
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর

উখিয়ায় চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের বিক্ষোভে লাঠিচার্জ, ১৫ জন পুলিশ হেফাজতে

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ

সাভারে ছাত্র হত্যা মামলার আসামি এখন রাজাপুরের ইউএনও

চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

আজ ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

ফেসবুকে কথাকাটাকাটি, টেঁটা-বল্লম নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষ

‘চিরকুট লিখে না গেলে পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে’
প্রশাসন রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী মিলেমিশে সাদা পাথর লুট

সিলেটের সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা থেকে কয়েকশ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগী হিসাবে খনিজসম্পদ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিগত ১ বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করা ৪ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ও বিজিবির নাম উঠে এসেছে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও পাথর লুটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপিসহ ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হাতে আসা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব
তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অসাধু চক্রের যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটেছে। দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিম ১৩ আগস্ট ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে। এ ছাড়া পাথর লুটের ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে গোপনে অনুসন্ধান চালায়। দুকের টিম অভিযানকালে দেখতে পায়, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু পর্যটন সেবা ও নদীর তীরেই বিজিবি ক্যাম্প টহল চালু অবস্থায় আলোচিত ওই পর্যটন স্পট থেকে বিগত কয়েক মাসে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী
ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে সরানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাথর আত্মসাতের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশ ছিল। নদী ও পর্যটন এলাকা থেকে পাথর চুরি করে প্রথমে স্থানীয় স্টোন ক্র্যাশার মেশিন কারখানায় জমা করা হয়। পরে তা ভাঙানো হয়, যাতে চুরি হওয়া পাথরের অস্তিত্ব পাওয়া না যায়। পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে, বিশেষ করে গত ৩ মাস ধরে পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। পর্যটন এলাকাটি সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও ১৫ দিন আগে থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়েছে। প্রায়
৮০ ভাগ পাথর তুলে এলাকায় অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর অবহেলার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, খনি ও খনিজসম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯১ ও ৯৩ অনুযায়ী খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা এবং অবৈধভাবে খনিজসম্পদ উত্তোলন বা আহরণ করা যাবে না। অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে শনাক্ত করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা ও এ ধরনের কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা বা এখতিয়ার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ওপর ন্যস্ত। কিন্তু সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনা প্রতিরোধে বিএমডি থেকে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনারকে
দায়ী করে বলা হয়, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী ৮ জুলাই তার কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বলেন, সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। তার এ বক্তব্যটি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সাদা পাথর লুটপাটে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে। সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তার এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরদকে দায়ী করে
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেট জেলায় অবস্থিত সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত। এ স্থান থেকে পাথর, বালি ও অন্যান্য খনিজসম্পদ উত্তোলন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। সরকারি বিধি অনুযায়ী বিদ্যমান পর্যটন স্পটগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য বজার রাখাসহ পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। পাথর লুটপাট ঠেকাতে সিলেটে কর্মরত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট। তিনি তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটন স্পট রক্ষায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাপাথর পর্যটন স্পটের বর্তমান অবস্থা একদিনে হয়নি। এটি বিগত ৭-৮ মাস ধরে চললেও জেলা প্রশাসক ও তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ২৭ এপ্রিল অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহণ বন্ধের জন্য পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান আলোচ্য সাদা পাথর লুটপাটের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বর্তমানে কর্মরত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চারজন ইউএনওকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাথরকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় দৃশ্যমানভাবে দিনে দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের গোচরেই উক্ত পাথর লুটপাট হয়েছে। ওই সময়ে কোম্পানীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, ঊর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা কর্মরত ছিলেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনিসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করে সাদা পাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫০০ ঘনফুট করে লোড করা হয়। পরিবহণ ভাড়া ছাড়া প্রতি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হয় ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক থেকে দশ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নেয়। এছাড়া প্রতি ট্রাক থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পুলিশের জন্য ৫ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৫ হাজার টাকা বণ্টন হতো। এছাড়াও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা হতে এক হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যার মধ্যে পুলিশ বিভাগ পায় ৫০০ টাকা এবং প্রশাসন (ডিসি ও ইউএনও) পায় ৫০০ টাকা। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ট্রাক ও নৌকা থেকে এসব চাঁদা বা অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করে। প্রতিবেদনে সাদা পাথর লুটে বর্ডার গার্ড বিজিবিকেও দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সাদা পাথর এলাকায় ৩টি বিজিবি পোস্ট রয়েছে। এগুলো হতে লুটের ঘটনাস্থলের দূরত্ব ৫০০ মিটার থেকেও কম। এত কম দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল হোসেনসহ বিজিবি সদস্যদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ও নিষ্ক্রিদ্ধয়তার কারণে অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীরা খুব সহজেই পাথর লুটপাট করতে পেরেছে। বিজিবি সদস্যরা প্রতি নৌকা ৫০০ টাকার বিনিময়ে এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেয় এবং পাথর উত্তোলনের সময় বাধা প্রদান করেননি। প্রশাসন ছাড়া পাথরলুট কাণ্ডে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন-সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, সদস্য মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স। তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের সাত নেতাকর্মীর নামও। তারা হলেন-কার্যক্রম নিষিদ্ধ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, কর্মী মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান। এতে জামায়াতের দুজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন-সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। প্রতিবেদনে এনসিপির দুই নেতার নাম এসেছে। এরা হলেন-সিলেট জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়া অনুসন্ধানে সাদা পাথর লুটের সঙ্গে অন্য আরও ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন-কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জের আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম ও মুকাররিম আহমেদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি : পাথরলুট কাণ্ডে বুধবার ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটিকে আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে লুটের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার শাখা) সচিব জাহেদা পারভিনকে। কমিটির অন্য ৪ সদস্য হলেন-জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন ও সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব), যিনি তদন্ত কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় কোনো কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা ছিল কিনা তা নিরূপণ করা হবে। এছাড়া উল্লিখিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশ প্রণয়নপূর্বক আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার রাজস্ব দেবজিৎ সিংহ জানান, কমিটি (আজ) বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রথম সভা করবে। সভায় কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে সরেজমিন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে ১০ সুপারিশ : এদিকে লুটপাটের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। বুধবার দুপুরে প্রত্যাহারের আদেশপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসন সিংহ। শের মাহবুব মুরাদ তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এখনো বিস্তারিত দেখিনি। দেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। তবে তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, তদন্তে লুটপাট সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম থেকে যে ১৩৭ জনের নাম পাওয়া গেছে, তা তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে কারা, কীভাবে পাথর লুট করে এবং পরিবেশ বিনষ্ট করে; সে বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতি প্রমাণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে আলাদা তদন্ত কমিটি করে দায় নিরূপণের জন্য বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে লুট ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সার্বক্ষণিক নজরদারির সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্তে উপজেলা প্রশাসন দাবি করেছে, পাথর লুট ঠেকাতে অভিযানে সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা মেলেনি। ভবিষ্যতে অভিযান পরিচালনায় সার্বিক সহায়তা নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমটির তদন্ত চলাকালীন সময়েও বিজিবি কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা না করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত নেতার প্রতিবাদ : দুদকে প্রতিবেদনে নাম থাকায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী ও মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম। প্রকৃত লুটেরাদের আড়াল করতেই মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে জানান সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটে প্রকৃত লুটেরাদের আড়াল করতেই আমাকে জড়ানো হয়েছে। যারা তালিকা করেছেন, তাদেরকেই আমার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় ক্ষমা চাইতে হবে। সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘পাথর লুটে তার নাম জড়িয়ে একটা চক্র অপপ্রচার করছে। যার ধারাবাহিকতায় সংবাদমাধ্যমও অসত্য তথ্য প্রকাশ করছে।’ এমন তথ্য প্রচারিত হওয়ায় বিচলিত নন বলে জানান তিনি। দুদকের তালিকায় দুই জামায়াত নেতাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে সিলেট জেলা ও মহানগর জামায়াত। এদিকে এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সিলেটের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ বলেন, গত ১৩ আগস্ট এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করে প্রাথমিকভাবে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা নিয়ে ১৬ আগস্ট প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অসাধু চক্রের যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটেছে। দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিম ১৩ আগস্ট ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে। এ ছাড়া পাথর লুটের ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে গোপনে অনুসন্ধান চালায়। দুকের টিম অভিযানকালে দেখতে পায়, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু পর্যটন সেবা ও নদীর তীরেই বিজিবি ক্যাম্প টহল চালু অবস্থায় আলোচিত ওই পর্যটন স্পট থেকে বিগত কয়েক মাসে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী
ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে সরানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাথর আত্মসাতের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশ ছিল। নদী ও পর্যটন এলাকা থেকে পাথর চুরি করে প্রথমে স্থানীয় স্টোন ক্র্যাশার মেশিন কারখানায় জমা করা হয়। পরে তা ভাঙানো হয়, যাতে চুরি হওয়া পাথরের অস্তিত্ব পাওয়া না যায়। পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে, বিশেষ করে গত ৩ মাস ধরে পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। পর্যটন এলাকাটি সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও ১৫ দিন আগে থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়েছে। প্রায়
৮০ ভাগ পাথর তুলে এলাকায় অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর অবহেলার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, খনি ও খনিজসম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯১ ও ৯৩ অনুযায়ী খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা এবং অবৈধভাবে খনিজসম্পদ উত্তোলন বা আহরণ করা যাবে না। অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে শনাক্ত করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা ও এ ধরনের কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা বা এখতিয়ার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ওপর ন্যস্ত। কিন্তু সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনা প্রতিরোধে বিএমডি থেকে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনারকে
দায়ী করে বলা হয়, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী ৮ জুলাই তার কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বলেন, সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। তার এ বক্তব্যটি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সাদা পাথর লুটপাটে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে। সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তার এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরদকে দায়ী করে
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেট জেলায় অবস্থিত সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত। এ স্থান থেকে পাথর, বালি ও অন্যান্য খনিজসম্পদ উত্তোলন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। সরকারি বিধি অনুযায়ী বিদ্যমান পর্যটন স্পটগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য বজার রাখাসহ পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। পাথর লুটপাট ঠেকাতে সিলেটে কর্মরত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট। তিনি তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটন স্পট রক্ষায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাপাথর পর্যটন স্পটের বর্তমান অবস্থা একদিনে হয়নি। এটি বিগত ৭-৮ মাস ধরে চললেও জেলা প্রশাসক ও তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ২৭ এপ্রিল অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহণ বন্ধের জন্য পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান আলোচ্য সাদা পাথর লুটপাটের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বর্তমানে কর্মরত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চারজন ইউএনওকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাথরকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় দৃশ্যমানভাবে দিনে দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের গোচরেই উক্ত পাথর লুটপাট হয়েছে। ওই সময়ে কোম্পানীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, ঊর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা কর্মরত ছিলেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনিসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করে সাদা পাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫০০ ঘনফুট করে লোড করা হয়। পরিবহণ ভাড়া ছাড়া প্রতি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হয় ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক থেকে দশ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নেয়। এছাড়া প্রতি ট্রাক থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পুলিশের জন্য ৫ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৫ হাজার টাকা বণ্টন হতো। এছাড়াও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা হতে এক হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যার মধ্যে পুলিশ বিভাগ পায় ৫০০ টাকা এবং প্রশাসন (ডিসি ও ইউএনও) পায় ৫০০ টাকা। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ট্রাক ও নৌকা থেকে এসব চাঁদা বা অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করে। প্রতিবেদনে সাদা পাথর লুটে বর্ডার গার্ড বিজিবিকেও দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সাদা পাথর এলাকায় ৩টি বিজিবি পোস্ট রয়েছে। এগুলো হতে লুটের ঘটনাস্থলের দূরত্ব ৫০০ মিটার থেকেও কম। এত কম দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল হোসেনসহ বিজিবি সদস্যদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ও নিষ্ক্রিদ্ধয়তার কারণে অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীরা খুব সহজেই পাথর লুটপাট করতে পেরেছে। বিজিবি সদস্যরা প্রতি নৌকা ৫০০ টাকার বিনিময়ে এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেয় এবং পাথর উত্তোলনের সময় বাধা প্রদান করেননি। প্রশাসন ছাড়া পাথরলুট কাণ্ডে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন-সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, সদস্য মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স। তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের সাত নেতাকর্মীর নামও। তারা হলেন-কার্যক্রম নিষিদ্ধ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, কর্মী মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান। এতে জামায়াতের দুজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন-সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। প্রতিবেদনে এনসিপির দুই নেতার নাম এসেছে। এরা হলেন-সিলেট জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়া অনুসন্ধানে সাদা পাথর লুটের সঙ্গে অন্য আরও ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন-কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জের আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম ও মুকাররিম আহমেদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি : পাথরলুট কাণ্ডে বুধবার ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটিকে আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে লুটের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার শাখা) সচিব জাহেদা পারভিনকে। কমিটির অন্য ৪ সদস্য হলেন-জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন ও সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব), যিনি তদন্ত কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় কোনো কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা ছিল কিনা তা নিরূপণ করা হবে। এছাড়া উল্লিখিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশ প্রণয়নপূর্বক আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার রাজস্ব দেবজিৎ সিংহ জানান, কমিটি (আজ) বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রথম সভা করবে। সভায় কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে সরেজমিন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে ১০ সুপারিশ : এদিকে লুটপাটের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। বুধবার দুপুরে প্রত্যাহারের আদেশপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসন সিংহ। শের মাহবুব মুরাদ তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এখনো বিস্তারিত দেখিনি। দেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। তবে তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, তদন্তে লুটপাট সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম থেকে যে ১৩৭ জনের নাম পাওয়া গেছে, তা তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে কারা, কীভাবে পাথর লুট করে এবং পরিবেশ বিনষ্ট করে; সে বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতি প্রমাণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে আলাদা তদন্ত কমিটি করে দায় নিরূপণের জন্য বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে লুট ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সার্বক্ষণিক নজরদারির সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্তে উপজেলা প্রশাসন দাবি করেছে, পাথর লুট ঠেকাতে অভিযানে সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা মেলেনি। ভবিষ্যতে অভিযান পরিচালনায় সার্বিক সহায়তা নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমটির তদন্ত চলাকালীন সময়েও বিজিবি কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা না করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত নেতার প্রতিবাদ : দুদকে প্রতিবেদনে নাম থাকায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী ও মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম। প্রকৃত লুটেরাদের আড়াল করতেই মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে জানান সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটে প্রকৃত লুটেরাদের আড়াল করতেই আমাকে জড়ানো হয়েছে। যারা তালিকা করেছেন, তাদেরকেই আমার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় ক্ষমা চাইতে হবে। সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘পাথর লুটে তার নাম জড়িয়ে একটা চক্র অপপ্রচার করছে। যার ধারাবাহিকতায় সংবাদমাধ্যমও অসত্য তথ্য প্রকাশ করছে।’ এমন তথ্য প্রচারিত হওয়ায় বিচলিত নন বলে জানান তিনি। দুদকের তালিকায় দুই জামায়াত নেতাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে সিলেট জেলা ও মহানগর জামায়াত। এদিকে এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সিলেটের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ বলেন, গত ১৩ আগস্ট এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করে প্রাথমিকভাবে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা নিয়ে ১৬ আগস্ট প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।