
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর

‘মালয়েশিয়ায় আটক ৩৬ বাংলাদেশি আইএসের সঙ্গে যুক্ত’

নিউইয়র্কে জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী এবং শাহরিয়ার কবিরের মুক্তির দাবি

গ্রেনেড বিস্ফোরণে রুশ বিমান কমান্ডার নিহত

‘বোতল নিক্ষেপের ঘটনাটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল না’

শিল্পের গ্যাস দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, দিশেহারা কারখানা মালিকরা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নিতে পারে?

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কারখানাতেই শ্রমিকের ‘আত্মহত্যা’
লুটপাটে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সাভারের ট্যানারি শিল্প

ঢাকার সাভারে ট্যানারি শিল্পে সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এই খাত থেকে প্রায় ৪৭৬ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ১২ দফায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সিইটিপি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫৪৭ কোটি টাকা। যেখান থেকে ৮৭.২ শতাংশ টাকা লুটপাট করা হয়। সে হিসাবে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ১২.৮ শতাংশ টাকা। আবার সিইটিপির ধারণ ক্ষমতা কাগজে-কলমে ২৫ হাজার কিউবিক মিটার রয়েছে, বাস্তবে ধারণ ক্ষমতা ১৪ হাজার কিউবিক মিটার। ফলে ১১ হাজার কিউবিক মিটার ক্রোমিয়ামযুক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলতে হচ্ছে। ট্যানারির তরল বর্জ্যে আশপাশের পরিবেশ ও নদী দূষণের ফলে ট্যানারি মালিকরা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করতে
ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার মধ্যে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ১ হাজার কিউবিক মিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি প্রস্তুত করেছে। এই হিসাব অনুযায়ী ১৪ হাজার কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি করতে ৭০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। বড় প্ল্যান্ট হওয়ার কারণে তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি আরও ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই হিসাবে মোট ব্যয় আসে ১৭০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৩৭৭ কোটি টাকা কোথায় গেল? অথচ প্রকল্প থেকে বরাদ্দের ৫৪৭ কোটি টাকাই ব্যয় দেখানো হয়েছে। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সাভারের চামড়া শিল্প ট্যানারি প্রায় ধ্বংসের পথে। তাদের মতে, বিসিকের ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিতে হচ্ছে শিল্পটিকে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের সময়
বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী নিশ্চিত করা হয়েছে। হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর হলে ইউরোপের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যাবে। পাওয়া যাবে এলডব্লিউজির সনদও। চামড়ার দামও অনেক বেশি পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এসব আশ্বাসে বিশ্বাস করেই হাজারীবাগ থেকে কারখানা স্থানান্তর করে সাভারে যান তারা। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। আরব লেদারের স্বত্বাধিকারী মো. ইলিয়াসুর রহমান বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল সাভারে গেলে ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে পারব, বিদেশি ক্রেতারা আসবে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে ব্যবসাই বন্ধ হওয়ার পথে। এসবের মূল কারণ সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এখানে ধাপে ধাপে অনেকেই ভুল করেছে। প্রথমত, বুয়েট সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি। যেমন, হাজারীবাগে কী পরিমাণ তরল বর্জ্য ও কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হতো তার পরিমাপ করা। সাভারে কী পরিমাণ বর্জ্য হবে তারও একটি প্রাথমিক ধারণা নেওয়া উচিত ছিল। হিসাব-নিকাশ না করে সাভারের প্ল্যান্টে ১২ হাজার কিউবিক মিটার রিপ্লায়ার হবে বলে জানানো হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শুরু করা হলে তখন জানানো হয় ২৫ হাজার কিউবিক মিটারের সিইটিপি করতে হবে। তারা ২৫ হাজার কিউবিক মিটার ক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি নির্মাণ ব্যয়ও নিয়েছে। তিনি বলেন, কুরবানির মৌসুমে ৩০ হাজার কিউবিক মিটারের কাছাকাছি বা এর অধিক তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এছাড়া বছরজুড়ে ২০ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য হয়। বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতার যে সিইটিপি রয়েছে তা আমাদের ট্যানারির জন্য পর্যাপ্ত নয়। আমরা এই বিষয়টি ঠিক করার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কোনো লাভ হয়নি। সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ১৪ হাজারের যে সিইটিপি স্থাপন করেছে তাও ছিল অসম্পূর্ণ। পুরোপুরি সিইটিপি রান করতে পারেনি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই অবস্থাতেই সিইটিপি বিসিকের কাছে হস্তান্তর করে চীনে পাড়ি জমায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, পিডি ও বিসিক চেয়ারম্যান প্রশ্নবাণে পড়েন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন প্রকল্পে ভয়ংকর দুর্নীতির বিষয়ে, আবার কেউ সিইটিপির গুণগতমানের বিষয়ে। তবে এসব প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেছে। আজও উত্তর পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে
জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সিইটিপি পরিচালনার জন্য ২০২০ সালের ৩০ জুন ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে সিইটিপি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহিদ হাসান অনুদানের অর্থ ব্যয় শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব চেয়েছিলেন তিনি। এরপর বিসিকের কর্মকর্তারা ৩ মাসের মধ্যে জাহিদ হাসানকে ওই পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন। পরে চামড়া শিল্পনগরী, ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পের সাবেক পিডি জিতেন্দ্রনাথ পালকে সিইটিপি পরিচালনার খণ্ডকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মাস দুয়েক পর শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোস্তাক আহমেদ প্রায় দুই বছর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে মোস্তাক আহমেদ সাতক্ষীরার জেলা
প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। মোস্তাক আহমেদ দায়িত্ব পেয়ে অনুদানের ৩০ কোটি টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। অনুদানের ৩০.১১ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব চেয়ে এ প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুলাই ২০২১ হতে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত মোট ২৩টি খাতে এই টাকা ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে অর্থ লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রায় ১৩টি খাতে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়। খাতগুলো হলো-জনবল, সম্মানি ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, কমিটি মিটিং, যাতায়াত, পরিবহণ ভাড়া ইত্যাদি। সিইটিপির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় ও লেবার খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপক জায়গা রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজার জাভেদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ওই সময় সিইটিপি অচল থাকলেও মেশিনারিজ ছিল নতুন। তাই নতুন সিইটিপির মেশিনারিজ রিপ্লেস করা এটা হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। পাশাপাশি অনুদানের অর্থে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক যে পরিমাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে তা পরিষ্কার উদ্দেশ্যমূলক। এ বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, অনুদানের ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা প্রয়োজন অনুযায়ী ধাপে ধাপে ব্যয় করা হয়েছে। এসব ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব-নিকাশ বিল-ভাউচারে উল্লেখ রয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। এবিএস ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমাম হোসাইন বলেন, সিইটিপি অকার্যকর ও ধারণ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকার ফলে শুরু থেকে ক্রোমিয়ামযুক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলতে হচ্ছে। ফলে নদী ও পরিবেশ দুটোই ভয়ংকর দূষণের কবলে পড়েছে। ধলেশ্বরী নদীর জীববৈচিত্র্য এখন আর দৃষ্টিতে আসে না। দূষণের কারণে ট্যানারি মালিকরা এলডব্লিউজির সনদ অর্জন করতে না পারায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ব্যবসায়ীরা জায়গা নিতে পারেননি। ফলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার আয় হারাচ্ছে। শুধু সিইটিপির কারণে সাভারের চামড়া ব্যবসায়ীরা এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিসিকের পরিকল্পনায় ভুল ছিল উল্লেখ করে একটি কারখানার স্বত্বাধিকারী বলেন, বিসিকের সিইটিপির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি নির্গত হয় কারখানাগুলো থেকে। প্রতিটি কারখানায় যে ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে, সেটিও অপরিকল্পিত। হাজারীবাগে একেকটি ড্রেনের গভীরতা ছিল চার-পাঁচ ফুট। সাভারে তার অর্ধেকও নেই। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি যখন ছেড়ে দেওয়া হয় তখন ময়লা পানি সরাসরি নদীতে ফেলে দেয় সিইটিপির দায়িত্বরতরা। ফলে হাজারীবাগ থেকে যে নদীর দূষণ এড়াতে সাভারে এলো শিল্পনগরী, সে নদী দূষণ এখানেও হচ্ছে। সালমা লেদারের লেদার ইঞ্জিনিয়ার মো. মোস্তফা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির জন্য এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট প্রয়োজন। সংস্থাটির সনদ পাওয়ার প্রধান শর্ত হলো ট্যানারি পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া সাভারের চামড়া শিল্পনগরী ব্যর্থ হলেও সফল পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতার বানতলা চামড়া শিল্প কমপ্লেক্স। বাংলাদেশে এলডব্লিউজির সদস্য প্রতিষ্ঠান মাত্র তিনটি। অন্যদিকে ভারতে সংস্থাটির সদস্য পদ পেয়েছে ১৩৯টি প্রতিষ্ঠান। যার বেশিরভাগই কলকাতার বানতলা লেদার কমপ্লেক্সের। হাজারীবাগের প্রায় ৫০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত বানতলা এখন ভারতের মোট রপ্তানি চামড়ার ৫০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে।
ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার মধ্যে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ১ হাজার কিউবিক মিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি প্রস্তুত করেছে। এই হিসাব অনুযায়ী ১৪ হাজার কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি করতে ৭০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। বড় প্ল্যান্ট হওয়ার কারণে তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি আরও ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই হিসাবে মোট ব্যয় আসে ১৭০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৩৭৭ কোটি টাকা কোথায় গেল? অথচ প্রকল্প থেকে বরাদ্দের ৫৪৭ কোটি টাকাই ব্যয় দেখানো হয়েছে। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সাভারের চামড়া শিল্প ট্যানারি প্রায় ধ্বংসের পথে। তাদের মতে, বিসিকের ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিতে হচ্ছে শিল্পটিকে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের সময়
বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী নিশ্চিত করা হয়েছে। হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর হলে ইউরোপের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যাবে। পাওয়া যাবে এলডব্লিউজির সনদও। চামড়ার দামও অনেক বেশি পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এসব আশ্বাসে বিশ্বাস করেই হাজারীবাগ থেকে কারখানা স্থানান্তর করে সাভারে যান তারা। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। আরব লেদারের স্বত্বাধিকারী মো. ইলিয়াসুর রহমান বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল সাভারে গেলে ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে পারব, বিদেশি ক্রেতারা আসবে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে ব্যবসাই বন্ধ হওয়ার পথে। এসবের মূল কারণ সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এখানে ধাপে ধাপে অনেকেই ভুল করেছে। প্রথমত, বুয়েট সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি। যেমন, হাজারীবাগে কী পরিমাণ তরল বর্জ্য ও কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হতো তার পরিমাপ করা। সাভারে কী পরিমাণ বর্জ্য হবে তারও একটি প্রাথমিক ধারণা নেওয়া উচিত ছিল। হিসাব-নিকাশ না করে সাভারের প্ল্যান্টে ১২ হাজার কিউবিক মিটার রিপ্লায়ার হবে বলে জানানো হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শুরু করা হলে তখন জানানো হয় ২৫ হাজার কিউবিক মিটারের সিইটিপি করতে হবে। তারা ২৫ হাজার কিউবিক মিটার ক্ষমতাসম্পন্ন সিইটিপি নির্মাণ ব্যয়ও নিয়েছে। তিনি বলেন, কুরবানির মৌসুমে ৩০ হাজার কিউবিক মিটারের কাছাকাছি বা এর অধিক তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এছাড়া বছরজুড়ে ২০ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য হয়। বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতার যে সিইটিপি রয়েছে তা আমাদের ট্যানারির জন্য পর্যাপ্ত নয়। আমরা এই বিষয়টি ঠিক করার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কোনো লাভ হয়নি। সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ১৪ হাজারের যে সিইটিপি স্থাপন করেছে তাও ছিল অসম্পূর্ণ। পুরোপুরি সিইটিপি রান করতে পারেনি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই অবস্থাতেই সিইটিপি বিসিকের কাছে হস্তান্তর করে চীনে পাড়ি জমায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, পিডি ও বিসিক চেয়ারম্যান প্রশ্নবাণে পড়েন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন প্রকল্পে ভয়ংকর দুর্নীতির বিষয়ে, আবার কেউ সিইটিপির গুণগতমানের বিষয়ে। তবে এসব প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেছে। আজও উত্তর পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে
জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সিইটিপি পরিচালনার জন্য ২০২০ সালের ৩০ জুন ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে সিইটিপি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহিদ হাসান অনুদানের অর্থ ব্যয় শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব চেয়েছিলেন তিনি। এরপর বিসিকের কর্মকর্তারা ৩ মাসের মধ্যে জাহিদ হাসানকে ওই পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন। পরে চামড়া শিল্পনগরী, ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পের সাবেক পিডি জিতেন্দ্রনাথ পালকে সিইটিপি পরিচালনার খণ্ডকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মাস দুয়েক পর শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোস্তাক আহমেদ প্রায় দুই বছর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে মোস্তাক আহমেদ সাতক্ষীরার জেলা
প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। মোস্তাক আহমেদ দায়িত্ব পেয়ে অনুদানের ৩০ কোটি টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। অনুদানের ৩০.১১ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব চেয়ে এ প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুলাই ২০২১ হতে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত মোট ২৩টি খাতে এই টাকা ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে অর্থ লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রায় ১৩টি খাতে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়। খাতগুলো হলো-জনবল, সম্মানি ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, কমিটি মিটিং, যাতায়াত, পরিবহণ ভাড়া ইত্যাদি। সিইটিপির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় ও লেবার খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপক জায়গা রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজার জাভেদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ওই সময় সিইটিপি অচল থাকলেও মেশিনারিজ ছিল নতুন। তাই নতুন সিইটিপির মেশিনারিজ রিপ্লেস করা এটা হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। পাশাপাশি অনুদানের অর্থে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক যে পরিমাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে তা পরিষ্কার উদ্দেশ্যমূলক। এ বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, অনুদানের ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা প্রয়োজন অনুযায়ী ধাপে ধাপে ব্যয় করা হয়েছে। এসব ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব-নিকাশ বিল-ভাউচারে উল্লেখ রয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। এবিএস ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমাম হোসাইন বলেন, সিইটিপি অকার্যকর ও ধারণ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকার ফলে শুরু থেকে ক্রোমিয়ামযুক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলতে হচ্ছে। ফলে নদী ও পরিবেশ দুটোই ভয়ংকর দূষণের কবলে পড়েছে। ধলেশ্বরী নদীর জীববৈচিত্র্য এখন আর দৃষ্টিতে আসে না। দূষণের কারণে ট্যানারি মালিকরা এলডব্লিউজির সনদ অর্জন করতে না পারায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ব্যবসায়ীরা জায়গা নিতে পারেননি। ফলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার আয় হারাচ্ছে। শুধু সিইটিপির কারণে সাভারের চামড়া ব্যবসায়ীরা এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিসিকের পরিকল্পনায় ভুল ছিল উল্লেখ করে একটি কারখানার স্বত্বাধিকারী বলেন, বিসিকের সিইটিপির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি নির্গত হয় কারখানাগুলো থেকে। প্রতিটি কারখানায় যে ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে, সেটিও অপরিকল্পিত। হাজারীবাগে একেকটি ড্রেনের গভীরতা ছিল চার-পাঁচ ফুট। সাভারে তার অর্ধেকও নেই। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি যখন ছেড়ে দেওয়া হয় তখন ময়লা পানি সরাসরি নদীতে ফেলে দেয় সিইটিপির দায়িত্বরতরা। ফলে হাজারীবাগ থেকে যে নদীর দূষণ এড়াতে সাভারে এলো শিল্পনগরী, সে নদী দূষণ এখানেও হচ্ছে। সালমা লেদারের লেদার ইঞ্জিনিয়ার মো. মোস্তফা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির জন্য এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট প্রয়োজন। সংস্থাটির সনদ পাওয়ার প্রধান শর্ত হলো ট্যানারি পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া সাভারের চামড়া শিল্পনগরী ব্যর্থ হলেও সফল পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতার বানতলা চামড়া শিল্প কমপ্লেক্স। বাংলাদেশে এলডব্লিউজির সদস্য প্রতিষ্ঠান মাত্র তিনটি। অন্যদিকে ভারতে সংস্থাটির সদস্য পদ পেয়েছে ১৩৯টি প্রতিষ্ঠান। যার বেশিরভাগই কলকাতার বানতলা লেদার কমপ্লেক্সের। হাজারীবাগের প্রায় ৫০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত বানতলা এখন ভারতের মোট রপ্তানি চামড়ার ৫০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে।