ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক চীনের দিকে ঝোঁকার কারণে উদ্বেগ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের
স্ট্রং ভল্টে সোনা-হীরা থাকলেও চুরি শুধু অস্ত্র, বাড়ছে শাহজালাল আগুনের রহস্য
ড. ইউনুসের পতনের ডাক যুবলীগের, ১৩ নভেম্বর ঢাকায় লকডাউন ঘোষণা
চার দিনের সফরে ঢাকায় পাকিস্তান নৌপ্রধান, সেনাপ্রধানকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান নৌপ্রধানকে গলফ ও ভোজে আপ্যায়ন সশস্ত্র বাহিনীতে বিভেদ ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) নিয়ে ড. ইউনূসের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বিতর্ক: তথ্য বিকৃতি ও বিভ্রান্তির অভিযোগ
ইউনূসকে রেফারির ভূমিকায় চায় ধর্মভিত্তিক ৮ দল
নতুন পে স্কেলে গ্রেড কমানোর প্রস্তাব, সর্বনিম্ন বেতন কত হতে পারে
আজ সংবিধান দিবসঃ বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি
(২০১৬ সালে প্রকাশিত লেখার পুনর্লিখিত রুপ। সম্পূর্ণ সংস্করণ- লেখক: সংবিধান প্রণেতা দলের সদস্য ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম)
বাংলাদেশের সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। এর অন্তর্নিহিত রয়েছে এদেশের মানুষের হাজার বছরের লালিত আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের অবিরাম সংগ্রাম ও অটুট প্রত্যয়। আমাদের সংবিধান শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অসহায়ত্বের বেড়াজাল ভেদ করে জনগণের ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক দলিল; ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, শোষণ-শাসনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মুক্তির যে মহাসংগ্রাম, তারই পথ ধরে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা।
বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক দলিল—স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র—এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণা। বিশ্ব ইতিহাসে মাত্র দুটি
দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ঠাঁই পেয়েছে: ১. যুক্তরাষ্ট্রের Declaration of Independence (৪ জুলাই ১৭৭৬), ২. বাংলাদেশের Proclamation of Independence (১০ এপ্রিল ১৯৭১)। এই দুটি দলিলের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে স্বাধীনতার সাংবিধানিক ভিত্তি। বাংলাদেশের জনগণের হাজার বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শাসকগোষ্ঠী বারবার ব্যাহত করেছে। কিন্তু জনগণ কখনো সে বাধা মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে অবিরাম সংগ্রাম। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়নের স্থান বলবৎ হয়েছে, যা আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। সকলকে জানান দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে: “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) অষ্টম সংশোধনী মামলা (১৯৮৯)-এ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রায়ের ৩২৫, ৩২৬ ও
৩২৭ পৃষ্ঠায় এই ঐতিহাসিক পটভূমির সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বিবরণ রয়েছে। এই পটভূমি না জানলে মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা অজানা থেকে যায় এবং সংবিধানের ওপর বারবার আঘাত (বিশেষত পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯ ও সপ্তম সংশোধনী ১৯৮৬)-এর প্রেক্ষাপট বোঝা অসম্ভব হয়। ব্রিটিশ শাসনোত্তর প্রথম আঘাত (১৯৫৪-১৯৫৮) ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও মুসলিম লীগের চরম পরাজয়ের পরও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ধূলিসাৎ করা হয়। নির্বাচিত আইনসভা ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গভর্নর শাসন জারি করা হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সবচেয়ে মারাত্মক স্খলন ঘটে ১৯৫৫ সালের মে মাসে—ব্রিটিশ শাসনের
অবসানের পর একমাত্র সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত গণপরিষদকে ভেঙে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি হয়। এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে মৌলভী তমিজউদ্দিন খান সিন্ধু হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। হাইকোর্ট গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির রায় দেন যে, রীট মামলা দায়েরের কোনো এখতিয়ার নেই। তাঁর যুক্তি: – ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২২৩(ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে হাইকোর্টকে রীট এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। – কিন্তু এই সংশোধনীতে গভর্নর জেনারেলের স্বাক্ষর নেই, শুধু স্পিকারের স্বাক্ষর আছে—যা অসাংবিধানিক। অথচ: – পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নসহ সকল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা গণপরিষদের ওপর ন্যস্ত ছিল। – একই পদ্ধতিতে
৩৮টি আইন প্রণীত হয়েছিল। – প্রিভি কাউন্সিলের এখতিয়ার বিলোপ আইন (যা ফেডারেল কোর্টকে সর্বোচ্চ আদালত করেছিল)ও একইভাবে গৃহীত। – এই আইনের অধীনে বহু রীট মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়েছে—কোনো রায়েই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সার্বভৌম গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করেন। ফেডারেল কোর্ট এই অসাংবিধানিক কাজকে বৈধতা দেয়। ফলে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল—সর্বোচ্চ আদালত—সাংবিধানিক শূন্যতা ও চরম হতাশার জন্ম দেয়। সাংবিধানিক স্খলনের ধারাবাহিকতা এরপর সাংবিধানিক স্খলনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। রেফারেন্স মামলার রায় অনুযায়ী নতুন গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে, কিন্তু অজুহাতে পিছিয়ে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি
নির্ধারিত হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ষড়যন্ত্র করে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান মির্জাকে অপসারণ করে একক শাসক হন। বাংলার জনগণের বঞ্চনা ও প্রশ্ন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রে সর্বাধিক বঞ্চিত হয় বাংলার জনগণ। সামরিক আইনের দুঃশাসন, শোষণ, বৈষম্যের থাবায় প্রশ্ন ওঠে: সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” আওয়ামী লীগের ৬ দফা (১৯৬৬)-এর প্রথম দফা ছিল: “একজন মানুষ, একটি ভোট”। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন, আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি—সবই পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ১
মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও সংবিধানের মূলনীতি এই সংগ্রাম আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নতুন সংজ্ঞায়ন—যা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারনামা (ICCPR & ICESCR, ১৯৬৬)-এ স্বীকৃত। এর মাধ্যমে জনগণ: – রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করবে, – অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথ নির্ধারণ করবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের সংযোগ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর। এতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ়ভাবে অনুমোদিত। -১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি। – সংবিধানের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ১৫০(৩)-এ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি: **“স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল…” অষ্টম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী বলেন: “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো Constitution-এর Genesis” “Bangladesh Constitution is an autochthonous Constitution”(স্বয়ংসম্পূর্ণ, বহিরাগত প্রভাবমুক্ত)। সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য – মানবিক মর্যাদা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব—অন্য কোনো সংবিধানে এমন স্পষ্টভাবে নেই। – দুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারনামা (ICCPR & ICESCR)-এর মূলনীতি সংবিধানে সন্নিবেশিত। – নির্বাচন, জনপ্রতিনিধিত্ব, আইনের শাসনের মাধ্যমে নাগরিক, মানবিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা। সংবিধানের ভিত্তি রক্ষার সংগ্রাম বাংলার জনগণ বারবার অসাংবিধানিক পথে ছিনতাইয়ের বিপদ মাথায় নিয়ে জাগ্রত প্রহরীর মতো সংবিধান রক্ষা করে চলেছে। দু’বার (১৯৭৫ ও ১৯৮২) সামরিক ডিক্রির মাধ্যমে সংবিধানের ভিত্তি পরিবর্তন করা হয়েছে। অষ্টম সংশোধনী মামলায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের যুক্তি উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন (পৃ. ৩২৪): “Mr. M. Amir-Ul Islam has referred to the Proclamation of Independence… These fundamental principles were denied during Pakistan regime… and consequently these rights and principles have been enshrined in the Constitution as the solemn expression of the people’s will… and are intended to last for all time to come and not to be scrapped by any means including amendment of the Constitution.” [জনাব এম. আমির-উল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা উল্লেখ করেছেন… পাকিস্তান শাসনামলে এই মৌলিক নীতিগুলি অস্বীকার করা হয়েছিল… এবং ফলস্বরূপ এই অধিকার এবং নীতিগুলি জনগণের ইচ্ছার পবিত্র প্রকাশ হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে… এবং ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী হওয়ার জন্য এবং সংবিধান সংশোধন সহ কোনও উপায়ে বাতিল না করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।”] বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূল যুক্তি—জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের পটভূমি স্মরণ করলে আমরা সঠিকভাবে সংবিধান বুঝতে ও আত্মস্থ করতে সক্ষম হব।
দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ঠাঁই পেয়েছে: ১. যুক্তরাষ্ট্রের Declaration of Independence (৪ জুলাই ১৭৭৬), ২. বাংলাদেশের Proclamation of Independence (১০ এপ্রিল ১৯৭১)। এই দুটি দলিলের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে স্বাধীনতার সাংবিধানিক ভিত্তি। বাংলাদেশের জনগণের হাজার বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শাসকগোষ্ঠী বারবার ব্যাহত করেছে। কিন্তু জনগণ কখনো সে বাধা মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে অবিরাম সংগ্রাম। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়নের স্থান বলবৎ হয়েছে, যা আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। সকলকে জানান দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে: “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) অষ্টম সংশোধনী মামলা (১৯৮৯)-এ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রায়ের ৩২৫, ৩২৬ ও
৩২৭ পৃষ্ঠায় এই ঐতিহাসিক পটভূমির সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বিবরণ রয়েছে। এই পটভূমি না জানলে মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা অজানা থেকে যায় এবং সংবিধানের ওপর বারবার আঘাত (বিশেষত পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯ ও সপ্তম সংশোধনী ১৯৮৬)-এর প্রেক্ষাপট বোঝা অসম্ভব হয়। ব্রিটিশ শাসনোত্তর প্রথম আঘাত (১৯৫৪-১৯৫৮) ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও মুসলিম লীগের চরম পরাজয়ের পরও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ধূলিসাৎ করা হয়। নির্বাচিত আইনসভা ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গভর্নর শাসন জারি করা হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সবচেয়ে মারাত্মক স্খলন ঘটে ১৯৫৫ সালের মে মাসে—ব্রিটিশ শাসনের
অবসানের পর একমাত্র সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত গণপরিষদকে ভেঙে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি হয়। এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে মৌলভী তমিজউদ্দিন খান সিন্ধু হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। হাইকোর্ট গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির রায় দেন যে, রীট মামলা দায়েরের কোনো এখতিয়ার নেই। তাঁর যুক্তি: – ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২২৩(ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে হাইকোর্টকে রীট এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। – কিন্তু এই সংশোধনীতে গভর্নর জেনারেলের স্বাক্ষর নেই, শুধু স্পিকারের স্বাক্ষর আছে—যা অসাংবিধানিক। অথচ: – পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নসহ সকল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা গণপরিষদের ওপর ন্যস্ত ছিল। – একই পদ্ধতিতে
৩৮টি আইন প্রণীত হয়েছিল। – প্রিভি কাউন্সিলের এখতিয়ার বিলোপ আইন (যা ফেডারেল কোর্টকে সর্বোচ্চ আদালত করেছিল)ও একইভাবে গৃহীত। – এই আইনের অধীনে বহু রীট মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়েছে—কোনো রায়েই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সার্বভৌম গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করেন। ফেডারেল কোর্ট এই অসাংবিধানিক কাজকে বৈধতা দেয়। ফলে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল—সর্বোচ্চ আদালত—সাংবিধানিক শূন্যতা ও চরম হতাশার জন্ম দেয়। সাংবিধানিক স্খলনের ধারাবাহিকতা এরপর সাংবিধানিক স্খলনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। রেফারেন্স মামলার রায় অনুযায়ী নতুন গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে, কিন্তু অজুহাতে পিছিয়ে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি
নির্ধারিত হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ষড়যন্ত্র করে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান মির্জাকে অপসারণ করে একক শাসক হন। বাংলার জনগণের বঞ্চনা ও প্রশ্ন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রে সর্বাধিক বঞ্চিত হয় বাংলার জনগণ। সামরিক আইনের দুঃশাসন, শোষণ, বৈষম্যের থাবায় প্রশ্ন ওঠে: সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” আওয়ামী লীগের ৬ দফা (১৯৬৬)-এর প্রথম দফা ছিল: “একজন মানুষ, একটি ভোট”। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন, আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি—সবই পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ১
মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও সংবিধানের মূলনীতি এই সংগ্রাম আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নতুন সংজ্ঞায়ন—যা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারনামা (ICCPR & ICESCR, ১৯৬৬)-এ স্বীকৃত। এর মাধ্যমে জনগণ: – রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করবে, – অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথ নির্ধারণ করবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের সংযোগ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর। এতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ়ভাবে অনুমোদিত। -১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি। – সংবিধানের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ১৫০(৩)-এ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি: **“স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল…” অষ্টম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী বলেন: “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো Constitution-এর Genesis” “Bangladesh Constitution is an autochthonous Constitution”(স্বয়ংসম্পূর্ণ, বহিরাগত প্রভাবমুক্ত)। সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য – মানবিক মর্যাদা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব—অন্য কোনো সংবিধানে এমন স্পষ্টভাবে নেই। – দুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারনামা (ICCPR & ICESCR)-এর মূলনীতি সংবিধানে সন্নিবেশিত। – নির্বাচন, জনপ্রতিনিধিত্ব, আইনের শাসনের মাধ্যমে নাগরিক, মানবিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা। সংবিধানের ভিত্তি রক্ষার সংগ্রাম বাংলার জনগণ বারবার অসাংবিধানিক পথে ছিনতাইয়ের বিপদ মাথায় নিয়ে জাগ্রত প্রহরীর মতো সংবিধান রক্ষা করে চলেছে। দু’বার (১৯৭৫ ও ১৯৮২) সামরিক ডিক্রির মাধ্যমে সংবিধানের ভিত্তি পরিবর্তন করা হয়েছে। অষ্টম সংশোধনী মামলায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের যুক্তি উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন (পৃ. ৩২৪): “Mr. M. Amir-Ul Islam has referred to the Proclamation of Independence… These fundamental principles were denied during Pakistan regime… and consequently these rights and principles have been enshrined in the Constitution as the solemn expression of the people’s will… and are intended to last for all time to come and not to be scrapped by any means including amendment of the Constitution.” [জনাব এম. আমির-উল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা উল্লেখ করেছেন… পাকিস্তান শাসনামলে এই মৌলিক নীতিগুলি অস্বীকার করা হয়েছিল… এবং ফলস্বরূপ এই অধিকার এবং নীতিগুলি জনগণের ইচ্ছার পবিত্র প্রকাশ হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে… এবং ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী হওয়ার জন্য এবং সংবিধান সংশোধন সহ কোনও উপায়ে বাতিল না করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।”] বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূল যুক্তি—জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের পটভূমি স্মরণ করলে আমরা সঠিকভাবে সংবিধান বুঝতে ও আত্মস্থ করতে সক্ষম হব।



