাতকতার দলিল যার হাতে, তাকে ‘দেশমাতা’ হিসেবে মেনে নেওয়া জাতীয় বিবেকের সাথে প্রতারণা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমের অপমান। মুখোশের আড়ালের এই সত্যটি মেনে নেওয়াই এখন সময়ের দাবি। রুদ্র মুহম্মদ জাফর সম্পাদক, আজকের কন্ঠ
মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সুনির্দিষ্ট দলিলটি হলো ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এ বেগম খালেদা জিয়ার নামে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয় (Op-ed), যার শিরোনাম ছিল— ‘The Thankless Role in Saving Democracy in Bangladesh’। এই নিবন্ধটি কেবল একটি রাজনৈতিক কলাম ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনার এক লিখিত দলিল। আজকের এই বিশ্লেষণে আমরা আবেগ সরিয়ে সরাসরি সেই নিবন্ধের বিষয়বস্তু এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। দেখব, যিনি নিজ দেশের স্বার্থ বিদেশিদের পায়ে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, তিনি কি আদৌ ‘দেশমাতা’ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? ১. জিএসপি সুবিধা নিয়ে চক্রান্ত: অর্থনীতির মেরুদণ্ডে কুঠারাঘাত ২০১৩ সাল
ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। রানা প্লাজা ধসের পূর্ববর্তী সেই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে লড়াই করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এ প্রকাশিত নিবন্ধে বেগম খালেদা জিয়া লিখেছিলেন: "The U.S. government should indicate that GSP benefits... are not a permanent right." (অর্থাৎ: যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত হাসিনাকে বোঝানো যে, জিএসপি সুবিধা কোনো স্থায়ী অধিকার নয়।) বিশ্লেষণ: জিএসপি (Generalized System of Preferences) সুবিধা কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো সরকারের সম্পত্তি নয়। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কের বাণিজ্য সুবিধা। এই সুবিধা সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে
যে ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই নারী—এই সুবিধা তাঁদের রুটি-রুজি নিশ্চিত করে। যখন একটি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বিদেশের মাটিতে বসে নিজ দেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের ইঙ্গিত দেন বা পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়ার আহ্বান জানান, তখন তিনি আসলে কার ক্ষতি করছেন? সরকার পরিবর্তন হলে জিএসপি সুবিধা ফিরে আসবে কি না, তা অনিশ্চিত; কিন্তু এই সুবিধা বাতিল হলে তাৎক্ষণিকভাবে বেকারত্বের অভিশাপ নেমে আসত সেই সাধারণ শ্রমিকদের ওপর। একজন ‘মা’ যেমন ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও সন্তানের খাবারে বিষ মেশাতে পারেন না, তেমনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেত্রী কখনোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির পায়ে কুঠারাঘাত করতে পারেন না। বেগম খালেদা
জিয়ার সেই আহ্বান ছিল সরাসরি খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি মারার শামিল। এটি প্রমাণ করে, সেদিন তাঁর কাছে দেশের লাখো শ্রমিকের অন্নের সংস্থানের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করাটাই মুখ্য ছিল। একে রাজনৈতিক কৌশল বলা যায় না, এটি ছিল চরম আত্মঘাতী ও দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত। ২. নিষেধাজ্ঞার আমন্ত্রণ: সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞার দলিল নিবন্ধটিতে কেবল জিএসপি সুবিধার কথাই বলা হয়নি, বরং আরও কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ওবামা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নিবন্ধে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছিল: "Targeted travel and other sanctions" (টার্গেটেড ভ্রমণ এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা) আরোপ করার জন্য। বিশ্লেষণ: একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা নির্ভর করে তার আত্মমর্যাদাবোধের ওপর। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য
বিদেশিদের কাছে নালিশ করা বা সালিশ মানা এক জিনিস, আর নিজ দেশের বা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা (Sanctions) আরোপের জন্য লিখিত অনুরোধ জানানো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন আধুনিক বিশ্বে একটি নব্য-ঔপনিবেশিক হাতিয়ার। কোনো দেশের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন বিশ্বমঞ্চে সেই দেশটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে। বেগম খালেদা জিয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই নিষেধাজ্ঞার আবেদন জানান, তখন তিনি কার্যত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, দেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখার চেয়ে বিদেশি প্রভুদের শাস্তির খড়গের ওপর তাঁর আস্থা বেশি। যিনি বিদেশিদের ডেকে এনে নিজ দেশকে অপদস্থ করার
পথ দেখান, তিনি কীভাবে ‘দেশমাতা’ হতে পারেন? এটি পরাধীন মানসিকতার পরিচায়ক। ঘরোয়া রাজনীতিতে সরকারকে কোণঠাসা করতে গিয়ে পুরো দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা নিচু করানোর এই প্রচেষ্টা কোনোভাবেই দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় পড়ে না। এটি ছিল দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি চরম উপহাস। ৩. লবিস্ট রাজনীতি ও দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি এই নিবন্ধটি প্রকাশের পর যখন বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে শুরুতে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কখনো বলা হয়েছে এটি হুবহু তাঁর লেখা নয়, কখনো বলা হয়েছে এটি লবিস্ট ফার্মের কাজ। কিন্তু পরবর্তীতে ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে যে, নিবন্ধটি বেগম খালেদা জিয়ার নামেই পাঠানো হয়েছে এবং এর দায়ভার তাঁরই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, খালেদা জিয়া দেশের বিরুদ্ধে লবিং করছেন। এই নিবন্ধটি ছিল সেই লবিং রাজনীতির এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। নিবন্ধে বারবার শেখ হাসিনার সরকারকে স্বৈরাচারী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার খারাপ হতে পারে, স্বৈরাচারীও হতে পারে—কিন্তু তার জেরে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে জিম্মি করে, দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এবং বাণিজ্য সুবিধা বাতিলের উসকানি দিয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ করা কোনো সুস্থ রাজনীতির অংশ হতে পারে না। বিএনপি বা খালেদা জিয়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন মূলত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য, যাতে বিদেশি চাপে সরকার নতি স্বীকার করে। কিন্তু দিনশেষে এই লবিং দেশের জনগণের কোনো উপকারে আসেনি, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল ও সমস্যাজর্জরিত রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করেছে। ৪. মুখোশ বনাম বাস্তবতা: ইতিহাসের কাঠগড়ায় ‘দেশমাতা’ উপাধিটি কেবল একটি আবেগি শব্দ নয়, এটি একটি গুরুদায়িত্ব। মা যেমন সন্তানকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখেন, দেশমাতাকেও দেশকে আগলে রাখতে হয়—ভেতরের ও বাইরের সব শত্রু থেকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বা ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু ২০১৩ সালের এই একটি নিবন্ধ তাঁর সেই রাজনৈতিক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। রাজনীতিতে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া কোনো ‘ভুল’ নয়, এটি ‘অপরাধ’। ১. যিনি দেশের প্রধান রপ্তানি খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারেন জিএসপি বাতিলের উসকানি দিয়ে; ২. যিনি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতে পারেন; ৩. যিনি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে জনগণের বদলে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করেন; —তিনি আর যাই হোন, ‘দেশমাতা’ হতে পারেন না। আবেগ দিয়ে মানুষকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু দলিল বা ইতিহাস বদলানো যায় না। ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইমস’-এর সেই নিবন্ধটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। এটি প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার অন্ধমোহে বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য ভুলে গিয়েছিল। সরাসরি বলতে গেলে—যে হাত দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য জিএসপি বাতিলের ইঙ্গিত দেয়, যে কলম দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিদেশিদের কাছে চিঠি লেখে—সেই হাত বা কলম কোনো ‘দেশমাতা’র হতে পারে না। ইতিহাসের বিচারে ওই নিবন্ধটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল ছিল না, ছিল দেশের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আর বিশ্বাসঘাতকতার দলিল যার হাতে, তাকে ‘দেশমাতা’ হিসেবে মেনে নেওয়া জাতীয় বিবেকের সাথে প্রতারণা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমের অপমান। মুখোশের আড়ালের এই সত্যটি মেনে নেওয়াই এখন সময়ের দাবি। রুদ্র মুহম্মদ জাফর সম্পাদক, আজকের কন্ঠ



