ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
বিশ্বাসঘাতকতা ও ইতিহাস অস্বীকারই ড. ইউনুসের কৌশল
অ-সরকারের সতেরো মাস : তিনগুণ খেলাপি ঋণ, শূন্য বিনিয়োগ
ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে যারা দেশকে জিম্মি করে রেখেছে
ক্ষমতার দাবার চালে অসুস্থ খালেদা জিয়া: মানবিকতার চেয়ে যখন রাজনৈতিক স্বার্থই মুখ্য!
লাশ নিয়ে টালবাহানা করিও না’—মৃত্যুর আগে সন্তানদের প্রতি রফিকুল্লা আফসারীর আবেগঘন ভিডিও বার্তা
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসমতে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী পূজার ছুটি বাতিল ছুটির এই তালিকা প্রকাশ করেছে
আইনশৃঙ্খলার অজুহাতে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ওপর পরিকল্পিত আঘাত—ফরিদপুরে বন্ধ ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব!
আলাদিনের প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসা জ্বীনের কবলে যখন খোদ আলাদিনেরাই!
প্রাণে আনো গান’ শীর্ষক চার দিনব্যাপী এক সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেছিলো। ঢাকা ব্যাংকের সহযোগিতায় আয়োজিত এ-উৎসবে সংগীত, কারুশিল্প ও চিত্রকলায় সংস্কৃতির এবং সমকালীন জীবনধারার নানা কৌণিক দিক প্রতিফলিত করতে প্রয়াসী ছিলো তারা। বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চা এবং সাধনাকে গতিময় ও বহুমাত্রিক করার লক্ষ্যে তাদের চর্চা ও প্রয়াসের অব্যাহত ধারার অংশ ছিলো এই আয়োজন। বাংলা সংস্কৃতিপ্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় ছিলো লক্ষ্যনীয় ৪দিনই।
এখন কথা হচ্ছে, এতো বিস্তারিত করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কেত্তন কেনো গাইছি? কারন হচ্ছে, ক্ষমতার লোভে বোধ-বুদ্ধি শুন্য হয়ে নিজেদেরকে আরব্য রজনীর গল্পের মধ্যপ্রাচ্যের কাল্পনিক শহর আগ্রাবাহ-এর রক্ষাকর্তা আলাদিন ভেবে ডিপ স্টেট – পাকিস্তান – তুরষ্ক – কাতার – সরোস এর ঠেলে দেয়া
কালার রেভুলেশনের ম্যাজিক ল্যাম্প ঘষে মুক্ত করে ফেলা বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদের জ্বীন যে আলাদিনকেই পিষে ফেলার উপক্রম করেছে তার একটা নমুনা চাক্ষুস করার সুযোগ লাভ করেছি তা আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সংবরণ করতে না পারা! বিগত কয়েক মাসে যে হারে বোমা পড়ছে সারা দেশে – খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের চার্চে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে, বাসাবাড়ি সবখানেই, যেকোনো সময়ে, এখন কেউ কাগজের ঠোঙা ফাটালেও মনে হয় যে এই বুঝি আবারও বোমা পড়লো! বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের সিরিজ বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, খোদ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর বোমা হামলার স্মৃতি এখনো তাজা আছে আমাদের। আর ঠিক সেই পরিবেশই যে আবার ফিরে আসছে, তার একটা জীবন্ত প্রমাণ পেলাম গতকাল
উৎসবের চতুর্থদিন, শনিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যায়। মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দার রবীন্দ্রনাথের ভাঙ্গা গান শেষ হয়ে ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের জীবনমুখী গানের পরিবেশনা চলছিলো। এই শায়ানই হচ্ছেন ২০২৪ এর জুলাই দাঙ্গার অন্যতম সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসী, অর্ধনারী-অর্ধ পুরুষ সঙ্গীতশিল্পী। তার পরিবেশনার একদম শেষের দিকে আর টুনটুন বাউলের পরিবেশনা শুরুর আগে দর্শক সারিতে এসে ঢোকেন স্বঘোষিত সাংবাদিক, যুদ্ধাপরাধীদের দালাল, কুখ্যাত গুজববাজ ডেভিড বার্গম্যান আর তার এদেশীয় স্ত্রী, ডিপস্টেটের হয়ে ভাড়া খাটা তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী, বটতলার উকিল সারা হোসেন। সেনাবাহিনীকে খুঁচিয়ে শায়ানের লেখা কল্পনা চাকমাকে গানে অডিয়েন্সের খুব একটা আগ্রহ পরিলক্ষিত না হলেও সকলের ভাগের হাততালি প্রায় একাই দিয়ে ফেলেছিলেন সারা হোসেন! কে জানে হয়তো সকালে সিরডাপের চামেলি
হাউজে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের অনুষ্ঠানে এলোমেলো বক্তব্য রাখার পর স্পটেই ব্যাপক ঝাড় খেয়ে আসার পর সারা তার মন খারাপ উদবাহু হাততালির মাধ্যমে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন কিনা! হঠাৎ নাকে ভেসে আসলো রোস্ট রাধার গন্ধ, শশা-লেবু সালাদের গন্ধ! ইতিউতি নজর ফেরাতেই চোখে পড়লো ফাউন্ডেশনের পাশের এক অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে খানাখাদ্যের ব্যাপক আয়োজন হচ্ছে! সুখাদ্যের সুগন্ধের রহস্য সমাধান হলো তাহলে! টুনটুন বাউল মঞ্চে এসেই পরিবেশ হালকা করতে চলমান পরিস্থিতি, বাউল-শিল্পীদের উপর হামলা, ওহাবী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে ইঙ্গিত করে ঠাট্টার ছলে আলাপ চালান দর্শকদের সাথে। শেষে বলেন, “আমি বুড়ো মানুষ, এমনিতেই মরে যাবো কয়দিন পর, জোর করে মারার আর কি দরকার! থাকি না আর কিছুদিন বেঁচে,
গান গেয়ে! দোয়া করবেন সবাই একটু এটাই আমাদের জন্য।” তার এই কথা কিন্তু নেহায়েত রসিকতা ছিল না। এটা ছিল একজন শিল্পীর আর্তনাদ যিনি জানেন যে এই দেশে এখন তার মতো মানুষদের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে। যে বাংলাদেশ কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-শিল্পীদের সম্মান করে বড় হয়েছে, সেই বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে এমন এক জায়গায় যেখানে লালন-রবীন্দ্রনাথের চর্চা করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বেরসিক ক্যামেরাম্যান এমন টাইমেই ক্যামেরা ঘোরায় ডেভিড-সারা দিকে। বড় স্ক্রিনে পরিষ্কার দেখা যায় সারার মুখে প্রবল বিরক্তির ছাপ টুনটুন বাউলের কথায়। সৃষ্টিকর্তার কি লীলা, ঠিক এমন টাইমেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বিল্ডিংয়ের পেছনের সেই রোস্টের গন্ধ ছড়ানো ছাদ থেকে ছাড়া হলো গুটি কতোক চৈনিক আতশবাজি!
বিকট শব্দে আকাশে গিয়ে ফুলঝুরি ছুটিয়ে সেগুলো ফাটা আরম্ভ হতেই ফাউন্ডেশনের চারতলার হলরুমে শুরু হলো আতঙ্কের ছড়াছড়ি! হলের ভেতরেই বোমা পড়েছে ভেবে একদল উঠে দৌড়ে বের হতে গিয়ে চেয়ারে পা বেঁধে জনৈক বিগতযৌবনা, অতি প্রসাধন মাখা খালার মতো আপু মেঝেতে আছড়ে পড়ার পর স্টেজ থেকে টুনটুন বাউল মাইকে বলে উঠলেন, “এই, যাহ!” কিন্তু সারা হোসেন সেটা অবশ্য শোনার মতো অবস্থায় ছিলেন না তখন। উচ্চতায় তার দ্বিগুন ডেভিড বার্গম্যানকে বগলদাবা করে হেঁচড়ে বের হতে অতি ব্যস্ত তখন তিনি। গায়ের চাদর মাটিতে লুটিয়ে তার বিখ্যাত হাতাকাটা ব্লাউজ প্রায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে তারও হুশ নেই তখন! লিফটের তোয়াক্কা না করেই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামেন
নিচে! হুড়োহুড়ির মধ্যে যখন বোঝা গেলো যে বোমাটোমা কিছু না, ফাটছে আসলে আতশবাজি, দর্শকসারীতে ব্যাপক হাস্যরোলের সৃষ্টি হয়! আছড়ে-পাছড়ে ভেগে যাওয়াদের ফাঁকা সিট তখন এতোক্ষন পিছনের সারিতে থাকা দর্শক দিয়ে ভরে যেতে ব্যস্ত। টুনটুন বাউল শুরু করলেন লালনের অসাধারণ ভাবসংগীত পরিবেশন! যেখানে মানবতাবাদ, প্রেম, ভক্তি, আত্মা সব মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে! আফসোস হলো, এই জিনিস উপভোগ করতে পারলেন না আমাদের বিখ্যাত “মানবতাবাদী” হাতা কাটা ব্লাউজের সারা আপু! অবশ্য আলাদিনও তো প্রদীপ ঘষার পর জ্বীন বের হওয়ার পর দৌড় দিয়েছিলো, সারা আপুর আর কি দোষ! মাঝখান দিয়ে আতঙ্কে দৌড়াদৌড়িতে আলাদীনের পোষা বাদর আবুর মানুষ ভার্সন ডেভিড বার্গম্যানের দফারফা সাড়া! বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে আতশবাজির শব্দে সারা হোসেনের যে আতঙ্কিত দৌড়ঝাঁপ, সেটা কিন্তু নেহায়েত কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। এটা সেই ভয়ের বহিঃপ্রকাশ যা তারা নিজেরাই তৈরি করেছেন দেশজুড়ে। জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গার মাধ্যমে যে অবৈধ ক্ষমতা দখলের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তার নায়করা এখন নিজেদের তৈরি করা জ্বীনের কবলে পড়ে হাসির খোরাক হয়ে গেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস আর তার পুরো দল মিলে যে ক্যু সাজিয়েছিলেন, সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল পাকিস্তান, তুরস্ক, কাতারের রাজনৈতিক সমর্থন, সোরোসের ফাউন্ডেশনগুলোর অর্থায়ন আর জামায়াত-শিবিরের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাঠপর্যায়ের সন্ত্রাস। শত শত তরুণকে হত্যা করে, পুরো দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার এই প্রকল্পে ডেভিড বার্গম্যান আর সারা হোসেনের মতো মানুষেরা ছিলেন মিডিয়া আর আইনি ফ্রন্টের সৈনিক। ডেভিড বার্গম্যান তো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজামী-মুজাহিদদের বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন বছরের পর বছর। একাত্তরের গণহত্যাকারীদের রক্ষার জন্য যে লোক আইনি লড়াই করেছে, তার হাতে ধরা খেয়ে সারা হোসেন বেঙ্গলের হল থেকে দৌড়ে পালানো একটা চমৎকার রূপক তৈরি করেছে। যেসব মানুষ মানবাধিকারের নামে একদিকে একাত্তরের কসাইদের পক্ষে সওয়াল করেন, আরেকদিকে জুলাইয়ের গণহত্যাকে গণঅভ্যুত্থান বলে চালিয়ে দিতে চান, তাদের আসল চেহারা এভাবেই ধরা পড়ে। সারা হোসেন আর তার জামাতা কাজী রেহান হাসান কিংবা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদদের মতো লোকজন ভেবেছিলেন তারা নতুন বাংলাদেশের স্থপতি হবেন। কিন্তু যখন দেশজুড়ে বোমাবাজি শুরু হলো, খ্রিস্টান চার্চে হামলা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিস্ফোরণ ঘটলো, রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে বোমা ফাটতে লাগলো, তখন এই বিপ্লবীরা বুঝলেন তারা আসলে কী জিনিসের ঢাকনা খুলে দিয়েছেন। বাউল শিল্পীদের উপর হামলা, সংস্কৃতিকর্মীদের জীবন নিয়ে টানাটানি, ওহাবি মতাদর্শের ব্যাপক প্রসার এসব তো তাদেরই তৈরি পরিবেশের ফসল। শায়ান চৌধুরীর মতো শিল্পীরা জুলাইয়ের দাঙ্গার সময় সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস চালিয়েছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক গান বানিয়েছেন। এখন যখন সেই একই ধারার মৌলবাদীরা সব ধরনের সংগীত-সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে, তখন এই শায়ানরাই আবার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। যে আগুন নিজেরা জ্বালিয়েছিলেন, সেই আগুনই এখন তাদের পুড়িয়ে ফেলতে আসছে। ইউনূসের পুরো অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল হচ্ছে একটা প্রহসন। এরা কেউ নির্বাচিত নন, জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই তাদের। কিন্তু বসে আছেন সরকারি ক্ষমতায়, ভোগ করছেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এদের যোগ্যতা কী? শিক্ষার্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া? কিন্তু সেই আন্দোলন তো কোটা সংস্কারের জন্য শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছিল সরকার পতনে। মাঝখানে কত শত তরুণ মারা গেল, কত পুলিশ অফিসার হত্যা হলো, কত সরকারি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, সেই হিসাব কে দেবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউনূস আর তার দল যে পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছেন, সেটা সামরিক সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অবৈধ ক্যু বা অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল করলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহীরাই এখন নৈতিকতা আর গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সেজে বসে আছেন। জুলাইয়ের ঘটনার পর থেকে দেশে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। যারা আসলে জুলাইয়ের গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা কি বিচার? নাকি প্রতিহিংসা? সারা হোসেন যিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত, তিনি কিন্তু কখনোই জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাননি। যেসব পুলিশ অফিসারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, যাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য কোনো কান্না নেই এই তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীদের। ডেভিড বার্গম্যান আর সারা হোসেন যখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের হল থেকে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে, তখন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই ভয় নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছেন যে রাতে হয়তো কোথাও বোমা ফাটবে। এই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছেন ইউনূস আর তার দল। তারা ক্ষমতায় এসেছেন সন্ত্রাসের মাধ্যমে, টিকে আছেন সন্ত্রাসের সমর্থনে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তারাই এখন নিরাপদ অনুভব করছেন না। সারা হোসেনের সেই দৌড়াদৌড়ি দেখে মনে পড়ে যায়, ফরাসি বিপ্লবের সময় যারা গিলোটিনে মানুষের মাথা কাটতেন, তাদেরই এক সময় গিলোটিনে পাঠানো হয়েছিল। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত তার প্রবর্তকদেরই গ্রাস করে। ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, বিদেশি তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগ, এসব তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু তিনি এখন ক্ষমতায় আছেন, কারণ তার পেছনে আছে পশ্চিমা স্বার্থ, আছে পাকিস্তানি মদদ, আছে সামরিক সমর্থন। এই সমীকরণে দেশের মানুষের স্বার্থ কোথায়? বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতে যা ঘটেছিল, সেটা একটা ছোট্ট নাটক মাত্র। আসল নাটক চলছে সারাদেশে। আর এই নাটকের পরিণতি হবে ভয়াবহ, যদি না এখনই কেউ থামে। কিন্তু কে থামবে? যারা জ্বীন বের করেছেন প্রদীপ থেকে, তারা তো এখন নিজেরাই সেই জ্বীনের কবলে। আর বাকিরা? তারা দর্শক হয়ে বসে আছেন, ঠিক যেমন বেঙ্গলের হলে দর্শকরা বসেছিলেন গান শোনার জন্য, কিন্তু পেয়েছিলেন এক হাস্যকর ভয়ের মহড়া। আচ্ছা, সারা হোসেনের মতো বাকি আলাদিনদের কি খবর? কেমনই বা আছে তাদের পোষা আবুরা? কেউ কি খোঁজ জানেন তাদের? জুলাই প্রদীপের জ্বীনের ডলা খাওয়ার অনুভূতি কেমন, কাউকে জানিয়েছেন কি? নাকি জীবনানন্দ দাশের মতো, “আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে” মুডে আছেন? জানাবেন তো, কেউ যদি জেনে থাকেন! যারা এই নাটকের নায়ক-নায়িকা সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন, তাদের অবস্থা এখন কী? মুহাম্মদ ইউনূস যিনি নোবেল বিজয়ী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ছিলেন, তিনি এখন একটা অবৈধ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন। যে মানুষ একসময় ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের কথা বলতেন, সেই মানুষই এখন রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তা কি এভাবেই শেষ হবে? নাহিদ ইসলাম আর আসিফ মাহমুদের মতো তরুণরা যারা ভেবেছিলেন তারা দেশকে নতুন করে গড়বেন, তারা এখন প্রতিদিন নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। এই তরুণ “উপদেষ্টারা” কি জানতেন যে শুধু বিপ্লবের স্লোগান দিয়ে দেশ চালানো যায় না? একটা দেশ চালাতে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, আর সর্বোপরি জনগণের আস্থা। যার একটাও নেই তাদের কাছে। সারা হোসেন যিনি দীর্ঘদিন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে একদিন তিনি নিজেই বোমার আতঙ্কে দৌড়ে পালাবেন? যে পরিবেশ তৈরিতে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল, সেই পরিবেশেই তিনি এখন নিজে অনিরাপদ বোধ করছেন। এটাই কি ন্যায়বিচার? নাকি কারো কারো কাছে ন্যায়বিচার মানে শুধু নিজের পক্ষের মানুষদের রক্ষা করা আর বিপক্ষের মানুষদের শাস্তি দেওয়া? ডেভিড বার্গম্যান যিনি বছরের পর বছর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করেছেন, তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে তার সমর্থিত শক্তিগুলো একদিন তাকেও গ্রাস করতে পারে? জামায়াত-শিবিরের যে মতাদর্শ তিনি পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন, সেই মতাদর্শের অনুসারীরা কিন্তু তার মতো পশ্চিমা মানুষদেরও ক্ষমা করবে না। তারা যখন পূর্ণ ক্ষমতায় আসবে, তখন ডেভিড বার্গম্যানের মতো মানুষদের জন্যও এদেশে জায়গা থাকবে না। কাজী রেহান হাসান, সারা হোসেনের জামাতা, যিনি নিজেকে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন, তিনি কি বুঝতে পারছেন যে তার শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা যে রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন, সেটা শেষ পর্যন্ত তাদের পরিবারকেই ধ্বংস করবে? জুলাইয়ের পর থেকে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে কেউই নিরাপদ নয়। না প্রগতিশীল, না রক্ষণশীল, না ধনী, না গরিব। সবাই এখন একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শায়ান চৌধুরীর মতো শিল্পীরা যারা জুলাইয়ে “বিপ্লবের” পক্ষে গান গেয়েছিলেন, তারা এখন কেমন আছেন? তাদের গাওয়া সেই উস্কানিমূলক গানগুলো কি এখনো গর্বের সাথে গাইতে পারেন? নাকি এখন তারাও বুঝতে পারছেন যে যে শক্তিকে তারা উসকে দিয়েছিলেন, সেই শক্তিই এখন তাদের গলা টিপে ধরতে আসছে? যখন বাউল শিল্পীদের উপর হামলা হয়, যখন সংগীত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি আসে, তখন কি তারা বুঝতে পারেন যে তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছেন? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা এই পুরো নাটকের নীরব দর্শক, তারা কী ভাবছেন? যারা জুলাইয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন কোটা সংস্কারের দাবিতে, তারা কি জানতেন যে তাদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে একটা সরকারকে উৎখাত করা হবে? যারা পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, তাদের পরিবার কি এখন সন্তুষ্টি পাচ্ছেন? নাকি তারা বুঝতে পারছেন যে তাদের সন্তানদের মৃত্যুকে একটা রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে? যেসব পুলিশ সদস্যদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের পরিবারকে রাস্তায় নামতে হয়েছে, তারা কি কখনো ন্যায়বিচার পাবেন? যেসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী যারা কোনো অপরাধ করেননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, তারা কি কখনো মুক্তি পাবেন? নাকি এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের ন্যায়বিচার যেখানে বিজয়ীরা যা বলবে তাই হবে আইন? বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই ঘটনাটা শুধু একটা মজার ঘটনা নয়, এটা একটা প্রতীক। এটা প্রতীক সেই ভয়ের যা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এটা প্রতীক সেই অনিশ্চয়তার যা এখন প্রতিটি মানুষের মনে। এটা প্রতীক সেই ব্যর্থতার যা জুলাইয়ের তথাকথিত “বিপ্লবীরা” এনে দিয়েছেন এদেশে। ইউনূস আর তার দল যদি সত্যিই দেশের জন্য কাজ করতে চাইতেন, তাহলে তারা একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন। জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিতেন যে তারা কাকে চান। কিন্তু তারা তা করছেন না, কারণ তারা জানেন যে নির্বাচনে তারা জিততে পারবেন না। তাই তারা ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরে আছেন, একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দিচ্ছেন। এটা কি গণতন্ত্র? নাকি একনায়কতন্ত্র? সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করছিল গত পনেরো বছরে, সেটা থমকে গেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার – সবকিছুতেই ধাক্কা লেগেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশকে একটা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখছেন। পোশাক রপ্তানি, যেটা আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেটা হুমকির মুখে। প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। এই সবকিছুর দায় কে নেবে? টুনটুন বাউলের সেই কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। “আমি বুড়ো মানুষ, এমনিতেই মরে যাবো কয়দিন পর, জোর করে মারার আর কি দরকার!” এটা শুধু একজন বাউল শিল্পীর কথা নয়, এটা বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির কান্না। যে দেশে একসময় লালন, হাসন রাজা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের চর্চা হতো গর্বের সাথে, সেই দেশে এখন শিল্পীদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এটা কি অগ্রগতি? নাকি পশ্চাদপদতা? যারা জুলাইয়ের নামে ক্ষমতা দখল করেছেন, তারা এখন নিজেরাই তাদের তৈরি করা দানবের কবলে। সারা হোসেনের সেই আতঙ্কিত দৌড় শুধু একটা ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটা একটা জাতির সামষ্টিক ভয়ের প্রতিফলন। যখন একজন মানুষ যিনি নিজেকে মানবাধিকার কর্মী বলে দাবি করেন, তিনি যদি আতশবাজির শব্দে বোমা ভেবে দৌড়ে পালান, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে? ডেভিড বার্গম্যানকে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া সারা হোসেনের সেই দৃশ্যটা কিন্তু অনেক কিছু বলে। এটা বলে যে যারা মনে করেছিলেন তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তারা আসলে নিজেরাই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির শিকার। এটা বলে যে যারা অন্যদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা এখন নিজেরাই ভয়ে আছেন। এটা বলে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি কখনোই সফল হয় না, শুধু ধ্বংস আর বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই রেখে যায় না। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এর শেষ কোথায়? কতদিন চলবে এই অনিশ্চয়তা? কতদিন মানুষ ভয়ে ভয়ে দিন কাটাবে? কতদিন শিল্পীরা নিজেদের শিল্প চর্চা করতে ভয় পাবেন? কতদিন সাংবাদিকরা সত্য লিখতে ভয় পাবেন? কতদিন সাধারণ মানুষ রাস্তায় বেরুতে ভয় পাবেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কারো কাছে নেই। কারণ যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তারা নিজেরাই জানেন না তারা কী করছেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের হলে যখন দর্শকেরা টুনটুন বাউলকে লালনের বিখ্যাত গান “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গাইতে অনুরোধ করছিলো, তখন সেখানে উপস্থিত দর্শকদের মনে হয়তো এই প্রশ্ন জেগেছিল যে বাংলাদেশ কি এখন একটা খাঁচায় পরিণত হয়েছে যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই? যেখানে সংস্কৃতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছু শিকলবন্দি হয়ে যাচ্ছে? যেখানে একদল অনির্বাচিত মানুষ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন জনগণের ভাগ্যের উপর? ইতিহাস বলে, যে সমাজ তার শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই সমাজ কখনোই উন্নতি করতে পারে না। যে দেশে মানুষ ভয়ে কথা বলতে পারে না, সেই দেশ কখনোই সমৃদ্ধ হতে পারে না। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাইয়ের আলাদিনরা তাদের ম্যাজিক ল্যাম্প ঘষে যে জ্বীন বের করেছিলেন, সেই জ্বীন এখন তাদেরই পিষে ফেলছে। আর দেশের সাধারণ মানুষ, তারা এই পুরো নাটকের নিরীহ শিকার। তারা চেয়েছিলেন একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ, পেয়েছেন অনিশ্চয়তা আর ভয়। তারা চেয়েছিলেন ন্যায়বিচার, পেয়েছেন প্রতিহিংসা। তারা চেয়েছিলেন উন্নয়ন, পেয়েছেন ধ্বংস। সারা হোসেন, ডেভিড বার্গম্যান, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, কাজী রেহান হাসান – এই সব নামগুলো হয়তো ইতিহাসে থেকে যাবে। কিন্তু কী হিসেবে? মুক্তিদাতা হিসেবে? নাকি ধ্বংসকারী হিসেবে? সময়ই বলে দেবে। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতের ঘটনা একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছে যে ইতিহাসের রায় কী হতে পারে। যখন আতশবাজির শব্দে মানুষ বোমা ভেবে দৌড়ে পালায়, যখন একজন বাউল শিল্পীকে তার জীবনের জন্য দোয়া চাইতে হয়, যখন সংস্কৃতিকর্মীদের নিজেদের শিল্প চর্চা করতে ভয় পায়, তখন বুঝতে হবে যে দেশ একটা ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এই সংকটের সমাধান হতে পারে না আরও সন্ত্রাস, আরও দমন-পীড়ন দিয়ে। এর সমাধান হতে পারে কেবল গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আর মানবিক মূল্যবোধে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেই পথে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে কি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের? নাকি তারা ক্ষমতার মোহে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছেন যে তারা দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিতে থাকবেন? প্রশ্নটা খোলা রইলো। উত্তরটা সময় দেবে। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা একটা জীবন্ত নাটক দেখে গেছেন। আর সেই নাটকের শিক্ষা হলো – যে আগুন নিজে জ্বালাবেন, সেই আগুনে নিজেই পুড়বেন। আলাদিনের জ্বীন কখনোই আলাদিনের বশে থাকে না। শেষ পর্যন্ত জ্বীনই হয়ে ওঠে প্রভু, আর আলাদিন হয়ে পড়ে ক্রীতদাস।
কালার রেভুলেশনের ম্যাজিক ল্যাম্প ঘষে মুক্ত করে ফেলা বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদের জ্বীন যে আলাদিনকেই পিষে ফেলার উপক্রম করেছে তার একটা নমুনা চাক্ষুস করার সুযোগ লাভ করেছি তা আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সংবরণ করতে না পারা! বিগত কয়েক মাসে যে হারে বোমা পড়ছে সারা দেশে – খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের চার্চে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে, বাসাবাড়ি সবখানেই, যেকোনো সময়ে, এখন কেউ কাগজের ঠোঙা ফাটালেও মনে হয় যে এই বুঝি আবারও বোমা পড়লো! বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের সিরিজ বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, খোদ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর বোমা হামলার স্মৃতি এখনো তাজা আছে আমাদের। আর ঠিক সেই পরিবেশই যে আবার ফিরে আসছে, তার একটা জীবন্ত প্রমাণ পেলাম গতকাল
উৎসবের চতুর্থদিন, শনিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যায়। মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দার রবীন্দ্রনাথের ভাঙ্গা গান শেষ হয়ে ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের জীবনমুখী গানের পরিবেশনা চলছিলো। এই শায়ানই হচ্ছেন ২০২৪ এর জুলাই দাঙ্গার অন্যতম সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসী, অর্ধনারী-অর্ধ পুরুষ সঙ্গীতশিল্পী। তার পরিবেশনার একদম শেষের দিকে আর টুনটুন বাউলের পরিবেশনা শুরুর আগে দর্শক সারিতে এসে ঢোকেন স্বঘোষিত সাংবাদিক, যুদ্ধাপরাধীদের দালাল, কুখ্যাত গুজববাজ ডেভিড বার্গম্যান আর তার এদেশীয় স্ত্রী, ডিপস্টেটের হয়ে ভাড়া খাটা তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী, বটতলার উকিল সারা হোসেন। সেনাবাহিনীকে খুঁচিয়ে শায়ানের লেখা কল্পনা চাকমাকে গানে অডিয়েন্সের খুব একটা আগ্রহ পরিলক্ষিত না হলেও সকলের ভাগের হাততালি প্রায় একাই দিয়ে ফেলেছিলেন সারা হোসেন! কে জানে হয়তো সকালে সিরডাপের চামেলি
হাউজে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের অনুষ্ঠানে এলোমেলো বক্তব্য রাখার পর স্পটেই ব্যাপক ঝাড় খেয়ে আসার পর সারা তার মন খারাপ উদবাহু হাততালির মাধ্যমে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন কিনা! হঠাৎ নাকে ভেসে আসলো রোস্ট রাধার গন্ধ, শশা-লেবু সালাদের গন্ধ! ইতিউতি নজর ফেরাতেই চোখে পড়লো ফাউন্ডেশনের পাশের এক অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে খানাখাদ্যের ব্যাপক আয়োজন হচ্ছে! সুখাদ্যের সুগন্ধের রহস্য সমাধান হলো তাহলে! টুনটুন বাউল মঞ্চে এসেই পরিবেশ হালকা করতে চলমান পরিস্থিতি, বাউল-শিল্পীদের উপর হামলা, ওহাবী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে ইঙ্গিত করে ঠাট্টার ছলে আলাপ চালান দর্শকদের সাথে। শেষে বলেন, “আমি বুড়ো মানুষ, এমনিতেই মরে যাবো কয়দিন পর, জোর করে মারার আর কি দরকার! থাকি না আর কিছুদিন বেঁচে,
গান গেয়ে! দোয়া করবেন সবাই একটু এটাই আমাদের জন্য।” তার এই কথা কিন্তু নেহায়েত রসিকতা ছিল না। এটা ছিল একজন শিল্পীর আর্তনাদ যিনি জানেন যে এই দেশে এখন তার মতো মানুষদের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে। যে বাংলাদেশ কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-শিল্পীদের সম্মান করে বড় হয়েছে, সেই বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে এমন এক জায়গায় যেখানে লালন-রবীন্দ্রনাথের চর্চা করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বেরসিক ক্যামেরাম্যান এমন টাইমেই ক্যামেরা ঘোরায় ডেভিড-সারা দিকে। বড় স্ক্রিনে পরিষ্কার দেখা যায় সারার মুখে প্রবল বিরক্তির ছাপ টুনটুন বাউলের কথায়। সৃষ্টিকর্তার কি লীলা, ঠিক এমন টাইমেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বিল্ডিংয়ের পেছনের সেই রোস্টের গন্ধ ছড়ানো ছাদ থেকে ছাড়া হলো গুটি কতোক চৈনিক আতশবাজি!
বিকট শব্দে আকাশে গিয়ে ফুলঝুরি ছুটিয়ে সেগুলো ফাটা আরম্ভ হতেই ফাউন্ডেশনের চারতলার হলরুমে শুরু হলো আতঙ্কের ছড়াছড়ি! হলের ভেতরেই বোমা পড়েছে ভেবে একদল উঠে দৌড়ে বের হতে গিয়ে চেয়ারে পা বেঁধে জনৈক বিগতযৌবনা, অতি প্রসাধন মাখা খালার মতো আপু মেঝেতে আছড়ে পড়ার পর স্টেজ থেকে টুনটুন বাউল মাইকে বলে উঠলেন, “এই, যাহ!” কিন্তু সারা হোসেন সেটা অবশ্য শোনার মতো অবস্থায় ছিলেন না তখন। উচ্চতায় তার দ্বিগুন ডেভিড বার্গম্যানকে বগলদাবা করে হেঁচড়ে বের হতে অতি ব্যস্ত তখন তিনি। গায়ের চাদর মাটিতে লুটিয়ে তার বিখ্যাত হাতাকাটা ব্লাউজ প্রায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে তারও হুশ নেই তখন! লিফটের তোয়াক্কা না করেই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামেন
নিচে! হুড়োহুড়ির মধ্যে যখন বোঝা গেলো যে বোমাটোমা কিছু না, ফাটছে আসলে আতশবাজি, দর্শকসারীতে ব্যাপক হাস্যরোলের সৃষ্টি হয়! আছড়ে-পাছড়ে ভেগে যাওয়াদের ফাঁকা সিট তখন এতোক্ষন পিছনের সারিতে থাকা দর্শক দিয়ে ভরে যেতে ব্যস্ত। টুনটুন বাউল শুরু করলেন লালনের অসাধারণ ভাবসংগীত পরিবেশন! যেখানে মানবতাবাদ, প্রেম, ভক্তি, আত্মা সব মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে! আফসোস হলো, এই জিনিস উপভোগ করতে পারলেন না আমাদের বিখ্যাত “মানবতাবাদী” হাতা কাটা ব্লাউজের সারা আপু! অবশ্য আলাদিনও তো প্রদীপ ঘষার পর জ্বীন বের হওয়ার পর দৌড় দিয়েছিলো, সারা আপুর আর কি দোষ! মাঝখান দিয়ে আতঙ্কে দৌড়াদৌড়িতে আলাদীনের পোষা বাদর আবুর মানুষ ভার্সন ডেভিড বার্গম্যানের দফারফা সাড়া! বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে আতশবাজির শব্দে সারা হোসেনের যে আতঙ্কিত দৌড়ঝাঁপ, সেটা কিন্তু নেহায়েত কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। এটা সেই ভয়ের বহিঃপ্রকাশ যা তারা নিজেরাই তৈরি করেছেন দেশজুড়ে। জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গার মাধ্যমে যে অবৈধ ক্ষমতা দখলের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তার নায়করা এখন নিজেদের তৈরি করা জ্বীনের কবলে পড়ে হাসির খোরাক হয়ে গেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস আর তার পুরো দল মিলে যে ক্যু সাজিয়েছিলেন, সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল পাকিস্তান, তুরস্ক, কাতারের রাজনৈতিক সমর্থন, সোরোসের ফাউন্ডেশনগুলোর অর্থায়ন আর জামায়াত-শিবিরের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাঠপর্যায়ের সন্ত্রাস। শত শত তরুণকে হত্যা করে, পুরো দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার এই প্রকল্পে ডেভিড বার্গম্যান আর সারা হোসেনের মতো মানুষেরা ছিলেন মিডিয়া আর আইনি ফ্রন্টের সৈনিক। ডেভিড বার্গম্যান তো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজামী-মুজাহিদদের বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন বছরের পর বছর। একাত্তরের গণহত্যাকারীদের রক্ষার জন্য যে লোক আইনি লড়াই করেছে, তার হাতে ধরা খেয়ে সারা হোসেন বেঙ্গলের হল থেকে দৌড়ে পালানো একটা চমৎকার রূপক তৈরি করেছে। যেসব মানুষ মানবাধিকারের নামে একদিকে একাত্তরের কসাইদের পক্ষে সওয়াল করেন, আরেকদিকে জুলাইয়ের গণহত্যাকে গণঅভ্যুত্থান বলে চালিয়ে দিতে চান, তাদের আসল চেহারা এভাবেই ধরা পড়ে। সারা হোসেন আর তার জামাতা কাজী রেহান হাসান কিংবা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদদের মতো লোকজন ভেবেছিলেন তারা নতুন বাংলাদেশের স্থপতি হবেন। কিন্তু যখন দেশজুড়ে বোমাবাজি শুরু হলো, খ্রিস্টান চার্চে হামলা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিস্ফোরণ ঘটলো, রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে বোমা ফাটতে লাগলো, তখন এই বিপ্লবীরা বুঝলেন তারা আসলে কী জিনিসের ঢাকনা খুলে দিয়েছেন। বাউল শিল্পীদের উপর হামলা, সংস্কৃতিকর্মীদের জীবন নিয়ে টানাটানি, ওহাবি মতাদর্শের ব্যাপক প্রসার এসব তো তাদেরই তৈরি পরিবেশের ফসল। শায়ান চৌধুরীর মতো শিল্পীরা জুলাইয়ের দাঙ্গার সময় সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস চালিয়েছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক গান বানিয়েছেন। এখন যখন সেই একই ধারার মৌলবাদীরা সব ধরনের সংগীত-সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে, তখন এই শায়ানরাই আবার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। যে আগুন নিজেরা জ্বালিয়েছিলেন, সেই আগুনই এখন তাদের পুড়িয়ে ফেলতে আসছে। ইউনূসের পুরো অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল হচ্ছে একটা প্রহসন। এরা কেউ নির্বাচিত নন, জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই তাদের। কিন্তু বসে আছেন সরকারি ক্ষমতায়, ভোগ করছেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এদের যোগ্যতা কী? শিক্ষার্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া? কিন্তু সেই আন্দোলন তো কোটা সংস্কারের জন্য শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছিল সরকার পতনে। মাঝখানে কত শত তরুণ মারা গেল, কত পুলিশ অফিসার হত্যা হলো, কত সরকারি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, সেই হিসাব কে দেবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউনূস আর তার দল যে পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছেন, সেটা সামরিক সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অবৈধ ক্যু বা অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল করলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহীরাই এখন নৈতিকতা আর গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সেজে বসে আছেন। জুলাইয়ের ঘটনার পর থেকে দেশে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। যারা আসলে জুলাইয়ের গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা কি বিচার? নাকি প্রতিহিংসা? সারা হোসেন যিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত, তিনি কিন্তু কখনোই জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাননি। যেসব পুলিশ অফিসারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, যাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য কোনো কান্না নেই এই তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীদের। ডেভিড বার্গম্যান আর সারা হোসেন যখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের হল থেকে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে, তখন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই ভয় নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছেন যে রাতে হয়তো কোথাও বোমা ফাটবে। এই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছেন ইউনূস আর তার দল। তারা ক্ষমতায় এসেছেন সন্ত্রাসের মাধ্যমে, টিকে আছেন সন্ত্রাসের সমর্থনে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তারাই এখন নিরাপদ অনুভব করছেন না। সারা হোসেনের সেই দৌড়াদৌড়ি দেখে মনে পড়ে যায়, ফরাসি বিপ্লবের সময় যারা গিলোটিনে মানুষের মাথা কাটতেন, তাদেরই এক সময় গিলোটিনে পাঠানো হয়েছিল। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত তার প্রবর্তকদেরই গ্রাস করে। ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, বিদেশি তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগ, এসব তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু তিনি এখন ক্ষমতায় আছেন, কারণ তার পেছনে আছে পশ্চিমা স্বার্থ, আছে পাকিস্তানি মদদ, আছে সামরিক সমর্থন। এই সমীকরণে দেশের মানুষের স্বার্থ কোথায়? বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতে যা ঘটেছিল, সেটা একটা ছোট্ট নাটক মাত্র। আসল নাটক চলছে সারাদেশে। আর এই নাটকের পরিণতি হবে ভয়াবহ, যদি না এখনই কেউ থামে। কিন্তু কে থামবে? যারা জ্বীন বের করেছেন প্রদীপ থেকে, তারা তো এখন নিজেরাই সেই জ্বীনের কবলে। আর বাকিরা? তারা দর্শক হয়ে বসে আছেন, ঠিক যেমন বেঙ্গলের হলে দর্শকরা বসেছিলেন গান শোনার জন্য, কিন্তু পেয়েছিলেন এক হাস্যকর ভয়ের মহড়া। আচ্ছা, সারা হোসেনের মতো বাকি আলাদিনদের কি খবর? কেমনই বা আছে তাদের পোষা আবুরা? কেউ কি খোঁজ জানেন তাদের? জুলাই প্রদীপের জ্বীনের ডলা খাওয়ার অনুভূতি কেমন, কাউকে জানিয়েছেন কি? নাকি জীবনানন্দ দাশের মতো, “আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে” মুডে আছেন? জানাবেন তো, কেউ যদি জেনে থাকেন! যারা এই নাটকের নায়ক-নায়িকা সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন, তাদের অবস্থা এখন কী? মুহাম্মদ ইউনূস যিনি নোবেল বিজয়ী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ছিলেন, তিনি এখন একটা অবৈধ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন। যে মানুষ একসময় ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের কথা বলতেন, সেই মানুষই এখন রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তা কি এভাবেই শেষ হবে? নাহিদ ইসলাম আর আসিফ মাহমুদের মতো তরুণরা যারা ভেবেছিলেন তারা দেশকে নতুন করে গড়বেন, তারা এখন প্রতিদিন নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। এই তরুণ “উপদেষ্টারা” কি জানতেন যে শুধু বিপ্লবের স্লোগান দিয়ে দেশ চালানো যায় না? একটা দেশ চালাতে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, আর সর্বোপরি জনগণের আস্থা। যার একটাও নেই তাদের কাছে। সারা হোসেন যিনি দীর্ঘদিন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে একদিন তিনি নিজেই বোমার আতঙ্কে দৌড়ে পালাবেন? যে পরিবেশ তৈরিতে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল, সেই পরিবেশেই তিনি এখন নিজে অনিরাপদ বোধ করছেন। এটাই কি ন্যায়বিচার? নাকি কারো কারো কাছে ন্যায়বিচার মানে শুধু নিজের পক্ষের মানুষদের রক্ষা করা আর বিপক্ষের মানুষদের শাস্তি দেওয়া? ডেভিড বার্গম্যান যিনি বছরের পর বছর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করেছেন, তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে তার সমর্থিত শক্তিগুলো একদিন তাকেও গ্রাস করতে পারে? জামায়াত-শিবিরের যে মতাদর্শ তিনি পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন, সেই মতাদর্শের অনুসারীরা কিন্তু তার মতো পশ্চিমা মানুষদেরও ক্ষমা করবে না। তারা যখন পূর্ণ ক্ষমতায় আসবে, তখন ডেভিড বার্গম্যানের মতো মানুষদের জন্যও এদেশে জায়গা থাকবে না। কাজী রেহান হাসান, সারা হোসেনের জামাতা, যিনি নিজেকে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন, তিনি কি বুঝতে পারছেন যে তার শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা যে রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন, সেটা শেষ পর্যন্ত তাদের পরিবারকেই ধ্বংস করবে? জুলাইয়ের পর থেকে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে কেউই নিরাপদ নয়। না প্রগতিশীল, না রক্ষণশীল, না ধনী, না গরিব। সবাই এখন একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শায়ান চৌধুরীর মতো শিল্পীরা যারা জুলাইয়ে “বিপ্লবের” পক্ষে গান গেয়েছিলেন, তারা এখন কেমন আছেন? তাদের গাওয়া সেই উস্কানিমূলক গানগুলো কি এখনো গর্বের সাথে গাইতে পারেন? নাকি এখন তারাও বুঝতে পারছেন যে যে শক্তিকে তারা উসকে দিয়েছিলেন, সেই শক্তিই এখন তাদের গলা টিপে ধরতে আসছে? যখন বাউল শিল্পীদের উপর হামলা হয়, যখন সংগীত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি আসে, তখন কি তারা বুঝতে পারেন যে তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছেন? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা এই পুরো নাটকের নীরব দর্শক, তারা কী ভাবছেন? যারা জুলাইয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন কোটা সংস্কারের দাবিতে, তারা কি জানতেন যে তাদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে একটা সরকারকে উৎখাত করা হবে? যারা পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, তাদের পরিবার কি এখন সন্তুষ্টি পাচ্ছেন? নাকি তারা বুঝতে পারছেন যে তাদের সন্তানদের মৃত্যুকে একটা রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে? যেসব পুলিশ সদস্যদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের পরিবারকে রাস্তায় নামতে হয়েছে, তারা কি কখনো ন্যায়বিচার পাবেন? যেসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী যারা কোনো অপরাধ করেননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, তারা কি কখনো মুক্তি পাবেন? নাকি এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের ন্যায়বিচার যেখানে বিজয়ীরা যা বলবে তাই হবে আইন? বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই ঘটনাটা শুধু একটা মজার ঘটনা নয়, এটা একটা প্রতীক। এটা প্রতীক সেই ভয়ের যা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এটা প্রতীক সেই অনিশ্চয়তার যা এখন প্রতিটি মানুষের মনে। এটা প্রতীক সেই ব্যর্থতার যা জুলাইয়ের তথাকথিত “বিপ্লবীরা” এনে দিয়েছেন এদেশে। ইউনূস আর তার দল যদি সত্যিই দেশের জন্য কাজ করতে চাইতেন, তাহলে তারা একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন। জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিতেন যে তারা কাকে চান। কিন্তু তারা তা করছেন না, কারণ তারা জানেন যে নির্বাচনে তারা জিততে পারবেন না। তাই তারা ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরে আছেন, একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দিচ্ছেন। এটা কি গণতন্ত্র? নাকি একনায়কতন্ত্র? সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করছিল গত পনেরো বছরে, সেটা থমকে গেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার – সবকিছুতেই ধাক্কা লেগেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশকে একটা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখছেন। পোশাক রপ্তানি, যেটা আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেটা হুমকির মুখে। প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। এই সবকিছুর দায় কে নেবে? টুনটুন বাউলের সেই কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। “আমি বুড়ো মানুষ, এমনিতেই মরে যাবো কয়দিন পর, জোর করে মারার আর কি দরকার!” এটা শুধু একজন বাউল শিল্পীর কথা নয়, এটা বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির কান্না। যে দেশে একসময় লালন, হাসন রাজা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের চর্চা হতো গর্বের সাথে, সেই দেশে এখন শিল্পীদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এটা কি অগ্রগতি? নাকি পশ্চাদপদতা? যারা জুলাইয়ের নামে ক্ষমতা দখল করেছেন, তারা এখন নিজেরাই তাদের তৈরি করা দানবের কবলে। সারা হোসেনের সেই আতঙ্কিত দৌড় শুধু একটা ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটা একটা জাতির সামষ্টিক ভয়ের প্রতিফলন। যখন একজন মানুষ যিনি নিজেকে মানবাধিকার কর্মী বলে দাবি করেন, তিনি যদি আতশবাজির শব্দে বোমা ভেবে দৌড়ে পালান, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে? ডেভিড বার্গম্যানকে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া সারা হোসেনের সেই দৃশ্যটা কিন্তু অনেক কিছু বলে। এটা বলে যে যারা মনে করেছিলেন তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তারা আসলে নিজেরাই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির শিকার। এটা বলে যে যারা অন্যদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা এখন নিজেরাই ভয়ে আছেন। এটা বলে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি কখনোই সফল হয় না, শুধু ধ্বংস আর বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই রেখে যায় না। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এর শেষ কোথায়? কতদিন চলবে এই অনিশ্চয়তা? কতদিন মানুষ ভয়ে ভয়ে দিন কাটাবে? কতদিন শিল্পীরা নিজেদের শিল্প চর্চা করতে ভয় পাবেন? কতদিন সাংবাদিকরা সত্য লিখতে ভয় পাবেন? কতদিন সাধারণ মানুষ রাস্তায় বেরুতে ভয় পাবেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কারো কাছে নেই। কারণ যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তারা নিজেরাই জানেন না তারা কী করছেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের হলে যখন দর্শকেরা টুনটুন বাউলকে লালনের বিখ্যাত গান “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গাইতে অনুরোধ করছিলো, তখন সেখানে উপস্থিত দর্শকদের মনে হয়তো এই প্রশ্ন জেগেছিল যে বাংলাদেশ কি এখন একটা খাঁচায় পরিণত হয়েছে যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই? যেখানে সংস্কৃতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছু শিকলবন্দি হয়ে যাচ্ছে? যেখানে একদল অনির্বাচিত মানুষ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন জনগণের ভাগ্যের উপর? ইতিহাস বলে, যে সমাজ তার শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই সমাজ কখনোই উন্নতি করতে পারে না। যে দেশে মানুষ ভয়ে কথা বলতে পারে না, সেই দেশ কখনোই সমৃদ্ধ হতে পারে না। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাইয়ের আলাদিনরা তাদের ম্যাজিক ল্যাম্প ঘষে যে জ্বীন বের করেছিলেন, সেই জ্বীন এখন তাদেরই পিষে ফেলছে। আর দেশের সাধারণ মানুষ, তারা এই পুরো নাটকের নিরীহ শিকার। তারা চেয়েছিলেন একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ, পেয়েছেন অনিশ্চয়তা আর ভয়। তারা চেয়েছিলেন ন্যায়বিচার, পেয়েছেন প্রতিহিংসা। তারা চেয়েছিলেন উন্নয়ন, পেয়েছেন ধ্বংস। সারা হোসেন, ডেভিড বার্গম্যান, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, কাজী রেহান হাসান – এই সব নামগুলো হয়তো ইতিহাসে থেকে যাবে। কিন্তু কী হিসেবে? মুক্তিদাতা হিসেবে? নাকি ধ্বংসকারী হিসেবে? সময়ই বলে দেবে। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতের ঘটনা একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছে যে ইতিহাসের রায় কী হতে পারে। যখন আতশবাজির শব্দে মানুষ বোমা ভেবে দৌড়ে পালায়, যখন একজন বাউল শিল্পীকে তার জীবনের জন্য দোয়া চাইতে হয়, যখন সংস্কৃতিকর্মীদের নিজেদের শিল্প চর্চা করতে ভয় পায়, তখন বুঝতে হবে যে দেশ একটা ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এই সংকটের সমাধান হতে পারে না আরও সন্ত্রাস, আরও দমন-পীড়ন দিয়ে। এর সমাধান হতে পারে কেবল গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আর মানবিক মূল্যবোধে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেই পথে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে কি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের? নাকি তারা ক্ষমতার মোহে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছেন যে তারা দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিতে থাকবেন? প্রশ্নটা খোলা রইলো। উত্তরটা সময় দেবে। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সেই রাতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা একটা জীবন্ত নাটক দেখে গেছেন। আর সেই নাটকের শিক্ষা হলো – যে আগুন নিজে জ্বালাবেন, সেই আগুনে নিজেই পুড়বেন। আলাদিনের জ্বীন কখনোই আলাদিনের বশে থাকে না। শেষ পর্যন্ত জ্বীনই হয়ে ওঠে প্রভু, আর আলাদিন হয়ে পড়ে ক্রীতদাস।



