বর্বরতার ‘উৎসবে’ ঝরছে তাজা প্রাণ
মব জাস্টিস (উচ্ছৃল জনতার বিচার) বা গণপিটুনির মতো ভয়ংকর আক্রমণ যেন উৎসবে রূপ নিয়েছে। নানা অপবাদ দিয়ে লোকজন জমায়েত হয়ে পিটিয়ে মারছে মানুষকে। এতে ঝরছে বহু তাজা প্রাণ। দেশের পরবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এর আগের ৭ (জানুয়ারি-জুলাই) মাসে ৩৩ জন নিহত হন গণপিটুনিতে। বুধবার রাতে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় শুক্রবার পুলিশ সদর দপ্তর এক বার্তায় কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক
অস্থিরতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণেই ‘মব কালচার’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে এমন অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা বেড়েছে। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে মোবাইল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোচনার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলে। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করেন কিছু শিক্ষার্থী। এছাড়া ১০ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে এক আইনজীবীকে, ৪ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে একজনকে, ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ে এক বিএনপি নেতাকে, ৪ সেপ্টেম্বর খুলনার
খানজাহান আলী এলাকায় একজনকে, ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে, ১১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞাত এক যুবককে, ১৪ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের রাজৈরে একজনকে, ১৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুরে একজনকে, ৮ আগস্ট বগুড়ার ধুনটে এক যুবলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া ১৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে দুই মাদ্রাসাছাত্রসহ তিনজনকে, ১৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর হাশেম রোডে একজনকে, ৬ আগস্ট টঙ্গীতে এক যুবলীগ নেতাকে, ১৩ আগস্ট ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই যুবককে, ১৫ আগস্ট বরিশাল নগরীর চৌমাথায় এক টিউবওয়েল মিস্ত্রিকে এবং ১৭ আগস্ট বরিশালের উজিরপুরে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের কাউকে চোর সন্দেহে, কাউকে স্বৈরাচারের দোসর সন্দেহে আবার কারও প্রতি ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে গণপিটুনি দিয়ে
হত্যা করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত হন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ৫১ জন। আর জানুয়ারি-জুলাই ৭ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৩ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ১৬, খুলনায় ২, রাজশাহীতে ৭, সিলেটে ১, চট্টগ্রামে ৩, বরিশালে ১ ও ময়মনসিংহে ৩ জন নিহত হন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতার করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মব জাস্টিস পরিস্থিতির বিষয়ে ছাত্রদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রশাসনকে প্রশাসনের মতো কাজ করতে দিতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি
অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনের শাসনের ব্যর্থতার কারণে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির মতো অপরাধ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি চলমান পরিস্থিতিকে পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলছে। অন্যদিকে উল্লেখ করা যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বাড়ছে মব জাস্টিস। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মব জাস্টিস বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মব জাস্টিস থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জনগণকে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ইতঃপূর্বে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পুলিশকে আরও তৎপর করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, এই
ধরনের একটা ঘটনাও ঘটা উচিত না। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি সরকারের কঠিন বার্তা দেওয়া দরকার। কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া মব জাস্টিস রোখা যাবে না। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্তেজনা ছড়ায়। কখনও চোর, কখনও স্বৈরাচারের দোসর এমন নানা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। অনেক সময় নিরপরাধ মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হয়ে মারা যান। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের সংবিধান, আইন কোথাও এর স্বীকৃত কোনো পন্থা নেই। যদিও আমরা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি, তবুও যেভাবেই হোক সরকারকে মব জাস্টিস রুখতে পদক্ষেপ নিতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর পরিস্থিতি, আইনের শাসনের অভাব আর বিচার
ব্যবস্থায় নানা দুর্বলতায় কারণেই ঘটছে একের পর এক মব জাস্টিস। শুধু তাই নয়, মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি এবং মনোজগতে এক ধরনের সহিংসতার প্রতিফলনের কারণেও ঘটছে এসব ঘটনা। আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে সামান্য আঘাতও করা হয় তাহলে ৩১৯ ধারায় অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। আর এ অপরাধের জন্য অপরাধীকে ৩২৩ ধারায় ১ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। যদি পিটুনি দেওয়া হয় তবে কারাদণ্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব ৩ বছর এক মাসে। সেইসঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা হয় তবে ৩২৫ ধারার অধীনে ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। এছাড়া দণ্ডবিধির ৩৩৫ ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারেন আঘাতকারীরা। হামলা চালানোর ফলে ব্যক্তির মৃত্যু হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের সাজা দেওয়া যায়। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। গণপিটুনিতে ওই ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া সব ব্যক্তি সমানভাবে এজন্য দায়ী হবে। কেননা আইনে ‘যৌথ দায়িত্বশীলতা’ বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। এর মানে গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড় ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন। এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যান আর সেটা যদি খুন হিসাবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়। সে হিসাবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।
অস্থিরতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণেই ‘মব কালচার’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে এমন অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা বেড়েছে। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে মোবাইল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোচনার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলে। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করেন কিছু শিক্ষার্থী। এছাড়া ১০ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে এক আইনজীবীকে, ৪ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে একজনকে, ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ে এক বিএনপি নেতাকে, ৪ সেপ্টেম্বর খুলনার
খানজাহান আলী এলাকায় একজনকে, ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে, ১১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞাত এক যুবককে, ১৪ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের রাজৈরে একজনকে, ১৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুরে একজনকে, ৮ আগস্ট বগুড়ার ধুনটে এক যুবলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া ১৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে দুই মাদ্রাসাছাত্রসহ তিনজনকে, ১৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর হাশেম রোডে একজনকে, ৬ আগস্ট টঙ্গীতে এক যুবলীগ নেতাকে, ১৩ আগস্ট ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই যুবককে, ১৫ আগস্ট বরিশাল নগরীর চৌমাথায় এক টিউবওয়েল মিস্ত্রিকে এবং ১৭ আগস্ট বরিশালের উজিরপুরে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের কাউকে চোর সন্দেহে, কাউকে স্বৈরাচারের দোসর সন্দেহে আবার কারও প্রতি ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে গণপিটুনি দিয়ে
হত্যা করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত হন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ৫১ জন। আর জানুয়ারি-জুলাই ৭ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৩ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ১৬, খুলনায় ২, রাজশাহীতে ৭, সিলেটে ১, চট্টগ্রামে ৩, বরিশালে ১ ও ময়মনসিংহে ৩ জন নিহত হন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতার করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মব জাস্টিস পরিস্থিতির বিষয়ে ছাত্রদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রশাসনকে প্রশাসনের মতো কাজ করতে দিতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি
অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনের শাসনের ব্যর্থতার কারণে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির মতো অপরাধ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি চলমান পরিস্থিতিকে পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলছে। অন্যদিকে উল্লেখ করা যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বাড়ছে মব জাস্টিস। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মব জাস্টিস বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মব জাস্টিস থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জনগণকে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ইতঃপূর্বে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পুলিশকে আরও তৎপর করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, এই
ধরনের একটা ঘটনাও ঘটা উচিত না। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি সরকারের কঠিন বার্তা দেওয়া দরকার। কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া মব জাস্টিস রোখা যাবে না। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্তেজনা ছড়ায়। কখনও চোর, কখনও স্বৈরাচারের দোসর এমন নানা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। অনেক সময় নিরপরাধ মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হয়ে মারা যান। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের সংবিধান, আইন কোথাও এর স্বীকৃত কোনো পন্থা নেই। যদিও আমরা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি, তবুও যেভাবেই হোক সরকারকে মব জাস্টিস রুখতে পদক্ষেপ নিতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর পরিস্থিতি, আইনের শাসনের অভাব আর বিচার
ব্যবস্থায় নানা দুর্বলতায় কারণেই ঘটছে একের পর এক মব জাস্টিস। শুধু তাই নয়, মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি এবং মনোজগতে এক ধরনের সহিংসতার প্রতিফলনের কারণেও ঘটছে এসব ঘটনা। আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে সামান্য আঘাতও করা হয় তাহলে ৩১৯ ধারায় অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। আর এ অপরাধের জন্য অপরাধীকে ৩২৩ ধারায় ১ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। যদি পিটুনি দেওয়া হয় তবে কারাদণ্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব ৩ বছর এক মাসে। সেইসঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা হয় তবে ৩২৫ ধারার অধীনে ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। এছাড়া দণ্ডবিধির ৩৩৫ ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারেন আঘাতকারীরা। হামলা চালানোর ফলে ব্যক্তির মৃত্যু হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের সাজা দেওয়া যায়। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। গণপিটুনিতে ওই ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া সব ব্যক্তি সমানভাবে এজন্য দায়ী হবে। কেননা আইনে ‘যৌথ দায়িত্বশীলতা’ বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। এর মানে গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড় ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন। এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যান আর সেটা যদি খুন হিসাবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়। সে হিসাবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।