গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাপ কম থাকায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যথাসময়ে রপ্তানি পণ্য শিপমেন্ট করতে এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ডিজেল জেনারেট দিয়ে কারখানা সচল রাখতে বাধ্য হচ্ছে কারখানাগুলো। কোথাও আবার গ্যাস এলে কারখানার চাকা ঘুরছে, কেউ কেউ ডিজেলের বাড়তি খরচে পোষাতে না পেরে কারখানা বন্ধ রাখছেন। কেস স্টাডি-১ : বিসিক শিল্পনগরী টঙ্গী এলাকার ঢাকা সিরামিক অ্যান্ড স্যানেটারি ওয়্যার লিমিটেড কারখানার জন্য ১৫ পিএসআই গ্যাসের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ওই কারখানায় ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখতে হয়। বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রয়োজনের তুলনায় দুই পিএসআই গ্যাস পাচ্ছে। ওই কারখানা চালু রাখতে গিয়ে তিন-চারগুণ ভর্তুকি দিয়ে ডিজেলের মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রম

চালু রাখলেও উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। কারখানার জেনারেল ম্যানেজার বিল্লাল হোসেন বলেন, এভাবে চলতে থাকলে কারখানা আর চালানো সম্ভব নয়। গ্যাসের চাপ না থাকলেও প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা অতিরিক্ত গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। দিনে গ্যাস না থাকায় রাতে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত শ্রমের মজুরি দিতে গিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কেস স্টাডি-২ : কোনাবাড়ী শিল্পাঞ্চল (বিসিক) এলাকার লাইফ টেক্সটাইল (প্রাইভেট) লিমিটেড ও সফিপুর এলাকার ময়জউদ্দিন টেক্সটাইল লিমিটেডের পারসনাল অফিসার এমডি হাসান জানান, তাদের দুই কারখানায় প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কোনাবাড়ীর কারখানা কোনোরকমে বাইরে থেকে কেনা গ্যাস ও লাইনের গ্যাস দিয়ে চালানো যাচ্ছে। কিন্তু সফিপুরে বড়

কারখানার অবস্থা খুবই খারাপ। ওখানে কেনা গ্যাসেও কারখানা চালানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কারখানা চালাতে প্রতি গাড়ি সিএনজি গ্যাস দুই লাখ টাকায় কিনতে হয়। ওই লোক নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে এনে দেয় এবং তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হয়। না হয়, আরও অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এ অবস্থায় কারখানা চালানো খুবই কষ্ট হচ্ছে। কেস স্টাডি-৩ : টঙ্গীতে ছোট-বড় প্রায় ৫৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক মাসে পাঁচটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারখানাগুলো হলো-বিসিকের সেফ ওয়াশিং, কালার লন্ড্রি, টঙ্গীর সিলমুন এলাকার ডিসকাভারী ওয়াশিং, জহির মার্কেট এলাকার ডিমার্ট ওয়াশিং প্রসেজ ও টঙ্গী খাঁপাড়া এলাকার এনএফ

ওয়াশিং প্লান্ট। টঙ্গীর সিলমুন এলাকার এফজিএস লন্ড্রি লিমিটেডের মালিক সাইফুল ইসলাম খান বলেন, কোনো কোনো সময় গ্যাসের চাপ এতটাই কম থাকে যে, পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারি না। কেস স্টাডি-৪ : কালিয়াকৈর উপজেলা ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায়ও তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। ওই এলাকায় ৩ শতাধিক বিভিন্ন শিল্পকারখানা রয়েছে। কয়েক মাস ধরে এসব কারখানার উৎপাদন কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার জাহিদুর রহমান আনিস বলেন, প্রায় আড়াই মাস ধরে কারখানায় গ্যাস সংকট চলছে। ৭ দিন ধরে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। গ্যাস সংকটে ফ্যাব্রিকস ডাইং করাতে না পারায়

প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বয়লার মেশিন চলে না, ডাইং মেশিন চালু দিলে গ্যাসের কারণে কাপড়ের রং বদলে যায়। এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন ঈদে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। যা বলছে তিতাস কর্তৃপক্ষ : তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কালিয়াকৈর চন্দ্রা জোনাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সৈয়দ আবু সাহাদত সায়েম বলেন, কালিয়াকৈর, চন্দ্রা ও আশপাশ এলাকায় বর্তমানে গ্যাসের চাপ স্বল্পতা চলছে। মূলত চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় এসব এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলটা গ্যাস নেটওয়ার্কিংয়ের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। যে কারণে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি আছে। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে

সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। তিতাস গ্যাসের বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মেজবা-উর-রহমান বলেন, দেশের সামগ্রিক গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে টঙ্গী গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। এলএনজি টার্মিনালের কারিগরি সমস্যাও এর একটি কারণ। নারায়ণগঞ্জের দুই শিল্পাঞ্চলে সংকট বেশি : জেলার রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে গ্যাসের চাপ একেবারেই কম। গ্যাসের চাপ কম হওয়ার কারণে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। তবে ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে গত দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ কিছুটা বাড়লেও সেটা চাহিদার তুলনায় কম। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মৈকুলিতে অবস্থিত বি ব্রাদার্স গ্রুপের ডায়িং ফ্যাক্টরিতে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটিতে ফ্যাব্রিক্স ডায়িং করার সক্ষমতা আছে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ টন।

কিন্তু গ্যাসের চাপ কম থাকায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ টনের বেশি ফ্যাব্রিক্স ডায়িং করতে পারছে না। কারখানার এজিএম নুরুল হাদি খান বলেন, আমাদের ১২ টন ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিনটি ছয় মাস ধরে বসে আছে। শুক্র ও শনিবার ছাড়া এটি চালু করা যায় না। দুটি বয়লারের মধ্যে একটি বয়লার চালানো যায়। আরেকটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হয়। একই মহাসড়কের ভুলতা এলাকায় অবস্থিত মাইক্রোফাইবার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এ ওয়ান পোলার লিমিটেড গার্মেন্ট কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, গ্যাসের প্রেসার না থাকায় ডায়িং কারখানা প্রায় বন্ধ রয়েছে। জানতে চাইলে কারখানার ডিজিএম এডমিন মো. শাহেদ হোসাইন এই প্রতিবেদককে নিয়ে যান তিতাস গ্যাসের সংযোগ নেওয়া মিটার রুমে। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ওই মিটার রুমে গিয়ে দেখা যায়, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ মিটার রুমটি কাচের ঘরের মতো করে রেখে দিয়েছে। যাতে কারখানার কোনো লোক ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। তিনি বলেন, আমাদের ৬০ টন ক্যাপাসিটির ডায়িং কারখানায় গ্যাসের প্রেসার প্রয়োজন প্রায় ১২ থেকে ১৪ পিএসআই। কিন্তু আমরা গড়ে পাচ্ছি ৩ থেকে ৪ পিএসআই। তিনি বলেন, সকালের দিকে গ্যাসের প্রেসার থাকে তিন থেকে চার পিএসআই। বারোটার পর থেকে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কিছুটা বেড়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। ফতুল্লা বিসিক শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত ফকির অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মনিরুজ্জামান জানান, গ্যাসের চাপ মাঝে মাঝে ওঠানামা করে। তখন ঝুট, তুষ পুড়িয়ে একটি বয়লার চালাতে হয়। এছাড়া এলএনজি স্টক রাখতে হয়। যখনই গ্যাসের প্রেসারে প্রবলেম হয় তখন এলএনজি ব্যবহার করে কারখানা সচল রাখতে হয়। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নারায়ণগঞ্জের স্টাফ রিপোর্টার আমির হুসাইন স্মিথ, গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি শাহ সামসুল হক রিপন, কালিয়াকৈর প্রতিনিধি আব্দুল আলীম ও টঙ্গী (পূর্ব) প্রতিনিধি লুৎফুজ্জামান লিটন।