
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর

বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বড় ছাঁটাই আসছে

পুলিশি বাধায় চারুকলার পর গেণ্ডারিয়াতেও পণ্ড ‘শরৎ উৎসব’: ১৯ বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ

দেশের সব বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি বেবিচকের

এ কেমন সংস্কার! দুদকের মামলার একদিন পরই আসামী উল্টো পুরস্কৃত, পেলেন আরও বড় দায়িত্ব

নৃশংস বর্বরতা আর নরকীয়তার ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল – নূরুল মজিদ হুমায়ূনের নিথর দেহে হাতকড়া লাগিয়ে।

ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ

শিশুদের ‘নোবেল’ শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত সাতক্ষীরার তরুণ সুদীপ্ত
রাজনৈতিক অস্থিরতায় রপ্তানিতে ধাক্কা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি: ভয়াবহ সংকটে অর্থনীতি

অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি নানা সংকটের মধ্যেও রপ্তানি খাত এতদিন কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। তবে এবার সেই ভরসার জায়গাটিও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। টানা দুই মাস ধরে দেশের রপ্তানি আয় কমছে। একই সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসা মূল্যস্ফীতিও আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ঋণের উচ্চ সুদে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে ব্যাংক খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক জটিল ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে যুক্ত হয়েছে লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, জ্বালানি ঘাটতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি নীতির ফলে অর্থনীতি ক্রমেই নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। শিল্প খাতে বহু প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, নতুন
বিনিয়োগও কার্যত স্থগিত। আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের স্থবিরতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বড় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন বা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকায়, যা জুলাই মাসের তুলনায় অল্প বৃদ্ধি পেলেও প্রবৃদ্ধি কার্যত স্থবির। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি শিল্প খাতের সম্প্রসারণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতি এখন অচলাবস্থার
দিকে যাচ্ছে। রপ্তানি খাত, যা এতদিন অর্থনীতির মূল ভরসা ছিল, সেখানেও নেমেছে ধস। চলতি অর্থবছরের শুরুতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা থাকলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি আয় প্রায় তিন শতাংশ কমে যায়, আর সেপ্টেম্বরে তা আরও ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস পায়। যদিও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১,২৩১ কোটি ডলারে—যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি—তবুও সাম্প্রতিক পতন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। বিপরীতে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও
প্রকৌশল খাত কিছুটা উন্নতি দেখিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশুল্ক, ইউরোপে ক্রয়চাহিদার হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই এ পতনের প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ রপ্তানির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে দেশের রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঋণের উচ্চ সুদে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৭ শতাংশের নিচে। আগস্টে এ হার দাঁড়ায় ৬.৩৫ শতাংশে—যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থগিত অবস্থায় আছে, পাশাপাশি অনেক চালু কারখানাও আংশিকভাবে
বন্ধ হয়ে পড়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর সীমিত ঋণ কার্যক্রমের কারণে বহু প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়ানোর পর ঋণের খরচ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদহার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। তবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগ আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।” বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এই প্রথমবার ঋণ প্রবৃদ্ধি এত নিচে নেমেছে। গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বিনিয়োগ প্রবাহে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ
সীমিত থাকায় তারা এখন প্রধানত সরকারি বন্ড ও বিল কেনাতেই মনোযোগী। এদিকে সেপ্টেম্বরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিশেষ করে সবজি ও কাঁচামরিচের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে, যা আগস্টের ৮.২৯ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬৪ শতাংশে, আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে তা ৮.৯৮ শতাংশ। শহর ও গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রেই এই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “বর্ষাকালের প্রভাব ও সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাঘাতের কারণে দামের এই বৃদ্ধি ঘটেছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়ার
ব্যবস্থা করা গেলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব।” বিবিএস জানিয়েছে, ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) নির্ধারণে ৭৪৯ শ্রেণির মধ্যে ৩৮৩ আইটেমের তথ্য বিবেচনা করা হয়, যেখানে খাদ্য, শিক্ষা, ইন্টারনেট, রেস্টুরেন্ট, বেভারেজ, তামাকজাত দ্রব্যসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান উচ্চ সুদহার ব্যবসাবান্ধব নয়। তারা দাবি করেছেন, আসন্ন মুদ্রানীতিতে সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা হোক। গত ৯ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএসহ ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব আলমগীর বলেন, “বর্তমানে দেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ১০-১১ শতাংশ মুনাফা করেন। এত উচ্চ সুদ ব্যবসার জন্য কার্যত অচলাবস্থা তৈরি করছে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।” তিনি আরও জানান, “বিনিয়োগ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে আমরা সুদের হার ধীরে ধীরে এক অঙ্কে নামিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছি। গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন, পরবর্তী মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর বিষয়টি প্রতিফলিত হবে।” বৈঠকে ব্যবসায়ীরা করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন কমিটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর অনুরোধ জানান। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পখাতের ব্যাংকিং জটিলতা নিরসনে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন, যা গভর্নর ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। চলতি বছরের আগস্টে দেশের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) সূচক সামান্য হ্রাস পেলেও, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ৫৯.১-এ পৌঁছেছে, যেখানে আগস্টে সূচক ছিল ৫৮.৩। সাধারণত সূচক ৫০-এর উপরে থাকলে তা সংশ্লিষ্ট খাতের সম্প্রসারণ নির্দেশ করে। অর্থাৎ, শিল্পখাত আবার দ্রুত সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে; পাশাপাশি কৃষি ও নির্মাণ খাতেও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, যদিও সেবা খাতের সম্প্রসারণ তুলনামূলকভাবে ধীর। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “নতুন বাজেট বাস্তবায়ন এবং অনুকূল আবহাওয়ার প্রভাবে কৃষি ও নির্মাণ খাতের কার্যক্রম বেড়েছে, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেবা খাত এখনো ধীরগতিতে চলছে।” এদিকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্তকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস—জুলাই ও আগস্টে—বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ১৯১ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে দেশের পণ্য রপ্তানি ১০.৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৯ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ, যার ফলে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৯ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রবাসী আয়ে ১৮.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে। রেমিট্যান্সের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও তথ্যে জানা যায়, আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ এবং সম্পদ–দায় সংক্রান্ত লেনদেনের ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশের বৈদেশিক খাত আগের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে। এর আগের অর্থবছরেই (২০২৪–২৫) তিন বছর পর প্রথমবারের মতো দেশের মোট পরিশোধ হিসাব (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) উদ্বৃত্তে ফেরে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, নমনীয় বিনিময় হার, এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে কৌশলগত কঠোরতা—এই চারটি কারণই বর্তমান ইতিবাচক প্রবণতার মূল চালিকা শক্তি।
বিনিয়োগও কার্যত স্থগিত। আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের স্থবিরতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বড় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন বা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকায়, যা জুলাই মাসের তুলনায় অল্প বৃদ্ধি পেলেও প্রবৃদ্ধি কার্যত স্থবির। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি শিল্প খাতের সম্প্রসারণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতি এখন অচলাবস্থার
দিকে যাচ্ছে। রপ্তানি খাত, যা এতদিন অর্থনীতির মূল ভরসা ছিল, সেখানেও নেমেছে ধস। চলতি অর্থবছরের শুরুতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা থাকলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি আয় প্রায় তিন শতাংশ কমে যায়, আর সেপ্টেম্বরে তা আরও ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস পায়। যদিও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১,২৩১ কোটি ডলারে—যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি—তবুও সাম্প্রতিক পতন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। বিপরীতে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও
প্রকৌশল খাত কিছুটা উন্নতি দেখিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশুল্ক, ইউরোপে ক্রয়চাহিদার হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই এ পতনের প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ রপ্তানির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে দেশের রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঋণের উচ্চ সুদে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৭ শতাংশের নিচে। আগস্টে এ হার দাঁড়ায় ৬.৩৫ শতাংশে—যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থগিত অবস্থায় আছে, পাশাপাশি অনেক চালু কারখানাও আংশিকভাবে
বন্ধ হয়ে পড়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর সীমিত ঋণ কার্যক্রমের কারণে বহু প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়ানোর পর ঋণের খরচ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদহার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। তবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগ আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।” বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এই প্রথমবার ঋণ প্রবৃদ্ধি এত নিচে নেমেছে। গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বিনিয়োগ প্রবাহে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ
সীমিত থাকায় তারা এখন প্রধানত সরকারি বন্ড ও বিল কেনাতেই মনোযোগী। এদিকে সেপ্টেম্বরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিশেষ করে সবজি ও কাঁচামরিচের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে, যা আগস্টের ৮.২৯ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬৪ শতাংশে, আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে তা ৮.৯৮ শতাংশ। শহর ও গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রেই এই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “বর্ষাকালের প্রভাব ও সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাঘাতের কারণে দামের এই বৃদ্ধি ঘটেছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়ার
ব্যবস্থা করা গেলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব।” বিবিএস জানিয়েছে, ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) নির্ধারণে ৭৪৯ শ্রেণির মধ্যে ৩৮৩ আইটেমের তথ্য বিবেচনা করা হয়, যেখানে খাদ্য, শিক্ষা, ইন্টারনেট, রেস্টুরেন্ট, বেভারেজ, তামাকজাত দ্রব্যসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান উচ্চ সুদহার ব্যবসাবান্ধব নয়। তারা দাবি করেছেন, আসন্ন মুদ্রানীতিতে সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা হোক। গত ৯ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএসহ ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব আলমগীর বলেন, “বর্তমানে দেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ১০-১১ শতাংশ মুনাফা করেন। এত উচ্চ সুদ ব্যবসার জন্য কার্যত অচলাবস্থা তৈরি করছে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।” তিনি আরও জানান, “বিনিয়োগ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে আমরা সুদের হার ধীরে ধীরে এক অঙ্কে নামিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছি। গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন, পরবর্তী মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর বিষয়টি প্রতিফলিত হবে।” বৈঠকে ব্যবসায়ীরা করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন কমিটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর অনুরোধ জানান। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পখাতের ব্যাংকিং জটিলতা নিরসনে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন, যা গভর্নর ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। চলতি বছরের আগস্টে দেশের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) সূচক সামান্য হ্রাস পেলেও, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ৫৯.১-এ পৌঁছেছে, যেখানে আগস্টে সূচক ছিল ৫৮.৩। সাধারণত সূচক ৫০-এর উপরে থাকলে তা সংশ্লিষ্ট খাতের সম্প্রসারণ নির্দেশ করে। অর্থাৎ, শিল্পখাত আবার দ্রুত সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে; পাশাপাশি কৃষি ও নির্মাণ খাতেও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, যদিও সেবা খাতের সম্প্রসারণ তুলনামূলকভাবে ধীর। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “নতুন বাজেট বাস্তবায়ন এবং অনুকূল আবহাওয়ার প্রভাবে কৃষি ও নির্মাণ খাতের কার্যক্রম বেড়েছে, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেবা খাত এখনো ধীরগতিতে চলছে।” এদিকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্তকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস—জুলাই ও আগস্টে—বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ১৯১ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে দেশের পণ্য রপ্তানি ১০.৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৯ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ, যার ফলে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৯ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রবাসী আয়ে ১৮.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে। রেমিট্যান্সের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও তথ্যে জানা যায়, আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ এবং সম্পদ–দায় সংক্রান্ত লেনদেনের ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশের বৈদেশিক খাত আগের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে। এর আগের অর্থবছরেই (২০২৪–২৫) তিন বছর পর প্রথমবারের মতো দেশের মোট পরিশোধ হিসাব (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) উদ্বৃত্তে ফেরে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, নমনীয় বিনিময় হার, এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে কৌশলগত কঠোরতা—এই চারটি কারণই বর্তমান ইতিবাচক প্রবণতার মূল চালিকা শক্তি।