ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
ক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি জান্তারা
বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
বিজয় দিবসের দিন জামায়াত আমিরের অভিনব প্রতারণা
অবিনশ্বর বিজয় দিবস ২০২৫
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা
প্রহসন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, জনগণের রায় ছাড়াই ক্ষমতার বন্দোবস্ত মানবে না দেশ
নিয়াজীর আত্মসমর্পণের চুক্তিনামা নিয়ে আসেন
নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর যেদিন বিজয়ের সূর্য হেসেছিল বাংলার আকাশে
নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর যেদিন বিজয়ের সূর্য হেসেছিল বাংলার আকাশে, সেদিন কেমন ছিল ঢাকা? নয় মাস অবরুদ্ধ থাকা মানুষগুলোর মুক্তির আনন্দের প্রকাশইবা ছিল কেমন?
৫১ বছর পর তার চাক্ষুস সাক্ষী অনেকে হারিয়ে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে, কিন্তু যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের মনে এখনও জ্বলজ্বল করে সেই স্মৃতি।
তেমনই একজন সত্তরোর্ধ্ব আনোয়ারুল আলীম; ওষুধের ব্যবসা করতেন এক সময়। এখন অবসর নিয়ে আবাস গেঁড়েছেন মিরপুর ডিওএইচএসে, তবে তখন থাকতেন পুরান ঢাকার মিডফোর্ড এলাকায়।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকালে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর রাতভর পুরান ঢাকায় বিজয়োল্লাসের সাক্ষী হয়েছিলেন তখনকার বিএ পরীক্ষার্থী আলীম।বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে তিনি বলেন, “পুরান ঢাকায় সারারাত খণ্ড খণ্ড
মিছিল হয়েছে। মানুষ আনন্দ করেছে। দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর মুক্তির উল্লাস!“ওই রাতে বাঙালি পরিবার সবাই জানালা খুলে রেখেছিল। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় আলো নেই। ঘরের আলোয় রাস্তা আলোকিত ছিল।” সবার জানালা খোলা কেন- উত্তরে তিনি বলেন, “যাদের জানালা বন্ধ, তারা বাংলাদেশের পক্ষে না, এমনটাই সবার ধারণা ছিল।” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরুর পর শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ। ঢাকায় যারা ছিলেন, সেই যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় তাদের এক ধরনের বন্দিদশায় থাকতে হয়েছিল। তার মধ্যেই ডিসেম্বরের মাঝমাঝিতে তারা আভাস পাচ্ছিলেন, বিজয় আসছে, বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশে হিসেবে অভ্যুদয় ঘটছে বাংলাদেশের। তবে তখন ঢাকাবাসীর উপর পাকিস্তানি বাহিনীর কড়াকড়িও বাড়ছিল। আনোয়ারুল আলীম বলেন,
“আগের তিন দিন ছিল কারফিউ। শহরে ব্ল্যাকআউট। ১৫ ডিসেম্বর সম্ভবত আকাশবাণীতে শুনেছিলাম যে, স্যারেন্ডার হতে পারে। রেডিও তখন আস্তে শুনতে হত, গোপনে। আকাশবাণী আর মাঝে মাঝে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র।” পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে- চাইলেও ঘরে থেকে এমন কথা বিশ্বাস করতে বিশ্বাস হতে চাইছিল না আলীমের। “স্যারেন্ডারের খবর প্রথমে বিশ্বাস করিনি। যতক্ষণ না হয়, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসেনি। তবে পরদিন মানে ১৬ ডিসেম্বর, আমার পরিষ্কার মনে আছে, ছাদে বসে আছি, বেলা ১১-১২টার দিকে হবে হয়ত, দেখলাম আকাশে ৩-৪টা ভারতীয় হেলিকপ্টার। আমার বাসা তখন মিডফোর্ড হাসপাতালের উল্টোদিকে। ওই হেলিকপ্টার দেখে মনে হল, স্যারেন্ডার হতে চলেছে। পরে বন্ধুদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম।”বন্ধুদের নিয়ে তখন রেসকোর্সের
উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন আলীম, যেখানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মঞ্চ ততক্ষণে প্রস্তত। “হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের সাথে আমিও রেসকোর্সে গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছেছিলাম তখন স্যারেন্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। তবুও প্রচুর মানুষ তখন রেসকোর্সে। সবাই উল্লাস করছে, স্লোগান দিচ্ছে। সারারাত মহল্লায় মহল্লায় উল্লাস। এখনও চোখের সামনে ভাসে।” বাংলাদেশের বিজয়ের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এস সফিউল্লাহ। সেদিনে ঢাকার অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, “এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ ছিল না। যখন আমরা নিয়াজিকে নিয়ে যাই তখন রেসকোর্সেও খুব মানুষ ছিল না। আত্মসমর্পণের পরে প্রচুর মানুষ রাস্তায় নামে। মিছিল করে।” মানুষের উচ্ছ্বাস নিয়ে আনোয়ারুল আলীম বলেন, “রাস্তায় ভারতীয় সেনার ট্রাক দেখলেই
মানুষ থামিয়ে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিল। অনেকে আবার তাদের ফান্টা-সেভেনআপ কিনে খাওয়াচ্ছিল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সেনা দেখলেই উল্লাসে ফেটে পড়ছে। “পাকিস্তানি আর্মি ১৭ তারিখেও ঢাকায় ঢুকেছে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আমরা ক্ষোভ জানিয়েছিলাম, কেন তাদের হাতে অস্ত্র থাকবে।” তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সোহেল আহমেদ বলেন, তাদের ক্যাম্প ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে ঢাকায় ঢোকেন তারা। “আমাদের একটি নৌকা ডুবে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। আমরা তৎকালীন পাকিস্তান বেতার ভবনে ঢুকে পতাকা উড়িয়েছিলাম। মুক্তির আনন্দ ছিল তখন মানুষের চোখেমুখে।” বিজয়ের পরদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে ঢু মেরেছিলেন আলীম ও তার বন্ধুরা; যেখানে তখন অনেক বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। আলীম বলেন, “১৭
ডিসেম্বর আমরা কয়েকজন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে গিয়েছিলাম। একজন শিখ অফিসার দেখে আমাদের একজন বলে উঠল, ‘জেনারেল অরোরা’। সবার কী উৎসাহ! দূর থেকে দেখেছি। উনি জেনারেল অরোরা ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত করে এখন বলতে পারব না। এরপর তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ কাঁদছিল।” রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। আর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে সই করেন ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আখাউড়া থেকে এসেছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। তিনি বলেন, “আমার শেষ যুদ্ধ হয়েছিল আখাউড়াতে। ওখানে
পাকিস্তানের একটি ব্রিগেডকে পরাজিত করার পর ভারতীয় একটি ব্রিগেড আমাদের সাথে যুক্ত হয়। আমি সিলেট হাইওয়ে ধরে আশুগঞ্জ যাই। আর ইন্ডিয়ান ব্রিগেড রেললাইন ধরে এগোয়। ১০ ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীর রায়পুরা থেকে ঢাকার দিকে রওনা দেই। ১১ তারিখ আমরা ডেমরা পৌঁছাই। নদীর এ পার থেকে আমরা গুলি চালিয়েছিলাম। ডেমরা ঘাটে যুদ্ধ হয়। ১৪ তারিখ ডেমরায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে।” পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “স্যারেন্ডার ফাইনাল হওয়ার পরপর আমাকে বলা হয়, আমি যেন জেনারেল নিয়াজিকে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স নিয়ে যাই। আমার কাছে গাড়ি নেই। এতদিন তো পায়ে হেঁটে চলছি। ডেমরাতে পাকিস্তানের যে ব্যাটালিয়ন আমার কাছে স্যারেন্ডার করে, সেটার কমান্ডারকে তার গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। ওই গাড়ি নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট যাই। নিয়াজিকে নিয়ে আমি ঢাকা ক্লাবের উল্টোদিকে রেসকোর্সে যাই। আত্মসমর্পণ যেখানে হল, সেখানে আমি দাঁড়ানো ছিলাম। নিয়াজি সিগনেচার করল। জেনারেল অরোরা সই করার সময় তার নামটা ঠিক লেখেননি। আমি তখন তাকে বললাম, তার নাম ঠিক নাই। তারপর তিনি আবার সাইন করেন।” ঐতিহাসিক সেই আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া লিখেছিলেন তখনকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব (বর্তমানে প্রয়াত)। শুধু দলিলের খসড়া রচনাই নয়, নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৃতিত্বও তার। ২০০৮ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জ্যাকব নিয়াজির আত্মসমর্পণ সম্পর্কে বলেন, “…এরপর দেখি তার চোখে জল। আমি সেদিকে করুণাভরে তাকিয়ে ভাবলাম, এই লোকটা বাংলাদেশের মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আপনারা জানেন, তার সেনাবাহিনী কী করেছে, তাই নতুন করে তা বলার নেই। এজন্য আমি তাকে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। নিয়াজী আবারও বললেন, তিনি তার সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণ করবেন। আমি বললাম, না, আপনাকে রেসকোর্স ময়দানে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি নিয়মিত বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মসমর্পণই শুধু নয়, আমি তাদের গার্ড অব অনার দিতেও বাধ্য করলাম।” আত্মসমর্পণে আর দু’য়েকদিন দেরি হলেই জাতিসংঘ তাদের যুদ্ধবিরতি আদেশ কার্যকর করত বলে শঙ্কা ছিল জ্যাকবের। তার ‘স্যারেন্ডোর অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিয়াজির অফিসে যখন আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া পড়ে শোনানো হয়, তখন সেখানে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। নিয়াজি কাঁদছিলেন। রাও ফরমান আলি ‘ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ’ কথাটিতে আপত্তি জানান। নিয়াজি বলেন, খসড়ায় তো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়াজি খসড়া মেনে নেন। সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন উপ প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার। ২০১৩ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে এ কে খন্দকার লেখেন, “আমি তখন কোলকাতায়। ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিছু কাজে বাইরে গেছিলাম। ফিরলাম বেলা দশটার দিকে। ফিরে দেখি আমার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছেন। তাদের কাছেই জানলাম পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন বিকেলে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেজন্য ঢাকার রেসকোর্সে একটি ছোট্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে। আর আমাকে সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে….।” রেসকোর্স ময়দানে আনন্দ-উল্লাস আর ভিড়ের মধ্যে সেই অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা রাখা ছিল, সেখানে একটি টেবিল পাতা। সামনেই ঢাকা ক্লাব, সেখান থেকে দুটো চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করা গেল। বসলেন ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে।” এ কে খন্দকার লিখেছেন, “স্বাক্ষরের পরপরই পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হল। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার আমাদের ওপরই বর্তে গেছে। ওদিকে আশেপাশে ঘিরে থাকা হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে ঊঠলেন। অনেকেই এগিয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদছিলেন প্রায় সবাই। কাঁদতে কাঁদতে তারা বললেন, ‘আজ থেকে আমরা শান্তিতে ঘুমাব’।” আত্মসমর্পণের সময় জ্যাকবের ঘড়িতে সময় ছিল বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিট (ভারতীয় সময়)। বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ৫টা ২৫ মিনিট। “তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, কিন্তু কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না,” লিখেছেন জ্যাকব। তবে ততক্ষণে স্বাধীন দেশের নতুন আলোর আস্বাদ পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের মানুষ। সূত্রঃ বিডিনিউজ২৪
মিছিল হয়েছে। মানুষ আনন্দ করেছে। দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর মুক্তির উল্লাস!“ওই রাতে বাঙালি পরিবার সবাই জানালা খুলে রেখেছিল। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় আলো নেই। ঘরের আলোয় রাস্তা আলোকিত ছিল।” সবার জানালা খোলা কেন- উত্তরে তিনি বলেন, “যাদের জানালা বন্ধ, তারা বাংলাদেশের পক্ষে না, এমনটাই সবার ধারণা ছিল।” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরুর পর শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ। ঢাকায় যারা ছিলেন, সেই যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় তাদের এক ধরনের বন্দিদশায় থাকতে হয়েছিল। তার মধ্যেই ডিসেম্বরের মাঝমাঝিতে তারা আভাস পাচ্ছিলেন, বিজয় আসছে, বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশে হিসেবে অভ্যুদয় ঘটছে বাংলাদেশের। তবে তখন ঢাকাবাসীর উপর পাকিস্তানি বাহিনীর কড়াকড়িও বাড়ছিল। আনোয়ারুল আলীম বলেন,
“আগের তিন দিন ছিল কারফিউ। শহরে ব্ল্যাকআউট। ১৫ ডিসেম্বর সম্ভবত আকাশবাণীতে শুনেছিলাম যে, স্যারেন্ডার হতে পারে। রেডিও তখন আস্তে শুনতে হত, গোপনে। আকাশবাণী আর মাঝে মাঝে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র।” পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে- চাইলেও ঘরে থেকে এমন কথা বিশ্বাস করতে বিশ্বাস হতে চাইছিল না আলীমের। “স্যারেন্ডারের খবর প্রথমে বিশ্বাস করিনি। যতক্ষণ না হয়, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসেনি। তবে পরদিন মানে ১৬ ডিসেম্বর, আমার পরিষ্কার মনে আছে, ছাদে বসে আছি, বেলা ১১-১২টার দিকে হবে হয়ত, দেখলাম আকাশে ৩-৪টা ভারতীয় হেলিকপ্টার। আমার বাসা তখন মিডফোর্ড হাসপাতালের উল্টোদিকে। ওই হেলিকপ্টার দেখে মনে হল, স্যারেন্ডার হতে চলেছে। পরে বন্ধুদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম।”বন্ধুদের নিয়ে তখন রেসকোর্সের
উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন আলীম, যেখানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মঞ্চ ততক্ষণে প্রস্তত। “হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের সাথে আমিও রেসকোর্সে গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছেছিলাম তখন স্যারেন্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। তবুও প্রচুর মানুষ তখন রেসকোর্সে। সবাই উল্লাস করছে, স্লোগান দিচ্ছে। সারারাত মহল্লায় মহল্লায় উল্লাস। এখনও চোখের সামনে ভাসে।” বাংলাদেশের বিজয়ের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এস সফিউল্লাহ। সেদিনে ঢাকার অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, “এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ ছিল না। যখন আমরা নিয়াজিকে নিয়ে যাই তখন রেসকোর্সেও খুব মানুষ ছিল না। আত্মসমর্পণের পরে প্রচুর মানুষ রাস্তায় নামে। মিছিল করে।” মানুষের উচ্ছ্বাস নিয়ে আনোয়ারুল আলীম বলেন, “রাস্তায় ভারতীয় সেনার ট্রাক দেখলেই
মানুষ থামিয়ে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিল। অনেকে আবার তাদের ফান্টা-সেভেনআপ কিনে খাওয়াচ্ছিল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সেনা দেখলেই উল্লাসে ফেটে পড়ছে। “পাকিস্তানি আর্মি ১৭ তারিখেও ঢাকায় ঢুকেছে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আমরা ক্ষোভ জানিয়েছিলাম, কেন তাদের হাতে অস্ত্র থাকবে।” তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সোহেল আহমেদ বলেন, তাদের ক্যাম্প ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে ঢাকায় ঢোকেন তারা। “আমাদের একটি নৌকা ডুবে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। আমরা তৎকালীন পাকিস্তান বেতার ভবনে ঢুকে পতাকা উড়িয়েছিলাম। মুক্তির আনন্দ ছিল তখন মানুষের চোখেমুখে।” বিজয়ের পরদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে ঢু মেরেছিলেন আলীম ও তার বন্ধুরা; যেখানে তখন অনেক বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। আলীম বলেন, “১৭
ডিসেম্বর আমরা কয়েকজন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে গিয়েছিলাম। একজন শিখ অফিসার দেখে আমাদের একজন বলে উঠল, ‘জেনারেল অরোরা’। সবার কী উৎসাহ! দূর থেকে দেখেছি। উনি জেনারেল অরোরা ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত করে এখন বলতে পারব না। এরপর তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ কাঁদছিল।” রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। আর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে সই করেন ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আখাউড়া থেকে এসেছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। তিনি বলেন, “আমার শেষ যুদ্ধ হয়েছিল আখাউড়াতে। ওখানে
পাকিস্তানের একটি ব্রিগেডকে পরাজিত করার পর ভারতীয় একটি ব্রিগেড আমাদের সাথে যুক্ত হয়। আমি সিলেট হাইওয়ে ধরে আশুগঞ্জ যাই। আর ইন্ডিয়ান ব্রিগেড রেললাইন ধরে এগোয়। ১০ ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীর রায়পুরা থেকে ঢাকার দিকে রওনা দেই। ১১ তারিখ আমরা ডেমরা পৌঁছাই। নদীর এ পার থেকে আমরা গুলি চালিয়েছিলাম। ডেমরা ঘাটে যুদ্ধ হয়। ১৪ তারিখ ডেমরায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে।” পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “স্যারেন্ডার ফাইনাল হওয়ার পরপর আমাকে বলা হয়, আমি যেন জেনারেল নিয়াজিকে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স নিয়ে যাই। আমার কাছে গাড়ি নেই। এতদিন তো পায়ে হেঁটে চলছি। ডেমরাতে পাকিস্তানের যে ব্যাটালিয়ন আমার কাছে স্যারেন্ডার করে, সেটার কমান্ডারকে তার গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। ওই গাড়ি নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট যাই। নিয়াজিকে নিয়ে আমি ঢাকা ক্লাবের উল্টোদিকে রেসকোর্সে যাই। আত্মসমর্পণ যেখানে হল, সেখানে আমি দাঁড়ানো ছিলাম। নিয়াজি সিগনেচার করল। জেনারেল অরোরা সই করার সময় তার নামটা ঠিক লেখেননি। আমি তখন তাকে বললাম, তার নাম ঠিক নাই। তারপর তিনি আবার সাইন করেন।” ঐতিহাসিক সেই আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া লিখেছিলেন তখনকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব (বর্তমানে প্রয়াত)। শুধু দলিলের খসড়া রচনাই নয়, নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৃতিত্বও তার। ২০০৮ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জ্যাকব নিয়াজির আত্মসমর্পণ সম্পর্কে বলেন, “…এরপর দেখি তার চোখে জল। আমি সেদিকে করুণাভরে তাকিয়ে ভাবলাম, এই লোকটা বাংলাদেশের মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আপনারা জানেন, তার সেনাবাহিনী কী করেছে, তাই নতুন করে তা বলার নেই। এজন্য আমি তাকে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। নিয়াজী আবারও বললেন, তিনি তার সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণ করবেন। আমি বললাম, না, আপনাকে রেসকোর্স ময়দানে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি নিয়মিত বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মসমর্পণই শুধু নয়, আমি তাদের গার্ড অব অনার দিতেও বাধ্য করলাম।” আত্মসমর্পণে আর দু’য়েকদিন দেরি হলেই জাতিসংঘ তাদের যুদ্ধবিরতি আদেশ কার্যকর করত বলে শঙ্কা ছিল জ্যাকবের। তার ‘স্যারেন্ডোর অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিয়াজির অফিসে যখন আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া পড়ে শোনানো হয়, তখন সেখানে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। নিয়াজি কাঁদছিলেন। রাও ফরমান আলি ‘ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ’ কথাটিতে আপত্তি জানান। নিয়াজি বলেন, খসড়ায় তো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়াজি খসড়া মেনে নেন। সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন উপ প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার। ২০১৩ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে এ কে খন্দকার লেখেন, “আমি তখন কোলকাতায়। ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিছু কাজে বাইরে গেছিলাম। ফিরলাম বেলা দশটার দিকে। ফিরে দেখি আমার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছেন। তাদের কাছেই জানলাম পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন বিকেলে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেজন্য ঢাকার রেসকোর্সে একটি ছোট্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে। আর আমাকে সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে….।” রেসকোর্স ময়দানে আনন্দ-উল্লাস আর ভিড়ের মধ্যে সেই অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা রাখা ছিল, সেখানে একটি টেবিল পাতা। সামনেই ঢাকা ক্লাব, সেখান থেকে দুটো চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করা গেল। বসলেন ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে।” এ কে খন্দকার লিখেছেন, “স্বাক্ষরের পরপরই পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হল। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার আমাদের ওপরই বর্তে গেছে। ওদিকে আশেপাশে ঘিরে থাকা হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে ঊঠলেন। অনেকেই এগিয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদছিলেন প্রায় সবাই। কাঁদতে কাঁদতে তারা বললেন, ‘আজ থেকে আমরা শান্তিতে ঘুমাব’।” আত্মসমর্পণের সময় জ্যাকবের ঘড়িতে সময় ছিল বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিট (ভারতীয় সময়)। বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ৫টা ২৫ মিনিট। “তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, কিন্তু কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না,” লিখেছেন জ্যাকব। তবে ততক্ষণে স্বাধীন দেশের নতুন আলোর আস্বাদ পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের মানুষ। সূত্রঃ বিডিনিউজ২৪



