নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ: বাংলাদেশের নীরব দুর্যোগ! – ইউ এস বাংলা নিউজ




নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ: বাংলাদেশের নীরব দুর্যোগ!

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ১ মে, ২০২৫ | ৫:০১ 6 ভিউ
আন্তর্জাতিক শব্দসচেতনতা দিবস। প্রতিবছর ৩০ এপ্রিল সারা বিশ্বে শব্দদূষণ কমাতে ও সচেতনতা সৃষ্টি লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হয়েছে। দিনটি ঘিরে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, র‌্যালি, সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম করা হয়। কিন্তু কথা হলো- আমরা কতটুকু সচেতন হচ্ছি? বাংলাদেশে শব্দদূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানো, অযথা গাড়ির হর্ন, নির্মাণস্থলে ও শিল্পকারখানায় উচ্চ যান্ত্রিক শব্দ—এসবই শহর জীবনের নিত্যদিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে শব্দের মাত্রা নিরাপদ সীমা বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণযুক্ত শহর। ঢাকার গড় শব্দমাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। এর পরে রয়েছে রাজশাহী, যেখানে গড় মাত্রা ১০৩ ডেসিবেল। এই মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। সংস্থাটি আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা রাখার সুপারিশ করেছে। ২০১৮ সালে ডব্লিউএইচও নিরাপদ শব্দসীমা ৫৩ ডেসিবেলে নামিয়ে আনে, যা বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। শব্দদূষণ শরীরের যেসব ক্ষতি করে ডব্লিউএইচওর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ৫ শতাংশের বেশি মানুষ শব্দদূষণ-জনিত সমস্যায় ভুগছেন। নিরাপদ শব্দমাত্রা ধরা হয় ৫৫ ডেসিবেল। ৬৫ ডেসিবেলের বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে; ৯০ ডেসিবেলের বেশি হলে আলসার, শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং

স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে। ১২০ ডেসিবেলে শব্দ শ্রবণযন্ত্রের ক্ষতি ও ব্যথার কারণ হয়। দীর্ঘমেয়াদে উচ্চমাত্রার শব্দে স্ট্রেস, উদ্বেগ, ঘুমের ব্যাঘাত, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। শব্দদূষণে শিশুদের বেশি ক্ষতি হয়। কেননা শিশুরা শব্দের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। উচ্চশব্দের কারণে তাদের মনোযোগ ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের শব্দ দূষণের কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি ও ডিমেনশিয়ার মতো সমস্যা আরও দ্রুত বাড়তে পারে। শুধু মানুষ নয়, শব্দ দূষণ বন্যপ্রাণীর ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রাণীরা তাদের টিকে থাকার জন্য শব্দের ওপর নির্ভর করে। অতিরিক্ত শব্দ তাদের আবাস পরিবর্তনে বাধ্য করে এবং প্রজনন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। জলজ পরিবেশে শিল্প ও জাহাজের শব্দ ডলফিন ও তিমির মতো

প্রাণীর চলাচল ও শিকারে ব্যাঘাত ঘটায়। আইন কী বলে? বাংলাদেশে ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা। এ বিধিমালায় পাঁচটি জোন নির্ধারণ করা হয়েছে: নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক এবং শিল্প এলাকা। প্রত্যেকটি জোনের জন্য দিন ও রাতের শব্দমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নীরব এলাকায় (যেমন হাসপাতাল, স্কুল ও অফিস এবং এর আশপাশের ১০০ মিটার) দিনে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এখানে হর্ন বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবাসিক এলাকার জন্য দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান- যেমন বিয়ে, কনসার্ট, মেলা ও খেলাধুলার জন্য বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে দিনে পাঁচ ঘণ্টা

পর্যন্ত এবং রাত ১০টা পর্যন্ত শব্দমাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। এই সীমা লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব বিধিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল। সরকারি কর্মকাণ্ড ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য নিয়মের ছাড় রয়েছে। ফলে সাইরেন, হর্ন এবং লাউডস্পিকার প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ২০২৫ সালের নববর্ষ উদযাপনের সময় ৯৯৯ জরুরি সেবায় ১,০০০-এর বেশি শব্দ দূষণের অভিযোগ জানানো হলেও মাত্র কিছু অভিযোগের ওপর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে শব্দদূষণ আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শব্দের উৎস যন্ত্রপাতি জব্দ করতে পারবেন। বিধিমালায় যেসব উল্লেখ করা রয়েছে তা পালনে ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। শব্দদূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত

হলে প্রথম অপরাধের জন্য একমাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দু ধরনের দণ্ডই প্রদান করার বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার কথা বলা রয়েছে। কেউ শব্দদূষণের শিকার এমন মনে করলে টেলিফোনে, লিখিত অথবা মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন। প্রয়োজন সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ জনসচেতনতার অভাবও শব্দদূষণ রোধে বড় সমস্যা। বেশিরভাগ মানুষ শব্দদূষণ বিধিমালা, অনুমোদিত শব্দমাত্রা, অভিযোগ করার পদ্ধতি বা অনুমতি নেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে অবগত নন। আইন নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কোনো বড় পরিসরের প্রচারণা নেই। ফলে শুধু দুর্বল প্রয়োগই নয়, জনসচেতনতার অভাবও আইনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের

অংশগ্রহণ, শিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রচারণা অত্যন্ত জরুরি। মানুষ যদি শব্দদূষণের ঝুঁকি ও আইনি সীমা সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে তারা আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে ও আইনের প্রয়োগে সহায়তা করতে উৎসাহী হবে। এছাড়া আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি। জরিমানা বৃদ্ধি, শব্দদূষণের তাৎক্ষণিক মনিটরিং, হর্ন ও লাউডস্পিকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও হর্ন ও বাসাবাড়ির উচ্চ শব্দ নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। শব্দদূষণ রোধে প্রযুক্তির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ- শব্দ প্রতিরোধী দেয়াল স্থাপন, অপেক্ষাকৃত কম শব্দের যানবাহন ব্যবহার ও হাসপাতাল-স্কুল এলাকায় নিরব জোন নিশ্চিত করা দরকার। শহর পরিকল্পনায় শব্দ কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বিল্ডিং বানানোর সময় শব্দ প্রতিরোধের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। জনসমাবেশে অপেক্ষাকৃত কম শব্দের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আতশবাজি ও অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বাংলাদেশে শব্দদূষণ দ্রুত একটি ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে, যা জনস্বাস্থ্য, বন্যপ্রাণী ও জীবনমানের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এই সংকট সমাধানে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। কঠোর আইন প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা একটি শান্ত, সুস্থ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
বাঘারপাড়ায় বিদ্যালয় ভবনে রডের বদলে বাঁশের চটা সস্তা শ্রমের তিন খাতই অর্থনীতির মেরুদণ্ড আজ মহান মে দিবস প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই বিএনপির মিত্ররা এক ডলারে ফেরত আসে ২৫ ডলার গচ্চা যাচ্ছে ৫শ কোটি টাকা সংস্কারের অনেক সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য নয় মধ্যরাতে জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সহপাঠীদের হাতে খুন হলো খুদে ক্রিকেটার রাহাত প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি, প্রস্তুতি না রাখা আত্মঘাতী কাপ্তাই হ্রদে ৩ মাস মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা বিসিএসে চিকিৎসকদের বয়সসীমা ৩৪ বছরসহ ৮ দফা দাবি দ্বিতীয় দিনে ঢাকা ছাড়লেন ৫২০০ হজযাত্রী প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপনে তিতাসের সতর্কবার্তা দাম কমল জ্বালানি তেলের নেইমারদের ‘লাল জার্সি’ নিয়ে ব্রাজিলজুড়ে তোলপাড় দক্ষিণ এশিয়া বিনাশী ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ মা পাকিস্তানি, সন্তান ভারতীয়: রাজনীতির নির্মম বলি নয় মাসের শিশুর ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ: বাংলাদেশের নীরব দুর্যোগ!