
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর

ঈদুল আজহার শিক্ষা ও করণীয়

মানুষের প্রত্যাশা মোকাবিলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ

ইউনূসের অন্তবর্তীকালিন সরকার অসাংবিধানিক এবং অবৈধ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য, রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশ কি একটি মানবিক করিডোর সুবিধা দেবে?

প্রথাগত জনশক্তি রপ্তানি নাকি মানবসম্পদ রপ্তানিতে বিপ্লব: কোন পথে বাংলাদেশ?

নির্বাচনহীন দীর্ঘ সময় নয়, সংস্কার ও গণরায় হোক সমান্তরাল

শাস্তি বা পুরস্কারের প্রলোভন ছাড়াই সন্তানকে শাসনে রাখার ৭টি কৌশল
রাষ্ট্রনায়কের মুখোশে, কূটনীতিকের ভূমিকায় অভিনয়ে- ড. ইউনুস….

এক.
মানুষ যখন ক্ষুধার্ত, চরম অনিশ্চয়তা-আক্রান্ত ও অবহেলিত, কূটনীতিতে ত্যাক্ত হয়ে উঠতে পারে। গণভাবে ভিন্নমত দমনমূলক রাষ্ট্রীয় আচরণের অযৌক্তিকতা তাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলাও সম্ভব। শুধু ক্যারিশমা জনগণকে সবসময় বিমোহিত করে রাখবে, তা হয় না। অভূতপূর্ব চলমান জাতীয় সংকট-কালে বাংলাদেশের নাগরিকদের তাই প্রশ্ন করতে হচ্ছে: “ মুহাম্মদ ইউনুস, তার করদাতার অর্থে যখন তখন বিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে─যেমন ধরুন বর্তমান লন্ডন সফরের মাধমে, কী অর্জন করতে চাইছেন?
তার এ সফর কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক বা প্রতীকী সফর নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনুস বাস্তববাদী ব্যবসায়ী। প্রতীক তাকে খুব কমই টানে, যদি না নিরাপদ সরকারী বাসভবনের মোলায়েম সোফায় বসে টিভি-পর্দায় প্রতীকগুলো দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে দেখে তিনি আগ্রহে উদ্দীপ্ত
হয়ে ওঠেন। নোবেল পুরস্কার এবং মাইক্রোক্রেডিটের যে ঐতিহ্য কিছুদিন আগেও দেশ-বিদেশের শ্বেত পাথর খচিত-হলগুলোতে উদযাপিত হচ্ছিল, এখন সেসব তারই অনুমোদিত সন্ত্রাস প্রতিরোধের অক্ষম নিরবতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি যে জনগণের নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, সেই ১৭৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে তা ভূতের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নোবেল বিজয় এখন নোবেল হেঁয়ালিতে রূপ নিয়েছে! মুহাম্মাদ ইউনুসের এই যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তা তার নম্রকণ্ঠের অর্থহীন বাকচাতুর্য, তার পিআর টীমের প্রেস-বিজ্ঞপ্তি অথবা বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম জুড়ে নিজের ক্যারিশমা নির্মাণের তার চলমান অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। তিনি নীরবে বসেছিলেন তার জাতির শোণিত ও স্বপ্নে নির্মিত এক ঐতিহাসিক ভবনে। জুলাই মাস থেকে, এর ভিত্তি প্রস্তর তার অভিজ্ঞ চোখের সামনে
বারবার কেঁপে উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক উপপ্লব আগ্নেয়গিরির বিপুল ধূম্র উদগীরণ করে চলছে এখনও গোটা ব-দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে। তার সরকার গলা টিপে ধরায় নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এ সবের শতকরা একভাগও প্রকাশ করে নি বটে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের পর্দায় এই ধূম্রজালের ঝলকানি, মেঘের ঘনঘটা, বিদ্যুচ্চমকের ক্ষণিক আলোতে দেখা যাওয়ার কথা: বিশৃঙ্খলা, রক্ত, আর আগুন। দণ্ডিত জিহাদিদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। একশো আটত্রিশটি হিংস্র গ্যাং শহর ও নগরের সড়কগুলো দখল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইসলামিস্টদের রণধ্বনি “নারায়ে-তাকবির” ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে— যা শোনা গিয়েছিল মানবাধিকার কর্মী ও লেখকদের উপর হামলার সময়, শোনা গিয়েছিল তখন, যখন শতাধিক বোমা ব-দ্বীপরে শহর ও
বন্দরগুলো কাঁপিয়েছে বারংবার। এবং একই রণধ্বনি জনগণ শুনেছে সেই রাতে, যে রাতে হলি আর্টিসানে হামলা করে জিহাদীরা ২২ জন মানুষকে ধারালো তলোয়ারে জবাই করেছিল। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের মানুষ: ভারতীয় হিন্দু, জাপানী বৌদ্ধ, ইতালীয় খ্রীষ্টান, সাথে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী সেকুলার বাংলাদেশী বাঙ্গালী। এইসব ঘটনার পারম্পর্য ১৯৭১-সালের অবিকল একই। রণধ্বনি, তারপর উত্তরে শোনা যাওয়া নিপীড়িত নিরীহ বাঙ্গালীর রক্তস্রোতের কলকলধ্বনি, সন্ত্রস্ত মানুষের রোদনধ্বনি, তার বিপরীতে ইসলামিস্ট সহযোগীদের উদ্ধত কণ্ঠ, যারা পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে মিলে বাঙ্গালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে ছিল “শুধু মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্র”-এই ঘোর দুঃস্বপ্ন ও তার ধারণাকে রক্ষা করতে। এসবই তারা করেছে মুসলমানের তথাকথিত পবিত্র দেশ “পাকিস্তান” রক্ষার্থে। বাস্তবে এ ছিল
গুটিকয়েক ব্যক্তির রাজনীতি। দুই. ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সেই “নারায়ে-তাকবীর” স্লোগানটি পুনরায় জনসম্মুখে ফিরে আসে এবং একই ধরণের সন্ত্রাসে বাংলার জনপদ প্রকম্পিত হতে থাকে । তখন থেকে দৃশ্যমান বাস্তবতার ছবিগুলো দুঃস্বপ্নের মতো: কারখানাগুলো জ্বলছে, নাগরাজের মতো কালো ধোঁয়া বেয়ে উঠে শহর ও বন্দরের নীল আকাশ ঢেকে দিচ্ছে, এবং নিহত পুলিশ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃতদেহ ওভারব্রিজ, নির্মাণাধীন ভবন, গাছ বা অফিস কক্ষের ফ্যানে ঝুলে থাকছে। বিগত সনের আগস্টের একটি ভয়াবহ মোবাইল ভিডিওতে, জুলাইয়ের কোটা-বিরোধীরা—ইউনুসের সমর্থক ও তার কারিশমা-ভক্ত তরুণ ও মধ্যবয়ষ্কের সমন্বিত ছোট কয়েকটি দলের সদস্যবর্গ—মাটিতে পড়ে থাকা একটি দেহের চারপাশে নাচছিল।কয়েকজনের হাতে ধরা বাঁশের লাঠির মধ্যে লোহার টুকরা ঢুকানো। গোটা দশেক তরুণ বৃত্তাকারে দেহটি ঘিরে
আদিম কালের কোনও বলীদান প্রথার আদলে ঘুরে ঘুরে নাচের সাথে গাইছিল চট্টগ্রামের সাগরতীরের এক কিশোর গায়কের বহু আগে ভাইরাল হওয়া গান “মধু হৈ হৈ বিষ খাওয়াইলা…” নর্তকদের রিদমের তালে তালে বৃত্তের ভেতরের তিন চারজন মাটিতে পড়ে যাওয়া ছেলেটিকে পেটাচ্ছিল। বাঁশের লাঠি তারে ঊরুতে, পড়ছিল, হাঁটুতে পড়ার সাথে সাথে সেটা পুতুলের হাঁটুর মতো বেঁকে গেলাঁ, যেভাবে দেহটি কেঁপে উঠলো তাতে বোঝা গেল প্রাণটি হার মানতে তখনও তৈরী নয়। এক্রমে অচেনা তরুণের দেহ নিথর হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ আঘাত হানা চলতে থাকলো। যতক্ষণ প্রাণভিক্ষা চাইছিল একটি ফোন ক্যামেরা ঘটনার চলচ্চিত্র তুলছিল। এ নৃশংস ঘটনা ঘটে শান্তি পুরস্কার পাওয়া মুহাম্মাদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে,
যখন এই গ্যাংগুলোকে যে কোনও বর্বর হত্যাকাণ্ড করার অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়, তার পরে। সেই সময়ে মুহাম্মাদ ইউনুসের নির্মল হাসি মুখের ছবিতে গণমাধ্যম সয়লাব। গণমাধ্যম তিনি এড়িয়ে চলছিলেন। নিরবতার মধ্যে তার অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে থাকতো। বিগত দশ মাসের শাসনে, তিনি একবারও প্রকাশ্যে জনপরিসরে এ জাতীয় অসংখ্য হিংস্রতায় নিহতদের জন্য কোনোও শোক প্রকাশ করেননি। ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিময় ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্মিত জাদুঘর—একটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হওয়া স্বত্ত্বেও, আক্রমণের শিকার হয়। ১৯৭১ এর পর প্রথমবারের মতো বাড়িটি আক্রান্ত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্টে। তখন এ বাড়ির পরিবারটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। সে রাতেও বাড়িটি টিকে ছিল, শুধু যাদের সে বুকে ধরে রেখেছিল, সেই মানুষগুলো রক্তপাতের মধ্যে শব্দহীন শুয়ে ছিল। বাড়িতে না থাকার সুবাদে জাতির প্রবাদপ্রতীম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। ৫ আগস্ট ২০২৪ দ্বিতীয়বার যখন ৩২ নম্বর আক্রান্ত হয়, তখন গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন কি এর আশপাশের গাছের পাতা পর্যন্ত পুড়ে যায়। ইসলামিক রাষ্ট্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ক্যাডাররা ও ছাত্র-ছদ্মবেশী জিহাদীরা, সে রাতে তালিবানদের বিজয়োৎসবে গাওয়া আফগানী জেলেবির সুরে সুরে অবিকল তাদেরই ছন্দে হাতে অদৃশ্য রাইফেল আকাশে তুলে নেচেছিল গরু কোরবানী দিয়ে জেয়াফত খাওয়ার আগে। তৃতীয়বার ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি ৫ তারিখে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করতে তথাকথিত বৈষম্য-বিরোধী ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীর দল দু’টো বুলডোজার নিয়ে আসে এবং ছয় ঘন্টা এক টানা বাড়িটি ভাঙ্গার চেষ্টা করে যায়। এটি একটিমাত্র দৃষ্টান্ত। এমনতরো দৃষ্টান্ত শত শত রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কি করেছিল ইউনুসের সমর্থক সন্ত্রাসীরা? চৌদ্দ তারিখ থেকে তারা মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস শুরু করে: স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে হামলা করে ও জাতীয় জলবায়ু কর্মসূচীর সদর দফতর ভাঙচুর করে, মেট্রো রেল পুড়িয়ে দেয়—কোনো অনুশোচনা ছাড়াই। মুহাম্মাদ ইউনুসের দশ মাস শাসনকালে কয়েকটি জেনোসাইড মিউজিয়াম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই নিবন্ধটি লেখার সময়, ২০২৫ সালের ১০ জুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাদুঘরের উপর হামলার সংবাদ এসেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, অনেককে নির্যাতন করা হয়েছে, অন্যদের প্রকাশ্যে অপমান ও হেনস্তা করা হচ্ছে। রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত তথাকথিত “সংস্কার” কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিগুলোকে উন্নীত করা। সরকারী নীতিগুলো জামায়াতের আদর্শ ও নীতির পথ ধরে নিঃশব্দে সরকারী ইচ্ছায় সেকুলার সরকারের প্রশাসন ও নীতির স্থান দখল করেছে। জাতির ইতিহাসকে নতুন জাতীয়তার মন্ত্রের আলোকে পুনর্লিখন চলছে। যা নোঙর করবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদে নয়, থাকবে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পতাকায় খোদিত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লড়াই ও জিহাদের বিশ্বাসে। আঠারো শতক থেকে বিংশ শতকের আড়াইশো বছরের ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজন ও শাসন, ১৯০৫ এর ধর্মভিত্তিক বঙ্গভঙ্গ, এবং ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পুরণেঅ সিন্দাবাদের দৈত্য এখনো কাঁধে সওয়ার এই উপমহাদেশের। মাউন্টব্যাটনের অন্ধের মতো ম্যাপ দাগিয়ে দেশ চিরে ফেলা সেই কলমের কালি, মনে হয়, এখনো শুকায়নি। তালিকাটা দীর্ঘ, তবু না দেখালেই নয়। বাংলাদেশের বহুত্ববাদের রক্ষক—সুফি গায়কদের মাজার সব ধ্বংস করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর যা কিছু ধ্বংসাত্মক কার্ক্রম সব বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়-পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সন্ত্রাস বৈ আর কিছু নয়। ইন্ডেমনিটি এবং “নারায়ে-তাকবির” এর আওয়াজের আড়ালে জাতির অতীত, ইতিহাসকে, জাতির ৭৭ বছরের লড়াই, বাঁচার যুদ্ধ, তার উত্থানের সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের লক্ষ্যে লাগাতার প্রচারণা চালানো হয়েছে, যেমন প্রচারণা করে চলেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতীর ইতিহাস মুছে ফেলে এক একটি অদ্ভূত আখ্যানের উপযোগী করে সত্যকে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণকে নানাভাবে বাঁকিয়ে চুরিয়ে পরিবেশন চলছে। একই সাথে চলেছে সাক্ষীদের হত্যা। এক্ষেত্রে যা ঘটার কথা তাই ঘটছে। চলতি অর্থবছরে ২১ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে (বণিক বার্তা, ২০২৫)। জীবন, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল সামাজিক পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। লাখ লাখ পরিবার দারিদ্র্যের দিকে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল ক্ষয়ের মধ্যে মুহাম্মাদ ইউনুস একটি নীলনকশা রেখে গেছেন—কর্মের মাধ্যমে নয়, নীরবতার মাধ্যমে। আগের সরকারের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভের অজুহাত দিয়ে এই অপরিণামদর্শী সন্ত্রাসের ও ক্ষয়-ক্ষতির জবাবাদিহীতা থেকে পার পাওয়ার উপায় কোনও সরকারের থাকার কথা নয়। এমন নয় যে এসব ভুল করে ঘটেছে। এই ধ্বংস ছিল পূর্বপরিকল্পিত যা, মুহাম্মাদ ইউনুস বুঝিয়েছেন দুটো ইংরেজী শব্দে: “মেটিকুলাস ডিজাইন।” একই সাথে, সেই মেটিকুলাস ডিজাইন বা আণুপুঙ্ক্ষ্য নকশা কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর আবদ্ধ নয়, তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল হয়ে বিশ্বে। তিন. কূটনীতির মুখে যে হাসি দেখা দেয় তা কেবল উষ্ণ হলেই চলে না,সে হাসিতে এর চেয়ে বেশি কিছু থাকা কাম্য —তার মধ্যে থাকতে হবে সম্মান ও সততা। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস অফিস গত সপ্তাহ ভর রাজা চার্লস ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার এবং ব্রিটেনের এলিটদের সাথে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মধ্যে বৈঠকের কথা প্রচার করেছেন, বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বতঃই এ প্রশ্ন জেগেছে: ব্রিটেন কার বয়ানকে সম্মান দেখাতে চায়? ইউরোপের জানা প্রয়োজন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসনের অধীনে, আন্তর্জাতিক প্রশংসা শেষমেষ এক বা একাধিক মুখোশ হয়ে উঠতে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য সংস্থার রিপোর্টে গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং প্রেসের মুখ বন্ধ করার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসব তথ্য কোনো দলীয় অভিযোগ নয়, বরং নথিভুক্ত বাস্তবতা। সম্প্রতি মুহাম্মদ ইউনুস ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মহতী ভিশন উপহার দানের আদরে যা দিয়েছেন তা স্রেফ কিছু অস্পষ্ট আলাপচারিতা। অর্থনৈতিক সংকট সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সারাদেশে গণভাবে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার হয়েছে ৩ লক্ষ ৫৯ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা ও কর্মী। এক একজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা একাধিক, কারু কারু শত শত। ইসলামি রাষ্ট্র দাবীকারী দলগুলো ও তথাকথিত ছাত্রনামধারী বিপ্লবীদের দল জামাত-শিবির, হিযবুত তাহরীর ও তাদের রাজনৈতিক ইয়ার-দোস্ত বি এন পি সম্মিলিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরই মাঝে নির্বাচন দিতে অনিচ্ছুক ইউনুস বলেছেন নির্বাচন কমিশন “উপযুক্ত সময়ে” “রোড ম্যাপ” ঘোষণা করবে, যে রোডম্যাপ কমিশন নয় সরকারের দেয়ার কথা। কিন্তু দশ মাসে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জেলবন্দী অবস্থায় কোনও সূত্র না রেখে যারা আকস্মিকভাবে মারা যাচ্ছেন, তারা কেন মারা যাচ্ছেন তা জানতে সরকার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। তার কথিত “উপযুক্ত সময়” এখন পলিসীর কথা বলছে না। বরং এসব বাকচাতুর্যকে কূটনীতির আড়ালে লুকানো কোনও দীর্ঘমেয়াদী বিলম্বিত পরিকল্পনার মতো শোনাচ্ছে, যে বিষয়ে জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি করিডোরের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, মুহাম্মাদ ইউনুস তা “সম্পূর্ণ মিথ্যা” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০২৫)। ওদিকে ২৭ এপ্রিল, তার নিয়োগকৃত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘকে বলেছিলেন বাংলাদেশ “নীতিগতভাবে” একটি “মানবিক করিডোর” এর জন্য সম্মত হয়েছে। (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০২৫) “করিডোর” শব্দটি এড়িয়ে “চ্যানেল বলুন আর যাই বলুন” এ ধরণের বৈদেশিক নীতির প্রভাব জাতির ভবিষ্যতের ওপর না পড়ে পারে না। কূটনীতি বা বৈদেশিক নীতি কেবল শব্দের খেলা নয়। রাখাইনের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে: চীনের কিয়াওকফিউ বন্দর, তেল পাইপলাইন এবং রাশিয়ার প্রবেশ পথ এসবের কারণে। বিশ্ব শক্তিগুলো ইতিমধ্যে সেখানে কাজ করছে। তাদের নানা প্রবেশ পথ রয়েছে। এতকাল শন্তি ও সৌহার্দ্য এবং বন্ধুত্বের পথ ধরে ভারসাম্য রক্ষা করে চরা বাংলাদেশ কেন সেখানে হস্তক্ষেপ করবে? মুহাম্মাদ ইউনুসের জন্য, “মানবিক করিডোর বা প্যাসেজ” হয়তো একটি পদক্ষেপ—মানবিক সহায়তা প্রদান বিষয়ক নাটকের জন্য এক ধরণের মঞ্চ তৈরী করা, কিন্তু তার বক্তব্যের ভেতরে সারবস্তু কোথায়? চার. চীনের সাথে ইউনুস নিজেই সংযোগ গভীর করার চেষ্টা করেছেন এবং হাত মেলানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে বাণিজ্যের প্রত্যাশাও তার বেড়েছে, এবং চীনের ওপর নির্ভরতাও শক্ত হচ্ছে। একই কারণে পাকিস্তানের সাথে তার হাত মেলানো চলছে। তিনি চীনা সরবরাহ শৃঙ্খলের কথা বলেছেন, কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি, ভ্যাট বৃদ্ধি, এবং অত্যাবশ্যকীয় ভর্তুকি কাটার বিষয়ে হিরণ্ময় নীরবতা পালন করছেন। তিনি গণগ্রেপ্তার, হেফাজতে মৃত্যু, তালিকা করে হত্যা করা, প্রেস দমন, এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার পাশাপাশি রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে, বাড়ির বাগানে বা বাঁশের খুঁটিতে ঝুলন্ত নির্যঙাতনের শিকার হয়ে প্রাণত্যাগ করা তারই দেশের মানুষদের, তাদের শেষ মুহূর্তের সেই সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য উপেক্ষা করে চলেছেন। এ বিষয়ে কোনও দায় বোধ তিনি প্রকাশ করেন নি। তার এসব শিকারদের পরিসংখ্যান অগণ্য। তারা কেউ ছিল আওয়ামী লীগের নেতা, বা সদস্য অথবা সমর্থক; কেউ ছিল ছাত্রলীগের কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং হিন্দু বা মুসলমান। এই সব মৃতদেহের বা নির্যাতিতদের মধ্যে পুরুষ, মহিলা, কিশোর, তরুণ ও শিশু সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম-আয়ের দেশরূপে মর্যাদার জন্য প্রচেষ্টারত ছিল এমন এক বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে এই পরিমাণ দুর্যোগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধকালে, যে ব্যক্তি সুবর্ণ নীরবতার ভার জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেন, সে মানুষটি আর যাই হোক জনগণের সালাম আশা করতে পারেন না। মুহাম্মাদ ইউনুসের যাবতীয় কূটনীতিকে অভিনয় হিসেবে পাঠ করা চলে,নীতি হিসেবে নয়। নির্বাচিত বিষয়ে সাজিয়ে তিনি তার বয়ানকে উপস্থাপন করে বিশ্বের প্রশংসাবাণীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, কিন্তু সুকৌশলে জবাবদিহিতা এড়িয়ে যান। এই হল তার অভিনীত রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার সারবস্তু—”সেবা” প্রদানের পরিবর্তে ”দর্শন-সুখ” দিয়ে মজিয়ে রাখার নেতৃত্ব। তার “কূট নীতি” জাতীয় আস্থা, বাংলাদেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যের তন্তুগুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বালিয়ে দেয়, অস্পষ্ট করে রাখে তার স্বীয় ভুমিকা। একটি স্বাধীন দেশের জনজাতির গণের যাবতীয় মৌলিক অধিকারের প্রতি এত তীব্র অবহেলার দাগ রেখে দিয়েছে যে তা সহজে ইতিহাস থেকে মোছার নয়। কোনো আন্তর্জাতিক প্রশংসাই কিন্তু গণমানুষের আস্থার স্থান দখল করতে সমর্থ নয়। গণতন্ত্র বিনা কূটনীতি সির্ফ নাটক মাত্র, এবং তার নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে যে দেশে সেই বাংলাদেশের হৃদয়-মঞ্চ জ্বলছে। এ আগুন যেন বাংলার সমভূমি ও পাহাড়ের রঙে রঞ্জিত, জমি ও নদী, কণ্ঠ ও স্মৃতিতে শিকড়বদ্ধ রঙিলা মানুষদের গ্রাস না করে! পশ্চিম, বিশেষ করে ইউরোপ, বন্ধু হিসেবে কার উপর নির্ভর করতে পারে তা ভাবতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের অটল স্থির, বৈচিত্র্যময়, স্থিতিস্থাপক এবং ধর্মনিরপেক্ষ আত্মার ওপর—নাকি একজন ব্যক্তির ক্ষণস্থায়ী ক্যারিশমার উপর, যা বহুত্ববাদী বাংলার কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখছে? ইউরোপ যদি তার সব শুভ মূল্যবোধ নিয়ে যদি মিত্রতাই চায়, তবে তাকে মঞ্চের বাইরে, দর্শনের বাইরে শুনতে হবে এবং বাংলাদেশের বহুসাংস্কৃতিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক আত্মার হৃদস্পন্দন বহনকারীদের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। বাংলার মানুষ পৃথিবীর মহতী জাতিগুলোর মতোই স্বদেশের জন্য এমনকি পোড়া ছাই থেকেও জীবনের গান গেয়ে উঠতে পারে—যদি তার সত্য ফিরে আসে এবং ন্যায়বোধ তার ভূঁইয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাস এখনও ছাই হয়ে যায়নি। এখনও তা বাংলার জনগণের স্থিতিস্থাপকতায়, দূর্গম পথ পাড়ি দেবার অদম্য শক্তিতে খোদিত, তাদের সমভূমি ও পাহাড়ের রঙে আঁকা,তাদের নদ-নদীর শিরায় এবং প্রাচীন মহা-সমুদ্রের গানের ঢেউয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশের জনগণ ইউরোপকে সন্ত্রাস ও প্রতিশোধের সোদর ভাইয়ের পাশে নয়, বরং গণের বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, শান্তি ও ভারসাম্যের পাশে দাঁড়াতেই আহ্বান জানাচ্ছে। যদিও এই ভূমির জনগণ আজ বিদীর্ণ-হৃদয়, উদ্বিগ্ন, ভয় ও অবিশ্বাস প্রকাশে শব্দ হাতড়ে বেড়াচ্ছে, হতাশায় ভারাক্রান্ত। তথাপি, যে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মূলে আঘাত করছে মুহাম্মাদ ইউনুসকে মসনদে বসানো ধর্মবিষে জারিত কিছু বিভ্রান্ত মানুষ, সেই ইতিহাস, সংস্কৃতিতে, সঙ্গীতে ও কবিতাতেই বাংলার মানুষ ফিরবে বারবার এই প্রার্থনা নিয়ে: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়– যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,” (প্রার্থনা, ১৯০১, নৈবেদ্য) হে বিশ্বপিতা, আমাদের স্বদেশ সেই স্বাধীনতার স্বর্গে জাগ্রত হোক। লেখক পরিচিতিঃ সাংবাদিক, লেখক, গণমাধ্যমকর্মী
হয়ে ওঠেন। নোবেল পুরস্কার এবং মাইক্রোক্রেডিটের যে ঐতিহ্য কিছুদিন আগেও দেশ-বিদেশের শ্বেত পাথর খচিত-হলগুলোতে উদযাপিত হচ্ছিল, এখন সেসব তারই অনুমোদিত সন্ত্রাস প্রতিরোধের অক্ষম নিরবতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি যে জনগণের নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, সেই ১৭৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে তা ভূতের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নোবেল বিজয় এখন নোবেল হেঁয়ালিতে রূপ নিয়েছে! মুহাম্মাদ ইউনুসের এই যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তা তার নম্রকণ্ঠের অর্থহীন বাকচাতুর্য, তার পিআর টীমের প্রেস-বিজ্ঞপ্তি অথবা বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম জুড়ে নিজের ক্যারিশমা নির্মাণের তার চলমান অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। তিনি নীরবে বসেছিলেন তার জাতির শোণিত ও স্বপ্নে নির্মিত এক ঐতিহাসিক ভবনে। জুলাই মাস থেকে, এর ভিত্তি প্রস্তর তার অভিজ্ঞ চোখের সামনে
বারবার কেঁপে উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক উপপ্লব আগ্নেয়গিরির বিপুল ধূম্র উদগীরণ করে চলছে এখনও গোটা ব-দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে। তার সরকার গলা টিপে ধরায় নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এ সবের শতকরা একভাগও প্রকাশ করে নি বটে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের পর্দায় এই ধূম্রজালের ঝলকানি, মেঘের ঘনঘটা, বিদ্যুচ্চমকের ক্ষণিক আলোতে দেখা যাওয়ার কথা: বিশৃঙ্খলা, রক্ত, আর আগুন। দণ্ডিত জিহাদিদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। একশো আটত্রিশটি হিংস্র গ্যাং শহর ও নগরের সড়কগুলো দখল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইসলামিস্টদের রণধ্বনি “নারায়ে-তাকবির” ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে— যা শোনা গিয়েছিল মানবাধিকার কর্মী ও লেখকদের উপর হামলার সময়, শোনা গিয়েছিল তখন, যখন শতাধিক বোমা ব-দ্বীপরে শহর ও
বন্দরগুলো কাঁপিয়েছে বারংবার। এবং একই রণধ্বনি জনগণ শুনেছে সেই রাতে, যে রাতে হলি আর্টিসানে হামলা করে জিহাদীরা ২২ জন মানুষকে ধারালো তলোয়ারে জবাই করেছিল। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের মানুষ: ভারতীয় হিন্দু, জাপানী বৌদ্ধ, ইতালীয় খ্রীষ্টান, সাথে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী সেকুলার বাংলাদেশী বাঙ্গালী। এইসব ঘটনার পারম্পর্য ১৯৭১-সালের অবিকল একই। রণধ্বনি, তারপর উত্তরে শোনা যাওয়া নিপীড়িত নিরীহ বাঙ্গালীর রক্তস্রোতের কলকলধ্বনি, সন্ত্রস্ত মানুষের রোদনধ্বনি, তার বিপরীতে ইসলামিস্ট সহযোগীদের উদ্ধত কণ্ঠ, যারা পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে মিলে বাঙ্গালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে ছিল “শুধু মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্র”-এই ঘোর দুঃস্বপ্ন ও তার ধারণাকে রক্ষা করতে। এসবই তারা করেছে মুসলমানের তথাকথিত পবিত্র দেশ “পাকিস্তান” রক্ষার্থে। বাস্তবে এ ছিল
গুটিকয়েক ব্যক্তির রাজনীতি। দুই. ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সেই “নারায়ে-তাকবীর” স্লোগানটি পুনরায় জনসম্মুখে ফিরে আসে এবং একই ধরণের সন্ত্রাসে বাংলার জনপদ প্রকম্পিত হতে থাকে । তখন থেকে দৃশ্যমান বাস্তবতার ছবিগুলো দুঃস্বপ্নের মতো: কারখানাগুলো জ্বলছে, নাগরাজের মতো কালো ধোঁয়া বেয়ে উঠে শহর ও বন্দরের নীল আকাশ ঢেকে দিচ্ছে, এবং নিহত পুলিশ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃতদেহ ওভারব্রিজ, নির্মাণাধীন ভবন, গাছ বা অফিস কক্ষের ফ্যানে ঝুলে থাকছে। বিগত সনের আগস্টের একটি ভয়াবহ মোবাইল ভিডিওতে, জুলাইয়ের কোটা-বিরোধীরা—ইউনুসের সমর্থক ও তার কারিশমা-ভক্ত তরুণ ও মধ্যবয়ষ্কের সমন্বিত ছোট কয়েকটি দলের সদস্যবর্গ—মাটিতে পড়ে থাকা একটি দেহের চারপাশে নাচছিল।কয়েকজনের হাতে ধরা বাঁশের লাঠির মধ্যে লোহার টুকরা ঢুকানো। গোটা দশেক তরুণ বৃত্তাকারে দেহটি ঘিরে
আদিম কালের কোনও বলীদান প্রথার আদলে ঘুরে ঘুরে নাচের সাথে গাইছিল চট্টগ্রামের সাগরতীরের এক কিশোর গায়কের বহু আগে ভাইরাল হওয়া গান “মধু হৈ হৈ বিষ খাওয়াইলা…” নর্তকদের রিদমের তালে তালে বৃত্তের ভেতরের তিন চারজন মাটিতে পড়ে যাওয়া ছেলেটিকে পেটাচ্ছিল। বাঁশের লাঠি তারে ঊরুতে, পড়ছিল, হাঁটুতে পড়ার সাথে সাথে সেটা পুতুলের হাঁটুর মতো বেঁকে গেলাঁ, যেভাবে দেহটি কেঁপে উঠলো তাতে বোঝা গেল প্রাণটি হার মানতে তখনও তৈরী নয়। এক্রমে অচেনা তরুণের দেহ নিথর হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ আঘাত হানা চলতে থাকলো। যতক্ষণ প্রাণভিক্ষা চাইছিল একটি ফোন ক্যামেরা ঘটনার চলচ্চিত্র তুলছিল। এ নৃশংস ঘটনা ঘটে শান্তি পুরস্কার পাওয়া মুহাম্মাদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে,
যখন এই গ্যাংগুলোকে যে কোনও বর্বর হত্যাকাণ্ড করার অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়, তার পরে। সেই সময়ে মুহাম্মাদ ইউনুসের নির্মল হাসি মুখের ছবিতে গণমাধ্যম সয়লাব। গণমাধ্যম তিনি এড়িয়ে চলছিলেন। নিরবতার মধ্যে তার অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে থাকতো। বিগত দশ মাসের শাসনে, তিনি একবারও প্রকাশ্যে জনপরিসরে এ জাতীয় অসংখ্য হিংস্রতায় নিহতদের জন্য কোনোও শোক প্রকাশ করেননি। ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিময় ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্মিত জাদুঘর—একটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হওয়া স্বত্ত্বেও, আক্রমণের শিকার হয়। ১৯৭১ এর পর প্রথমবারের মতো বাড়িটি আক্রান্ত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্টে। তখন এ বাড়ির পরিবারটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। সে রাতেও বাড়িটি টিকে ছিল, শুধু যাদের সে বুকে ধরে রেখেছিল, সেই মানুষগুলো রক্তপাতের মধ্যে শব্দহীন শুয়ে ছিল। বাড়িতে না থাকার সুবাদে জাতির প্রবাদপ্রতীম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। ৫ আগস্ট ২০২৪ দ্বিতীয়বার যখন ৩২ নম্বর আক্রান্ত হয়, তখন গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন কি এর আশপাশের গাছের পাতা পর্যন্ত পুড়ে যায়। ইসলামিক রাষ্ট্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ক্যাডাররা ও ছাত্র-ছদ্মবেশী জিহাদীরা, সে রাতে তালিবানদের বিজয়োৎসবে গাওয়া আফগানী জেলেবির সুরে সুরে অবিকল তাদেরই ছন্দে হাতে অদৃশ্য রাইফেল আকাশে তুলে নেচেছিল গরু কোরবানী দিয়ে জেয়াফত খাওয়ার আগে। তৃতীয়বার ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি ৫ তারিখে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করতে তথাকথিত বৈষম্য-বিরোধী ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীর দল দু’টো বুলডোজার নিয়ে আসে এবং ছয় ঘন্টা এক টানা বাড়িটি ভাঙ্গার চেষ্টা করে যায়। এটি একটিমাত্র দৃষ্টান্ত। এমনতরো দৃষ্টান্ত শত শত রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কি করেছিল ইউনুসের সমর্থক সন্ত্রাসীরা? চৌদ্দ তারিখ থেকে তারা মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস শুরু করে: স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে হামলা করে ও জাতীয় জলবায়ু কর্মসূচীর সদর দফতর ভাঙচুর করে, মেট্রো রেল পুড়িয়ে দেয়—কোনো অনুশোচনা ছাড়াই। মুহাম্মাদ ইউনুসের দশ মাস শাসনকালে কয়েকটি জেনোসাইড মিউজিয়াম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই নিবন্ধটি লেখার সময়, ২০২৫ সালের ১০ জুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাদুঘরের উপর হামলার সংবাদ এসেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, অনেককে নির্যাতন করা হয়েছে, অন্যদের প্রকাশ্যে অপমান ও হেনস্তা করা হচ্ছে। রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত তথাকথিত “সংস্কার” কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিগুলোকে উন্নীত করা। সরকারী নীতিগুলো জামায়াতের আদর্শ ও নীতির পথ ধরে নিঃশব্দে সরকারী ইচ্ছায় সেকুলার সরকারের প্রশাসন ও নীতির স্থান দখল করেছে। জাতির ইতিহাসকে নতুন জাতীয়তার মন্ত্রের আলোকে পুনর্লিখন চলছে। যা নোঙর করবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদে নয়, থাকবে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পতাকায় খোদিত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লড়াই ও জিহাদের বিশ্বাসে। আঠারো শতক থেকে বিংশ শতকের আড়াইশো বছরের ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজন ও শাসন, ১৯০৫ এর ধর্মভিত্তিক বঙ্গভঙ্গ, এবং ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পুরণেঅ সিন্দাবাদের দৈত্য এখনো কাঁধে সওয়ার এই উপমহাদেশের। মাউন্টব্যাটনের অন্ধের মতো ম্যাপ দাগিয়ে দেশ চিরে ফেলা সেই কলমের কালি, মনে হয়, এখনো শুকায়নি। তালিকাটা দীর্ঘ, তবু না দেখালেই নয়। বাংলাদেশের বহুত্ববাদের রক্ষক—সুফি গায়কদের মাজার সব ধ্বংস করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর যা কিছু ধ্বংসাত্মক কার্ক্রম সব বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়-পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সন্ত্রাস বৈ আর কিছু নয়। ইন্ডেমনিটি এবং “নারায়ে-তাকবির” এর আওয়াজের আড়ালে জাতির অতীত, ইতিহাসকে, জাতির ৭৭ বছরের লড়াই, বাঁচার যুদ্ধ, তার উত্থানের সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের লক্ষ্যে লাগাতার প্রচারণা চালানো হয়েছে, যেমন প্রচারণা করে চলেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতীর ইতিহাস মুছে ফেলে এক একটি অদ্ভূত আখ্যানের উপযোগী করে সত্যকে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণকে নানাভাবে বাঁকিয়ে চুরিয়ে পরিবেশন চলছে। একই সাথে চলেছে সাক্ষীদের হত্যা। এক্ষেত্রে যা ঘটার কথা তাই ঘটছে। চলতি অর্থবছরে ২১ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে (বণিক বার্তা, ২০২৫)। জীবন, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল সামাজিক পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। লাখ লাখ পরিবার দারিদ্র্যের দিকে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল ক্ষয়ের মধ্যে মুহাম্মাদ ইউনুস একটি নীলনকশা রেখে গেছেন—কর্মের মাধ্যমে নয়, নীরবতার মাধ্যমে। আগের সরকারের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভের অজুহাত দিয়ে এই অপরিণামদর্শী সন্ত্রাসের ও ক্ষয়-ক্ষতির জবাবাদিহীতা থেকে পার পাওয়ার উপায় কোনও সরকারের থাকার কথা নয়। এমন নয় যে এসব ভুল করে ঘটেছে। এই ধ্বংস ছিল পূর্বপরিকল্পিত যা, মুহাম্মাদ ইউনুস বুঝিয়েছেন দুটো ইংরেজী শব্দে: “মেটিকুলাস ডিজাইন।” একই সাথে, সেই মেটিকুলাস ডিজাইন বা আণুপুঙ্ক্ষ্য নকশা কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর আবদ্ধ নয়, তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল হয়ে বিশ্বে। তিন. কূটনীতির মুখে যে হাসি দেখা দেয় তা কেবল উষ্ণ হলেই চলে না,সে হাসিতে এর চেয়ে বেশি কিছু থাকা কাম্য —তার মধ্যে থাকতে হবে সম্মান ও সততা। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস অফিস গত সপ্তাহ ভর রাজা চার্লস ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার এবং ব্রিটেনের এলিটদের সাথে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মধ্যে বৈঠকের কথা প্রচার করেছেন, বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বতঃই এ প্রশ্ন জেগেছে: ব্রিটেন কার বয়ানকে সম্মান দেখাতে চায়? ইউরোপের জানা প্রয়োজন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসনের অধীনে, আন্তর্জাতিক প্রশংসা শেষমেষ এক বা একাধিক মুখোশ হয়ে উঠতে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য সংস্থার রিপোর্টে গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং প্রেসের মুখ বন্ধ করার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসব তথ্য কোনো দলীয় অভিযোগ নয়, বরং নথিভুক্ত বাস্তবতা। সম্প্রতি মুহাম্মদ ইউনুস ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মহতী ভিশন উপহার দানের আদরে যা দিয়েছেন তা স্রেফ কিছু অস্পষ্ট আলাপচারিতা। অর্থনৈতিক সংকট সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সারাদেশে গণভাবে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার হয়েছে ৩ লক্ষ ৫৯ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা ও কর্মী। এক একজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা একাধিক, কারু কারু শত শত। ইসলামি রাষ্ট্র দাবীকারী দলগুলো ও তথাকথিত ছাত্রনামধারী বিপ্লবীদের দল জামাত-শিবির, হিযবুত তাহরীর ও তাদের রাজনৈতিক ইয়ার-দোস্ত বি এন পি সম্মিলিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরই মাঝে নির্বাচন দিতে অনিচ্ছুক ইউনুস বলেছেন নির্বাচন কমিশন “উপযুক্ত সময়ে” “রোড ম্যাপ” ঘোষণা করবে, যে রোডম্যাপ কমিশন নয় সরকারের দেয়ার কথা। কিন্তু দশ মাসে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জেলবন্দী অবস্থায় কোনও সূত্র না রেখে যারা আকস্মিকভাবে মারা যাচ্ছেন, তারা কেন মারা যাচ্ছেন তা জানতে সরকার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। তার কথিত “উপযুক্ত সময়” এখন পলিসীর কথা বলছে না। বরং এসব বাকচাতুর্যকে কূটনীতির আড়ালে লুকানো কোনও দীর্ঘমেয়াদী বিলম্বিত পরিকল্পনার মতো শোনাচ্ছে, যে বিষয়ে জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি করিডোরের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, মুহাম্মাদ ইউনুস তা “সম্পূর্ণ মিথ্যা” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০২৫)। ওদিকে ২৭ এপ্রিল, তার নিয়োগকৃত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘকে বলেছিলেন বাংলাদেশ “নীতিগতভাবে” একটি “মানবিক করিডোর” এর জন্য সম্মত হয়েছে। (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০২৫) “করিডোর” শব্দটি এড়িয়ে “চ্যানেল বলুন আর যাই বলুন” এ ধরণের বৈদেশিক নীতির প্রভাব জাতির ভবিষ্যতের ওপর না পড়ে পারে না। কূটনীতি বা বৈদেশিক নীতি কেবল শব্দের খেলা নয়। রাখাইনের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে: চীনের কিয়াওকফিউ বন্দর, তেল পাইপলাইন এবং রাশিয়ার প্রবেশ পথ এসবের কারণে। বিশ্ব শক্তিগুলো ইতিমধ্যে সেখানে কাজ করছে। তাদের নানা প্রবেশ পথ রয়েছে। এতকাল শন্তি ও সৌহার্দ্য এবং বন্ধুত্বের পথ ধরে ভারসাম্য রক্ষা করে চরা বাংলাদেশ কেন সেখানে হস্তক্ষেপ করবে? মুহাম্মাদ ইউনুসের জন্য, “মানবিক করিডোর বা প্যাসেজ” হয়তো একটি পদক্ষেপ—মানবিক সহায়তা প্রদান বিষয়ক নাটকের জন্য এক ধরণের মঞ্চ তৈরী করা, কিন্তু তার বক্তব্যের ভেতরে সারবস্তু কোথায়? চার. চীনের সাথে ইউনুস নিজেই সংযোগ গভীর করার চেষ্টা করেছেন এবং হাত মেলানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে বাণিজ্যের প্রত্যাশাও তার বেড়েছে, এবং চীনের ওপর নির্ভরতাও শক্ত হচ্ছে। একই কারণে পাকিস্তানের সাথে তার হাত মেলানো চলছে। তিনি চীনা সরবরাহ শৃঙ্খলের কথা বলেছেন, কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি, ভ্যাট বৃদ্ধি, এবং অত্যাবশ্যকীয় ভর্তুকি কাটার বিষয়ে হিরণ্ময় নীরবতা পালন করছেন। তিনি গণগ্রেপ্তার, হেফাজতে মৃত্যু, তালিকা করে হত্যা করা, প্রেস দমন, এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার পাশাপাশি রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে, বাড়ির বাগানে বা বাঁশের খুঁটিতে ঝুলন্ত নির্যঙাতনের শিকার হয়ে প্রাণত্যাগ করা তারই দেশের মানুষদের, তাদের শেষ মুহূর্তের সেই সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য উপেক্ষা করে চলেছেন। এ বিষয়ে কোনও দায় বোধ তিনি প্রকাশ করেন নি। তার এসব শিকারদের পরিসংখ্যান অগণ্য। তারা কেউ ছিল আওয়ামী লীগের নেতা, বা সদস্য অথবা সমর্থক; কেউ ছিল ছাত্রলীগের কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং হিন্দু বা মুসলমান। এই সব মৃতদেহের বা নির্যাতিতদের মধ্যে পুরুষ, মহিলা, কিশোর, তরুণ ও শিশু সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম-আয়ের দেশরূপে মর্যাদার জন্য প্রচেষ্টারত ছিল এমন এক বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে এই পরিমাণ দুর্যোগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধকালে, যে ব্যক্তি সুবর্ণ নীরবতার ভার জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেন, সে মানুষটি আর যাই হোক জনগণের সালাম আশা করতে পারেন না। মুহাম্মাদ ইউনুসের যাবতীয় কূটনীতিকে অভিনয় হিসেবে পাঠ করা চলে,নীতি হিসেবে নয়। নির্বাচিত বিষয়ে সাজিয়ে তিনি তার বয়ানকে উপস্থাপন করে বিশ্বের প্রশংসাবাণীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, কিন্তু সুকৌশলে জবাবদিহিতা এড়িয়ে যান। এই হল তার অভিনীত রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার সারবস্তু—”সেবা” প্রদানের পরিবর্তে ”দর্শন-সুখ” দিয়ে মজিয়ে রাখার নেতৃত্ব। তার “কূট নীতি” জাতীয় আস্থা, বাংলাদেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যের তন্তুগুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বালিয়ে দেয়, অস্পষ্ট করে রাখে তার স্বীয় ভুমিকা। একটি স্বাধীন দেশের জনজাতির গণের যাবতীয় মৌলিক অধিকারের প্রতি এত তীব্র অবহেলার দাগ রেখে দিয়েছে যে তা সহজে ইতিহাস থেকে মোছার নয়। কোনো আন্তর্জাতিক প্রশংসাই কিন্তু গণমানুষের আস্থার স্থান দখল করতে সমর্থ নয়। গণতন্ত্র বিনা কূটনীতি সির্ফ নাটক মাত্র, এবং তার নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে যে দেশে সেই বাংলাদেশের হৃদয়-মঞ্চ জ্বলছে। এ আগুন যেন বাংলার সমভূমি ও পাহাড়ের রঙে রঞ্জিত, জমি ও নদী, কণ্ঠ ও স্মৃতিতে শিকড়বদ্ধ রঙিলা মানুষদের গ্রাস না করে! পশ্চিম, বিশেষ করে ইউরোপ, বন্ধু হিসেবে কার উপর নির্ভর করতে পারে তা ভাবতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের অটল স্থির, বৈচিত্র্যময়, স্থিতিস্থাপক এবং ধর্মনিরপেক্ষ আত্মার ওপর—নাকি একজন ব্যক্তির ক্ষণস্থায়ী ক্যারিশমার উপর, যা বহুত্ববাদী বাংলার কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখছে? ইউরোপ যদি তার সব শুভ মূল্যবোধ নিয়ে যদি মিত্রতাই চায়, তবে তাকে মঞ্চের বাইরে, দর্শনের বাইরে শুনতে হবে এবং বাংলাদেশের বহুসাংস্কৃতিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক আত্মার হৃদস্পন্দন বহনকারীদের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। বাংলার মানুষ পৃথিবীর মহতী জাতিগুলোর মতোই স্বদেশের জন্য এমনকি পোড়া ছাই থেকেও জীবনের গান গেয়ে উঠতে পারে—যদি তার সত্য ফিরে আসে এবং ন্যায়বোধ তার ভূঁইয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাস এখনও ছাই হয়ে যায়নি। এখনও তা বাংলার জনগণের স্থিতিস্থাপকতায়, দূর্গম পথ পাড়ি দেবার অদম্য শক্তিতে খোদিত, তাদের সমভূমি ও পাহাড়ের রঙে আঁকা,তাদের নদ-নদীর শিরায় এবং প্রাচীন মহা-সমুদ্রের গানের ঢেউয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশের জনগণ ইউরোপকে সন্ত্রাস ও প্রতিশোধের সোদর ভাইয়ের পাশে নয়, বরং গণের বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, শান্তি ও ভারসাম্যের পাশে দাঁড়াতেই আহ্বান জানাচ্ছে। যদিও এই ভূমির জনগণ আজ বিদীর্ণ-হৃদয়, উদ্বিগ্ন, ভয় ও অবিশ্বাস প্রকাশে শব্দ হাতড়ে বেড়াচ্ছে, হতাশায় ভারাক্রান্ত। তথাপি, যে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মূলে আঘাত করছে মুহাম্মাদ ইউনুসকে মসনদে বসানো ধর্মবিষে জারিত কিছু বিভ্রান্ত মানুষ, সেই ইতিহাস, সংস্কৃতিতে, সঙ্গীতে ও কবিতাতেই বাংলার মানুষ ফিরবে বারবার এই প্রার্থনা নিয়ে: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়– যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,” (প্রার্থনা, ১৯০১, নৈবেদ্য) হে বিশ্বপিতা, আমাদের স্বদেশ সেই স্বাধীনতার স্বর্গে জাগ্রত হোক। লেখক পরিচিতিঃ সাংবাদিক, লেখক, গণমাধ্যমকর্মী