ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
জামিন পেলেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার
আইনজীবী আলিফ হত্যার ভিডিও দেখে ৬ জনকে আটক
‘ইসকন’ বিশ্বের যেসব দেশে নিষিদ্ধ
দেশকে অস্থিতিশীল করার সর্বশেষ ট্রাম্পকার্ড খেলা হচ্ছে: আজহারী
জামা মসজিদ ঘিরে সংঘর্ষের দু’দিন পরে যে চিত্র দেখা গেছে
চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের বিবৃতির কড়া জবাব বাংলাদেশের
‘ইসকনের আন্দোলনে দেশি-বিদেশি ইন্ধন রয়েছে’
রাজনীতির হাতিয়ার হওয়া পুলিশ খুঁজছে ‘মনোবল’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ থানা ছেড়ে চলে গিয়েছিল পুলিশ। জনরোষ, বাহিনীর অধস্তনদের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, নিরাপত্তার অভাব ও মনোবল হারিয়ে প্রায় ৭২ ঘণ্টা পুলিশকে দেখা যায়নি মাঠে। বাহিনীর শীর্ষ কর্তারাও দিয়েছিলেন গা-ঢাকা। বেশ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন’।
তবে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব সদস্যকে নিজ নিজ ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশনা দিলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি। গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। বৈঠক শেষে রাতেই কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন
আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যরা। এদিকে পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। শিগগির এই প্রক্রিয়া শুরু হবে। সব মিলিয়ে পুলিশ সদস্যদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ জনআস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক দিন ধরেই পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। মানবাধিকার সমুন্নত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়েই পুলিশ আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে পুলিশের ভেতরে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করা হয়। একটি অংশের মধ্যে পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভ আছে। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে বেআইনি এবং অপেশাদার কাজ করছেন বারবার। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাহিনীর নন-ক্যাডার পদের সদস্যরা এরই
মধ্যে সংস্কারের দাবি তুলেছেন। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু বৈষম্যের বিষয় সামনে এনেছেন। তারা ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি না করা, বার্ষিক নৈমিত্তিক ছুটি ২০ দিনের বদলে ৬০ দিন করা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতো পন্থা গ্রহণ করা উল্লেখযোগ্য। এরই মধ্যে দাবি পূরণে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন নতুন পুলিশপ্রধান। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব থানা এলাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পরিদর্শক ও এসআই পদমর্যাদার দু’জন সদস্য বলেন, পুলিশের অনেক সদস্যের ভেতরে এখনও আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনার পর তাদের অনেক সহকর্মী আন্দোলনকারীর ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও
গুলি করে। যেসব এলাকায় তারা দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখান থেকে অন্যত্র তাদের বদলি করলে হয়তো কারও কারও ভয় দূর হতে পারে। এদিকে এসপি পদমর্যাদার আরও দু’জন কর্মকর্তা বলছেন, বাহিনীর অধস্তন সদস্যদের কাছে তারা অসম্মানজনক আচরণ পেতে পারেন, এমন শঙ্কা কারও কারও। অগ্নিকাণ্ডের পর স্থাপনার যে ধরনের ক্ষতিসাধন হয়েছে, মোটামুটি সংস্কার না করলে সেখানে বসে অফিস করা সম্ভব নয় বলে জানান এক পুলিশ সুপার। আরেক জেলার পুলিশ সুপার জানান, কম্পিউটারসহ নতুন সরঞ্জাম কিনে নতুনভাবে থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পুলিশের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবে জনআস্থা
ফেরানোই পুলিশের বড় চ্যালেঞ্জ। আর আইনবহির্ভূত কাজ না করলে ধীরে ধীরে পুলিশ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এখন দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে পুলিশকে দৃশ্যমান হতে হবে। পুলিশের এ পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদের কেউ কেউ পুলিশকে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে বাধ্য করেছেন। আবার পুলিশের কারও কারও ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক এই পুলিশপ্রধান বলেন, বিধি-বিধানের আলোকে পুলিশ বাহিনী সংস্কার হতে পারে। আবার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও তা হতে পারে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করা যাবে না। পুলিশের হাতে
দেওয়া হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র। তাদের এ অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পরে তিনি বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম, লোগো সব পরিবর্তন করা হবে। পুলিশের অনেকের মন ভেঙে গেছে। এই ইউনিফর্ম পরে পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হবে। পুলিশ সদস্যদের জন্য স্বাধীন একটি কমিশন গড়ে তোলার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুলিশ কমিশন হওয়া উচিত। সেই কমিশনের অধীনে পুলিশ পরিচালিত হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে
থাকবে না। পুলিশকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা সরকারের কাছে যেসব দাবি জানিয়েছিলাম তার বেশির ভাগ মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি। পুলিশ নিয়ে একটি স্বাধীন কমিশন হওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রংপুরের পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশ সুপারকে গতকাল বদলি করা হয়েছে। ৫৯৯ থানায় কার্যক্রম শুরু পুলিশ সদরদপ্তর থেকে জানানো হয়, গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৬৩৯টির মধ্যে ৫৯৯ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটনের ১১০ থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯ থানার মধ্যে ৫০২টির কাজ শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ থানা চলছে সীমিত পরিসরে। কিছু থানায় পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে গিয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। অনেক থানায় জিডি নেওয়া শুরু হয়েছে। কিছু থানা এখনও সুনসান। অনেক থানায় সেনাসদস্যদের সহায়তায় পুলিশ নৈমিত্তিক কাজ চালাচ্ছে। বিজিবি ও আনসার সদস্যরা পুলিশকে কোথাও সহায়তা দিচ্ছেন। আইনি সেবা নিতে থানায় যাচ্ছে মানুষ। তবে পুলিশি টহল ও অভিযান এখনও শুরু হয়নি। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে থানায় ফিরেছেন। থানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন সেনাসদস্যরা। ৪২ পুলিশ নিহত আন্দোলনে সহিংসতায় কতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে বাহিনীর ভেতরে কয়েক দিন ধরে নানা আলোচনা চলছে। তবে গতকাল পুলিশপ্রধান ময়নুল ইসলাম বলেন, ৪২ পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। তাদের মধ্যে পরিদর্শক তিনজন ও দু’জন র্যাব সদস্য রয়েছেন। আইজিপি বলেন, নিহত ছাড়াও আহত অসংখ্য। যারা আহত হয়েছেন, তাদের আমরা ফুল সাপোর্ট দিচ্ছি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, এরই মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ মাঠে রয়েছে। ‘চাঁদাবাজি করলে পা ভেঙে দেওয়া হবে’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আমি কোনো রাজনীতিবিদ না। একজন ফৌজ, যা বলি তা-ই করার চেষ্টা করি। আপনারা কেউ চাঁদাবাজি করবেন না। দখলবাজি করবেন না। যদি চাঁদাবাজি করেন, তাহলে পা ভেঙে দেওয়া হবে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে যারা কাজে যোগ দেবেন না, আমরা ধরে নেব, তারা চাকরি করবেন না। এ সময়ের মধ্যে যারা যোগ দেবেন না, তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। যা কিছু ঘটেছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। এতে কারও ভয়ের কিছু নেই। নির্দোষ কেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দেশের একটি রাজনৈতিক দলের কী করুণ অবস্থা হয়েছে, তা আপনারা দেখেছেন। যাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের গায়ে কেউ হাত দেবেন না। পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন নিশ্চয়। ডাকাতি হচ্ছে বা ডাকাতির ভয় পাচ্ছেন। বোঝার চেষ্টা করুন– পুলিশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চাটুকারিতা বাদ দেন বাংলাদেশের রাজনীতি চাটুকারদের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। বাংলাদেশে আর এ রাজনীতি চলবে না উল্লেখ করে চাটুকারদের বাদ দিতে রাজনীতিবিদদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল দুপুরে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, চাটুকারের দল দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। যেসব রাজনৈতিক দল আছে, এমনকি যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা আছেন, তাদের রাজনীতি চলবে। কিন্তু আপনারা অনুধাবন করেন, চাটুকার বাদ দেন। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটা দুঃখজনক। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ অনেক পুরোনো পার্টি। সেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তারা এ শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর হুকুমদাতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কারা পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দশ্যটা কী? যেটা হয়েছে এর আন্তর্জাতিক তদন্ত হবে। দেশি তদন্ত হবে। গণমাধ্যমও চাটুকারিতা করেছে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আপনারা (গণমাধ্যম) সত্যি ঘটনা তুলে ধরেন। সত্যি ঘটনা তুলে ধরলে পুলিশের এ অবস্থা হতো না। একটা দেশ ডোবে কখন, যখন গণমাধ্যম সত্যি কথা বলে না, মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে।
আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যরা। এদিকে পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। শিগগির এই প্রক্রিয়া শুরু হবে। সব মিলিয়ে পুলিশ সদস্যদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ জনআস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক দিন ধরেই পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। মানবাধিকার সমুন্নত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়েই পুলিশ আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে পুলিশের ভেতরে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করা হয়। একটি অংশের মধ্যে পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভ আছে। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে বেআইনি এবং অপেশাদার কাজ করছেন বারবার। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাহিনীর নন-ক্যাডার পদের সদস্যরা এরই
মধ্যে সংস্কারের দাবি তুলেছেন। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু বৈষম্যের বিষয় সামনে এনেছেন। তারা ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি না করা, বার্ষিক নৈমিত্তিক ছুটি ২০ দিনের বদলে ৬০ দিন করা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতো পন্থা গ্রহণ করা উল্লেখযোগ্য। এরই মধ্যে দাবি পূরণে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন নতুন পুলিশপ্রধান। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব থানা এলাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পরিদর্শক ও এসআই পদমর্যাদার দু’জন সদস্য বলেন, পুলিশের অনেক সদস্যের ভেতরে এখনও আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনার পর তাদের অনেক সহকর্মী আন্দোলনকারীর ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও
গুলি করে। যেসব এলাকায় তারা দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখান থেকে অন্যত্র তাদের বদলি করলে হয়তো কারও কারও ভয় দূর হতে পারে। এদিকে এসপি পদমর্যাদার আরও দু’জন কর্মকর্তা বলছেন, বাহিনীর অধস্তন সদস্যদের কাছে তারা অসম্মানজনক আচরণ পেতে পারেন, এমন শঙ্কা কারও কারও। অগ্নিকাণ্ডের পর স্থাপনার যে ধরনের ক্ষতিসাধন হয়েছে, মোটামুটি সংস্কার না করলে সেখানে বসে অফিস করা সম্ভব নয় বলে জানান এক পুলিশ সুপার। আরেক জেলার পুলিশ সুপার জানান, কম্পিউটারসহ নতুন সরঞ্জাম কিনে নতুনভাবে থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পুলিশের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবে জনআস্থা
ফেরানোই পুলিশের বড় চ্যালেঞ্জ। আর আইনবহির্ভূত কাজ না করলে ধীরে ধীরে পুলিশ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এখন দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে পুলিশকে দৃশ্যমান হতে হবে। পুলিশের এ পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদের কেউ কেউ পুলিশকে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে বাধ্য করেছেন। আবার পুলিশের কারও কারও ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক এই পুলিশপ্রধান বলেন, বিধি-বিধানের আলোকে পুলিশ বাহিনী সংস্কার হতে পারে। আবার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও তা হতে পারে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করা যাবে না। পুলিশের হাতে
দেওয়া হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র। তাদের এ অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পরে তিনি বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম, লোগো সব পরিবর্তন করা হবে। পুলিশের অনেকের মন ভেঙে গেছে। এই ইউনিফর্ম পরে পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হবে। পুলিশ সদস্যদের জন্য স্বাধীন একটি কমিশন গড়ে তোলার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুলিশ কমিশন হওয়া উচিত। সেই কমিশনের অধীনে পুলিশ পরিচালিত হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে
থাকবে না। পুলিশকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা সরকারের কাছে যেসব দাবি জানিয়েছিলাম তার বেশির ভাগ মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি। পুলিশ নিয়ে একটি স্বাধীন কমিশন হওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রংপুরের পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশ সুপারকে গতকাল বদলি করা হয়েছে। ৫৯৯ থানায় কার্যক্রম শুরু পুলিশ সদরদপ্তর থেকে জানানো হয়, গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৬৩৯টির মধ্যে ৫৯৯ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটনের ১১০ থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯ থানার মধ্যে ৫০২টির কাজ শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ থানা চলছে সীমিত পরিসরে। কিছু থানায় পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে গিয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। অনেক থানায় জিডি নেওয়া শুরু হয়েছে। কিছু থানা এখনও সুনসান। অনেক থানায় সেনাসদস্যদের সহায়তায় পুলিশ নৈমিত্তিক কাজ চালাচ্ছে। বিজিবি ও আনসার সদস্যরা পুলিশকে কোথাও সহায়তা দিচ্ছেন। আইনি সেবা নিতে থানায় যাচ্ছে মানুষ। তবে পুলিশি টহল ও অভিযান এখনও শুরু হয়নি। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে থানায় ফিরেছেন। থানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন সেনাসদস্যরা। ৪২ পুলিশ নিহত আন্দোলনে সহিংসতায় কতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে বাহিনীর ভেতরে কয়েক দিন ধরে নানা আলোচনা চলছে। তবে গতকাল পুলিশপ্রধান ময়নুল ইসলাম বলেন, ৪২ পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। তাদের মধ্যে পরিদর্শক তিনজন ও দু’জন র্যাব সদস্য রয়েছেন। আইজিপি বলেন, নিহত ছাড়াও আহত অসংখ্য। যারা আহত হয়েছেন, তাদের আমরা ফুল সাপোর্ট দিচ্ছি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, এরই মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ মাঠে রয়েছে। ‘চাঁদাবাজি করলে পা ভেঙে দেওয়া হবে’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আমি কোনো রাজনীতিবিদ না। একজন ফৌজ, যা বলি তা-ই করার চেষ্টা করি। আপনারা কেউ চাঁদাবাজি করবেন না। দখলবাজি করবেন না। যদি চাঁদাবাজি করেন, তাহলে পা ভেঙে দেওয়া হবে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে যারা কাজে যোগ দেবেন না, আমরা ধরে নেব, তারা চাকরি করবেন না। এ সময়ের মধ্যে যারা যোগ দেবেন না, তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। যা কিছু ঘটেছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। এতে কারও ভয়ের কিছু নেই। নির্দোষ কেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দেশের একটি রাজনৈতিক দলের কী করুণ অবস্থা হয়েছে, তা আপনারা দেখেছেন। যাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের গায়ে কেউ হাত দেবেন না। পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন নিশ্চয়। ডাকাতি হচ্ছে বা ডাকাতির ভয় পাচ্ছেন। বোঝার চেষ্টা করুন– পুলিশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চাটুকারিতা বাদ দেন বাংলাদেশের রাজনীতি চাটুকারদের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। বাংলাদেশে আর এ রাজনীতি চলবে না উল্লেখ করে চাটুকারদের বাদ দিতে রাজনীতিবিদদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল দুপুরে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, চাটুকারের দল দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। যেসব রাজনৈতিক দল আছে, এমনকি যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা আছেন, তাদের রাজনীতি চলবে। কিন্তু আপনারা অনুধাবন করেন, চাটুকার বাদ দেন। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটা দুঃখজনক। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ অনেক পুরোনো পার্টি। সেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তারা এ শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর হুকুমদাতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কারা পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দশ্যটা কী? যেটা হয়েছে এর আন্তর্জাতিক তদন্ত হবে। দেশি তদন্ত হবে। গণমাধ্যমও চাটুকারিতা করেছে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আপনারা (গণমাধ্যম) সত্যি ঘটনা তুলে ধরেন। সত্যি ঘটনা তুলে ধরলে পুলিশের এ অবস্থা হতো না। একটা দেশ ডোবে কখন, যখন গণমাধ্যম সত্যি কথা বলে না, মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে।