ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
রাজপথে নেই আওয়ামী লীগ, তবুও ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব সমর্থন
ঢাকা লকডাউন: গণপরিবহন সংকটে যাত্রীদের ভোগান্তি
এবার হংকং ভিত্তিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে সাক্ষাৎকার দিলেন শেখ হাসিনা
দিল্লীতে বিস্ফোরণ: তদন্তে বাংলাদেশি সংযোগের ইঙ্গিত ভারতের
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে
সরকার উৎখাতের ‘এলজিবিটি ষড়যন্ত্র
ইউনুস সরকারের কাউন্টডাউন শুরু, পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে
মিউচুয়াল ফান্ড: সম্ভাবনা হারাচ্ছে সমস্যার অতলে
শেয়ারবাজারে ব্যক্তির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মিউচুয়াল ফান্ড অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও বাংলাদেশে তা একেবারেই নয়। কিছু সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির যথেচ্ছ ও অপেশাদার বিনিয়োগ আচরণ, তহবিল ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতায় ডুবেছে এ খাত। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা পেলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও অন্য রকম হতে পারত।
অধিকাংশ ফান্ড ব্যাংক সুদহারের সমপরিমাণও মুনাফা দিতে পারছে না। সম্পদ মূল্য বাড়ানো তো দূরের কথা, বিনিয়োগ করা অর্থও ধরে রাখতে পারেনি সম্পদ ব্যবস্থাপকরা। এমনকি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেয়াদি ফান্ডের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে বিনিয়োগ ফিরিয়ে না দেওয়ারও খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে দেশে।
শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর পেশাদার আচরণের বিপরীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (বিএসইসি) কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি। বিনিয়োগকারীদের অর্থ
তছরুপের ঘটনা উদ্ঘাটনের পর তা পুনরুদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেই। স্বাভাবিক কারণে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। চার দশকে মিউচুয়াল ফান্ড খাত : সেই আশির দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির মাধ্যমে দেশে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রচলন শুরু। ১৯৯৯ সালে এইমস বাংলাদেশ নামে বেসরকারি খাতে প্রথম সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি যাত্রা শুরু করে দেশে। ২০০৮ সালের পর বেসরকারি খাতে কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির হাত ধরে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি হয়। এখন পর্যন্ত মোট ৬৭টি প্রতিষ্ঠান সম্পদ ব্যবস্থাপকের নিবন্ধন নিয়েছে। তবে উল্লেখ করার মতো সম্পদ নিয়ে সক্রিয় প্রতিষ্ঠান ২০টির বেশি নয়। নিবন্ধিত সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে ৩৭ মেয়াদি এবং
৯৭টি বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড। ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বিবেচনায় এই ১৩৪টি ফান্ডের বর্তমান ইউনিট সংখ্যা প্রায় ৯১২ কোটি। সম্মিলিত মূলধন প্রায় ৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সর্বশেষ প্রকাশিত সম্পদ মূল্য অনুযায়ী ফান্ডগুলোর সম্পদ মূল্য প্রায় ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে অনেক ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক যে সম্পদ মূল্য দেখাচ্ছেন, তা প্রকৃতই আছে কিনা, তা নিয়ে খোদ বিএসইসি ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কর্মকর্তাদের সন্দেহ আছে। উল্লিখিত পরিসংখ্যানে অবশ্য আইসিবির অধীনে পরিচালিত আইসিবি ইউনিট ফান্ডের হিসাব নেই। এ ফান্ডের অধীনে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ মূল্য আছে। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের ফান্ডটির সম্পদ মূল্য ২১২ টাকা। এখন পর্যন্ত এ
ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে ভালো মুনাফা দিচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট পরিশোধিত মূলধন ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। কাগুজে হিসাবে ফান্ডগুলোর সম্পদ মূল্য ৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। স্টক এক্সচেঞ্জে ইউনিটপ্রতি বাজারদরে ফান্ডগুলোর সম্মিলিত মূল্য ২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বিনিয়োগ মূল্যের ওপর লোকসান অর্ধেকের বেশি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পরিশোধিত মূলধন বিবেচনায় মেয়াদি ফান্ডগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধন (বন্ড বাদে) তালিকাভুক্ত ৩৯৭ সিকিউরিটিজের মোট মূলধনের ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে বাজার মূলধনে এই ফান্ডগুলোর অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ফান্ড ৩ টাকা
দরেও কেনাবেচা হচ্ছে। মাত্র দুটি ছাড়া সব ফান্ড মূলধন হারিয়েছে। তুলনামূলক ভালো চিত্র দেখা যায় বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে। অভিহিত মূল্যের হিসাবে আইসিবি ইউনিট ফান্ড ব্যতীত ৯৭টি বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট মূলধন প্রায় ৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এগুলোর অধীনে মোট সম্পদের মূল্য ৫ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। মূলধনের তুলনায় ৫০টি ফান্ডের সম্পদ মূল্য বেশি এবং ৪৭টির কম। এ অবস্থার কারণ পেশাদার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নেওয়া হলেও বাস্তবে প্রকৃত পেশাদারিত্বের ছাপ নেই বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিনিয়োগ কার্যক্রমে। গবেষণা এবং বাজারের ধরন অনুযায়ী বিনিয়োগ হচ্ছে না। কোনো কোনো ফান্ডে অর্ধশত থেকে শতাধিক শেয়ারে বিনিয়োগ
দেখা যায়। এক ফান্ড থেকে একই সম্পদ ব্যবস্থাপকের অন্য ফান্ডে বিনিয়োগ রয়েছে। সহজ মুনাফা করতে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিওতে বিনিয়োগে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা দেখা গেছে। মুনাফা দেখাতে ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে নিজের এক ফান্ড থেকে অন্য ফান্ডের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। তারপরও ব্যাংক বা সরকারি বন্ডের মতো ফিক্সড ইনকাম বিনিয়োগের তুলনায় কিছুটা বেশি মুনাফা আশায় যারা সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন, তাদের ভালো মুনাফা তো দিতেই পারেনি, বাড়াতে পারেনি সম্পদ মূল্য, উল্টো সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়া সম্পদ মূল্য কমে গেছে। এমন মত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমনের। তিনি বলেন, সমস্যা কোথায়, কারা কীভাবে সমস্যা তৈরি করেছে, শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট
সবাই এর কম-বেশি জানেন। সমাধানে উদ্যোগ নেই। অব্যবস্থাপনা শুধু মিউচুয়াল ফান্ড খাতে, বিষয়টি এমন নয়। পুরো শেয়ারবাজার বা সার্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাব দেখা যায়, এটা তার একটা অংশ। যাদের এসব আটকানোর কথা ছিল, তারা আটকাননি। প্রায় একই কথা প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের। তিনি বলেন, টাকা হাতে পাওয়ার পর কিছু সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ওই টাকাকে নিজের বলে মনে করেছে। যখন ভালো ফল মিলছে না, তখন ইউনিটহোল্ডারদের সিদ্ধান্তের পর সর্বোচ্চ আদালতও সম্পদ ব্যবস্থাপক পরিবর্তনে রায় দিয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। ১০ বছরের ফান্ডের মেয়াদ ইউনিটহোল্ডারদের অনুমতি ছাড়া বিশেষ সম্পদ ব্যবস্থাপকের অনুরোধে খোদ মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িয়ে ২০ বছর করতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তা-ই করেছে। আইনে আছে ফান্ডের তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কিছু ফান্ড ম্যানেজার তা করেনি। ট্রাস্টি জানে না, সম্পদ ব্যবস্থাপক কী করছে। ফিক্সড ইনকাম ফান্ডের কথা বলে শেয়ারে বিনিয়োগ হয়েছে। এটা এক ধরনের প্রতারণা। এই প্রতারণা বছরের পর বছর ধরে চলেছে। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা। আইসিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ফান্ডগুলোতে যেসব শেয়ার কেনা রয়েছে, তা আবর্জনা ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, বাজার জুয়াড়ি চক্রের শেয়ার এসব ফান্ডে ‘ডাম্পিং’, ‘পার্কিং’ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে যাকে-তাকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। পেশাদারিত্বের লক্ষণ নেই। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে, ২০১০ সালের পরের ধসে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটাতে না পারায় সমস্যা বেড়েছে। এটা একটা কারণ অবশ্যই। তবে বিনিয়োগ দক্ষতা ছাড়াই যেভাবে বিনিয়োগ করেছে, তা তারা স্বীকার করে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের কারণ: শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের দুরবস্থার দায় কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির। তবে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা, নীতিনির্ধারকসহ কেউই এড়াতে পারেন না। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের মতে, সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাবে নানা অনিয়ম হয়েছে। এটাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে প্রধান বাধা। মিউচুয়াল ফান্ডের আয়-ব্যয়ের হিসাব, সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন এবং সময়মতো লভ্যাংশ প্রদানে গড়িমসি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবও বড় কারণ। বেশ কিছু মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে অধিকাংশ মিউচুয়াল ফান্ড বাজারের গড় রিটার্ন থেকে পিছিয়ে। মানুষ বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফার আশায়। অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যমের তুলনায় মিউচুয়াল ফান্ডে রিটার্ন অনেক কম হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সরাসরি শেয়ার কেনায় বেশি আগ্রহী। অল্প কিছু ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফান্ডের রিটার্ন যেখানে ৫ শতাংশের কম, সেখানে ব্যাংকে আমানত রেখে এখন ১০ শতাংশ বা তারও বেশি সুদ মিলছে। অধিকাংশ সম্পদ ব্যবস্থাপকের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার বিপরীতে কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো মুনাফা ও বাজারের তুলনায় সম্পদ বাড়াতে পারছে। ১৫-২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার পাশাপাশি সম্পদ মূল্যও বেড়েছে কিছু ফান্ডের। তারপরও সেসব সম্পদ ব্যবস্থাপক ভালো বিনিয়োগ পাচ্ছে না। এর একটি কারণ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক জ্ঞানের অভাব। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী করার জন্য ভালো নীতি-প্রণোদনাও নেই। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ছাড়সহ অন্যান্য প্রণোদনা দিতে পারে। এটি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি : সংশ্লিষ্টদের মতে, মানুষের আস্থা অর্জনে মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিভিডেন্ড প্রদানের সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত। পেশাদার ফান্ড ম্যানেজার নিয়োগ এবং মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যারা ভালো করতে পারবে না, তাদের নিবন্ধন বাতিল করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা মিউচুয়াল ফান্ডের রিটার্ন বাড়াতে সহায়ক হবে। বিএসইসির মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনার কঠোর তদারকি প্রয়োজন। কোনো অনিয়ম হলে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। তহবিল তছরুপ হলে তা উদ্ধারেও ত্বরিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বুঝ দিয়ে রাখা যাবে, তবে নতুন বিনিয়োগ আনা সম্ভব নয়। ইনভেস্টইট নামে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, এ খাতের এমন বদনাম হয়েছে যে এখন ব্যক্তি তো নয়ই, কোনো প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগ করতে চায় না। আস্থা ফেরাতে খাতসংশ্লিষ্টরা এখনই ঐক্যবদ্ধ না হলে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। এ কথা স্বীকার করেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা যুগোপযোগী করে সংশোধন করে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। শেয়ারবাজারে আমূল সংস্কারে সুপারিশ প্রণয়নে একটি টাস্কফোর্সও কাজ করছে। তাদের সুপারিশ পেলে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
তছরুপের ঘটনা উদ্ঘাটনের পর তা পুনরুদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেই। স্বাভাবিক কারণে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। চার দশকে মিউচুয়াল ফান্ড খাত : সেই আশির দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির মাধ্যমে দেশে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রচলন শুরু। ১৯৯৯ সালে এইমস বাংলাদেশ নামে বেসরকারি খাতে প্রথম সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি যাত্রা শুরু করে দেশে। ২০০৮ সালের পর বেসরকারি খাতে কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির হাত ধরে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি হয়। এখন পর্যন্ত মোট ৬৭টি প্রতিষ্ঠান সম্পদ ব্যবস্থাপকের নিবন্ধন নিয়েছে। তবে উল্লেখ করার মতো সম্পদ নিয়ে সক্রিয় প্রতিষ্ঠান ২০টির বেশি নয়। নিবন্ধিত সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে ৩৭ মেয়াদি এবং
৯৭টি বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড। ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বিবেচনায় এই ১৩৪টি ফান্ডের বর্তমান ইউনিট সংখ্যা প্রায় ৯১২ কোটি। সম্মিলিত মূলধন প্রায় ৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সর্বশেষ প্রকাশিত সম্পদ মূল্য অনুযায়ী ফান্ডগুলোর সম্পদ মূল্য প্রায় ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে অনেক ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক যে সম্পদ মূল্য দেখাচ্ছেন, তা প্রকৃতই আছে কিনা, তা নিয়ে খোদ বিএসইসি ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কর্মকর্তাদের সন্দেহ আছে। উল্লিখিত পরিসংখ্যানে অবশ্য আইসিবির অধীনে পরিচালিত আইসিবি ইউনিট ফান্ডের হিসাব নেই। এ ফান্ডের অধীনে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ মূল্য আছে। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের ফান্ডটির সম্পদ মূল্য ২১২ টাকা। এখন পর্যন্ত এ
ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে ভালো মুনাফা দিচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট পরিশোধিত মূলধন ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। কাগুজে হিসাবে ফান্ডগুলোর সম্পদ মূল্য ৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। স্টক এক্সচেঞ্জে ইউনিটপ্রতি বাজারদরে ফান্ডগুলোর সম্মিলিত মূল্য ২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বিনিয়োগ মূল্যের ওপর লোকসান অর্ধেকের বেশি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পরিশোধিত মূলধন বিবেচনায় মেয়াদি ফান্ডগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধন (বন্ড বাদে) তালিকাভুক্ত ৩৯৭ সিকিউরিটিজের মোট মূলধনের ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে বাজার মূলধনে এই ফান্ডগুলোর অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ফান্ড ৩ টাকা
দরেও কেনাবেচা হচ্ছে। মাত্র দুটি ছাড়া সব ফান্ড মূলধন হারিয়েছে। তুলনামূলক ভালো চিত্র দেখা যায় বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে। অভিহিত মূল্যের হিসাবে আইসিবি ইউনিট ফান্ড ব্যতীত ৯৭টি বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট মূলধন প্রায় ৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এগুলোর অধীনে মোট সম্পদের মূল্য ৫ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। মূলধনের তুলনায় ৫০টি ফান্ডের সম্পদ মূল্য বেশি এবং ৪৭টির কম। এ অবস্থার কারণ পেশাদার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নেওয়া হলেও বাস্তবে প্রকৃত পেশাদারিত্বের ছাপ নেই বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিনিয়োগ কার্যক্রমে। গবেষণা এবং বাজারের ধরন অনুযায়ী বিনিয়োগ হচ্ছে না। কোনো কোনো ফান্ডে অর্ধশত থেকে শতাধিক শেয়ারে বিনিয়োগ
দেখা যায়। এক ফান্ড থেকে একই সম্পদ ব্যবস্থাপকের অন্য ফান্ডে বিনিয়োগ রয়েছে। সহজ মুনাফা করতে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিওতে বিনিয়োগে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা দেখা গেছে। মুনাফা দেখাতে ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে নিজের এক ফান্ড থেকে অন্য ফান্ডের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। তারপরও ব্যাংক বা সরকারি বন্ডের মতো ফিক্সড ইনকাম বিনিয়োগের তুলনায় কিছুটা বেশি মুনাফা আশায় যারা সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন, তাদের ভালো মুনাফা তো দিতেই পারেনি, বাড়াতে পারেনি সম্পদ মূল্য, উল্টো সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়া সম্পদ মূল্য কমে গেছে। এমন মত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমনের। তিনি বলেন, সমস্যা কোথায়, কারা কীভাবে সমস্যা তৈরি করেছে, শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট
সবাই এর কম-বেশি জানেন। সমাধানে উদ্যোগ নেই। অব্যবস্থাপনা শুধু মিউচুয়াল ফান্ড খাতে, বিষয়টি এমন নয়। পুরো শেয়ারবাজার বা সার্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাব দেখা যায়, এটা তার একটা অংশ। যাদের এসব আটকানোর কথা ছিল, তারা আটকাননি। প্রায় একই কথা প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের। তিনি বলেন, টাকা হাতে পাওয়ার পর কিছু সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ওই টাকাকে নিজের বলে মনে করেছে। যখন ভালো ফল মিলছে না, তখন ইউনিটহোল্ডারদের সিদ্ধান্তের পর সর্বোচ্চ আদালতও সম্পদ ব্যবস্থাপক পরিবর্তনে রায় দিয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। ১০ বছরের ফান্ডের মেয়াদ ইউনিটহোল্ডারদের অনুমতি ছাড়া বিশেষ সম্পদ ব্যবস্থাপকের অনুরোধে খোদ মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িয়ে ২০ বছর করতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তা-ই করেছে। আইনে আছে ফান্ডের তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কিছু ফান্ড ম্যানেজার তা করেনি। ট্রাস্টি জানে না, সম্পদ ব্যবস্থাপক কী করছে। ফিক্সড ইনকাম ফান্ডের কথা বলে শেয়ারে বিনিয়োগ হয়েছে। এটা এক ধরনের প্রতারণা। এই প্রতারণা বছরের পর বছর ধরে চলেছে। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা। আইসিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ফান্ডগুলোতে যেসব শেয়ার কেনা রয়েছে, তা আবর্জনা ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, বাজার জুয়াড়ি চক্রের শেয়ার এসব ফান্ডে ‘ডাম্পিং’, ‘পার্কিং’ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে যাকে-তাকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। পেশাদারিত্বের লক্ষণ নেই। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে, ২০১০ সালের পরের ধসে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটাতে না পারায় সমস্যা বেড়েছে। এটা একটা কারণ অবশ্যই। তবে বিনিয়োগ দক্ষতা ছাড়াই যেভাবে বিনিয়োগ করেছে, তা তারা স্বীকার করে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের কারণ: শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের দুরবস্থার দায় কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির। তবে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা, নীতিনির্ধারকসহ কেউই এড়াতে পারেন না। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের মতে, সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাবে নানা অনিয়ম হয়েছে। এটাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে প্রধান বাধা। মিউচুয়াল ফান্ডের আয়-ব্যয়ের হিসাব, সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন এবং সময়মতো লভ্যাংশ প্রদানে গড়িমসি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবও বড় কারণ। বেশ কিছু মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে অধিকাংশ মিউচুয়াল ফান্ড বাজারের গড় রিটার্ন থেকে পিছিয়ে। মানুষ বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফার আশায়। অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যমের তুলনায় মিউচুয়াল ফান্ডে রিটার্ন অনেক কম হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সরাসরি শেয়ার কেনায় বেশি আগ্রহী। অল্প কিছু ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফান্ডের রিটার্ন যেখানে ৫ শতাংশের কম, সেখানে ব্যাংকে আমানত রেখে এখন ১০ শতাংশ বা তারও বেশি সুদ মিলছে। অধিকাংশ সম্পদ ব্যবস্থাপকের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার বিপরীতে কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো মুনাফা ও বাজারের তুলনায় সম্পদ বাড়াতে পারছে। ১৫-২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার পাশাপাশি সম্পদ মূল্যও বেড়েছে কিছু ফান্ডের। তারপরও সেসব সম্পদ ব্যবস্থাপক ভালো বিনিয়োগ পাচ্ছে না। এর একটি কারণ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক জ্ঞানের অভাব। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী করার জন্য ভালো নীতি-প্রণোদনাও নেই। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ছাড়সহ অন্যান্য প্রণোদনা দিতে পারে। এটি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি : সংশ্লিষ্টদের মতে, মানুষের আস্থা অর্জনে মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিভিডেন্ড প্রদানের সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত। পেশাদার ফান্ড ম্যানেজার নিয়োগ এবং মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যারা ভালো করতে পারবে না, তাদের নিবন্ধন বাতিল করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা মিউচুয়াল ফান্ডের রিটার্ন বাড়াতে সহায়ক হবে। বিএসইসির মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনার কঠোর তদারকি প্রয়োজন। কোনো অনিয়ম হলে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। তহবিল তছরুপ হলে তা উদ্ধারেও ত্বরিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বুঝ দিয়ে রাখা যাবে, তবে নতুন বিনিয়োগ আনা সম্ভব নয়। ইনভেস্টইট নামে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, এ খাতের এমন বদনাম হয়েছে যে এখন ব্যক্তি তো নয়ই, কোনো প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগ করতে চায় না। আস্থা ফেরাতে খাতসংশ্লিষ্টরা এখনই ঐক্যবদ্ধ না হলে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। এ কথা স্বীকার করেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা যুগোপযোগী করে সংশোধন করে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। শেয়ারবাজারে আমূল সংস্কারে সুপারিশ প্রণয়নে একটি টাস্কফোর্সও কাজ করছে। তাদের সুপারিশ পেলে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।



