শীত প্রধান স্টেট নিউ ইয়র্ক। এখানে হিমশীতল আবহাওয়ার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকে বৃক্ষরাজি। বছরের অধিকাংশ সময় চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে মানুষের কর্মমুখর জীবন। শীতের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রকৃতির রূপ বদলের পালা। বসন্তের পরশে জীবন্মৃত বৃক্ষরাজি একদিকে যেমন পুষ্প পল্লবে সুশোভিত হয়, তেমনি মুখরিত হয় ভ্রমরের গুঞ্জন আর পাখির কলতানে। শুকনো মাটির বুক ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস। আর প্রকৃতির সেই নবরূপ প্রকৃতির সন্তান মানুষের মনেও দোলা দেয়। পাখির কলতানের সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের ঐকতান। প্রকৃতি এবং মানুষের চিরায়ত এ মেলবন্ধনে সেদিন যুক্ত হয়েছিলো নিউ ইয়র্কের একঝাঁক সাংস্কৃতিক কর্মী। গত ১৫ জুন ২০২৫, রবিবার, নিউ ইয়র্কের অক্সিজেন
ভান্ডারখ্যাত লং আইল্যান্ডের বেলমন্ট লেক স্টেট পার্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সাংস্কৃতিক কর্মীদের বার্ষিক চড়ুইভাতি।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ এ অংশগ্রহণকারীগন
ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সকলে মিলে একটি দিন কাটানোর জন্য দীর্ঘ এক মাসের উৎসব সফল বাস্তবায়ন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই। সকাল ৮টা ৩০ মিনিট সকল বয়সী সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে চঞ্চল হয়ে ওঠে পার্কের পাইন
পেভেলিয়ন। নিমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, খোরশেদ আনোয়ার বাবলু, তারকা সাংবাদিক দস্তগীর জাহাঙ্গীর, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক এ্যানি ফেরদৌস, কবি ও সাংবাদিক ফকির ইলিয়াস, লেখক, সাংবাদিক ও নির্মাতা শামীম আল আমিন, বাচিক শিল্পী আহকাম উল্লাহ, নাট্যজন মিল্টন আহমেদ, জাফর ফেরদৌস, মোকারম আহমেদ, মিন্টু সাহা, রনি সাহা, আনোয়ারুল লাভলু, সঙ্গীত শিল্পী ও নির্মাতা ড. নাসরিন ইসলাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সিভিল রাইট একটিভিস্ট রওশন আরা নীপা, একটিভিস্ট গোপাল সান্যাল, স্বীকৃতি বড়ুয়া, আব্দুল হামিদ, পিনাকী তালুকদার, আমিরুল ইসলাম কামাল, নির্মাতা ইয়াকুব আলী মিঠু, চিত্রশিল্পী আজিজুর রহমান তারিফ, ড. বিলকিস রহমান দোলা, কবি ফারহানা
ইলিয়াস তুলি, কবি আশরাফুন নাহার লিউজা, বাচিক শিল্পী তাহরিনা পারভিন প্রীতি, পারভীন সুলতানা, রিমি রুম্মান, রেশমা চৌধুরী, উইলি মুক্তি, সুতপা সান্যাল, মনিরা আকঞ্জি, জুলফিকার হোসেন বকুল, বাচিক শিল্পী সালাম শাহরিয়ার, সোমা শাহারিয়ার এবং সংগঠকদের সংগঠক হিসেবে পরিচিত স্বপ্না ইমাম ও স্বপ্না আহমেদ সহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক পরিচিত মুখ।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ স্বাক্ষর করছে আগামীর প্রজন্ম
সকাল ১১ টায় চড়ুইভাতির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিল্পী তাজুল ইমাম। তিনি বলেন,
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ আজ মেটিকিউলাস প্রতারকের খপ্পরে। বিগত ৯টি মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছি। সে চাপ থেকে মুক্তির জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি দিন কাটানোর মানসে সমচিন্তার মানুষদের নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
আসলাম আহমাদ খানের প্রস্তাবনায় চড়ুইভাতিতে একটি স্বাক্ষর বোর্ড স্থাপন করা হয়। শিল্পী তাজুল ইমামের ডিজাইনে স্থাপিত এই স্বাক্ষর বোর্ডে নিজের নাম স্বাক্ষর করার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ
উদ্বোধন ঘোষণা করেন শিল্পী তাজুল ইমাম। তিনি বলেন, এখানে সব চড়ুইরা স্বাক্ষর করবে। তারপর পঁচিশ বছর কেটে যাবে। কেউ থাকবো আর কেউ পটল তুলে ঝোল রাঁধবে, কিন্তু এই পোস্টার বহন করে চলবে একজন আলোকিত মানুষের হাতের স্পর্শ।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ এ স্বাক্ষর বোর্ড এ পাশে লেখক ও অন্যান্যরা
উদ্বোধনী পর্ব শেষে পূর্বন্যাস্ত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। সে এক অন্যরকম চড়ুইভাতি। কোন খাবারই
দোকান থেকে অর্ডার দেওয়া হয়নি, বনে রান্না বনেই খাওয়া। এ যেন এক বিশাল যৌথ পরিবার। প্রত্যকেই তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করেছে , আনন্দ করেছে আনলিমিটেড। কেউ বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালাচ্ছে, কেউ চুলা জ্বালিয়েছে ডিম সেদ্ধ করার জন্য। কেউ বসিয়েছে বিশাল চায়ের কেটলি। কারো পেঁয়াজ মরিচ কাটতে কাটতে চোখ নাক দিয়ে পানি ঝরছে, কিন্তু কোন অভিযোগ নেই। কেউ মাংস ধুচ্ছে, কেউ সাজাচ্ছে টেবিল।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
নাট্যজন মিল্টন আহমেদ মহাসমারোহে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে সকালের নাস্তার জন্য মলাই চা এবং দুপুরের খাবারের জন্য সাদা ভাতের আয়োজনে ব্যস্ত। ধোঁয়া উপেক্ষা করে মনিরা আকঞ্জি ব্যস্ত ডিম সেদ্ধ করতে। সমান তালে চলছে ফটোসেশন।ফটোসেশনের তারকা চড়ুইভাতি প্রধান রাঁধুনে গোপন সাহা ও সঞ্জিত দে টিটু। কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত উক্তি, যা তার “বিদ্রোহী” কবিতার অংশ ‘‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য” এর মতো এক হাতে ক্যামেরা অন্য হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে সদা ব্যস্ত আয়োজনের উপস্থাপক মিনহাজ সাম্মু। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে তদারকিতে ব্যস্ত শুরু থেকে অনুষ্ঠানকে পাখির চোখ করে রাখা সুতপা মন্ডল।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
খাদ্যের সঙ্গে বাদ্য। একদিকে রান্নার আয়োজন অন্যদিকে শিল্পীদের গান। শিল্পী তাজুল ইমাম, আনন্দ রাজীব খ্যাত রাজীব ভট্টাচার্য, দিনার মনি, মিনহাজ আহমেদ সাম্মু, স্বপন দত্ত, মেলাল করিম, নাসরিন ইসলাম, শারমিন আক্তার, সুলতান মাহমুদ লিটন, এরফান বাবুদের সঙ্গীতের তালে তালে চলতে থাকে ভোজের আয়োজন।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
লিপি সাহা এনেছিলেন নিজের হাতে বানানো কাপ দই। ঐতিহ্যবাহী বালুশাহী মিষ্টি দিয়ে ভোজন রসিকদের রসনা তপ্ত করেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা নয়াকুটুম গৌতম সাহা। সঙ্গীতানুষ্ঠানের পাশাপাশি হয়েছে আবৃত্তি অনুষ্ঠান। আবৃত্তি করে সকলকে মুগ্ধ করেছেন আহকাম উল্লাহ, পিংকি চৌধুরী, গোপন সাহা এবং সাবিনা নিরু। নিরুর উপস্থাপনায় বাবা দিবসের ছোট্ট অনুষ্ঠান হয়েছে। তাজুল ইমাম, খোরশেদ আনোয়ার বাবলু এবং কবি ফকির ইলিয়াস সকলকে নিয়ে বাবা দিবসের কেক কেটেছেন। ছোট্ট বক্তৃতায় সন্তানদের পক্ষে সকল বাবাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে ফারদিন খান রূপাই।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
এবারের চড়ুইভাতির চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ। মাংস ধুয়ে রান্নার হাঁড়িতে ঢালার পুরো কাজটি বলতে গেলে একাই করে ফেলেছে জনম সাহা। ছোট্ট মেয়ে গুঞ্জরি মরিচ কাটার মতো ছোট কিন্তু কঠিন কাজ করেছে অন্যদের সঙ্গে। রূপাই, রোহান, ওমর, প্রকৃতি, বিভাবরী সহ একঝাঁক ইয়ং স্টার বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে চুলায় আগুন জ্বালিয়েছে, টেবিল সাজিয়েছে, ময়লা পরিষ্কার করেছে, হেসেছে, খেলেছে, আনন্দ করেছে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে কবি ফকির ইলিয়াস বলেন, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী করে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু এদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আবার আশাবাদী করে তুলেছে। এরাই আগামীর বিশ্ব, এরাই পারে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে তুলে ধরতে বিশ্ব মানচিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে। আগামীর নেতৃত্ব ওদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে হিসাব বিবরণী উপস্থাপন করেন চড়ুইদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সদস্য মিন্টু সাহা, সৌরেন দাস ও ত্রিদিব চৌধুরী। গোপন সাহা ও সুতপা মন্ডল কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নাসিমা আনোয়ার, জলি কর, আলী হাসান, লুসী হাসান, সুমন নাথ, এরফানুল হক বাবু, আনিস সিদ্দিক, শাহানাজ হায়াত রত্না, মীর আজম, মৌসুমী লিপি, সাকী তরফদার, চিত্রা ভৌমিক, শিবু পোদ্দার, সীন দাস, সৌরেন দাস, রিশাদ, কনিকা ধর , তপন সরকার, ঝুমুর ভৌমিক, সাকিল আহমেদ , কনিকা ধর , ত্রিদিব মন্ডল, আলী হাসান, রজত নাগ, শুক্লা রায় সহ সকল ভলেন্টেয়ার চড়ুইদের প্রতি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হয় অনুষ্ঠানের শব্দ নিয়ন্ত্রক অনুষ এষ এবং পোস্টার ডিজাইনার টিপু আলমের প্রতি।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
চড়ুইভাতির সর্বশেষ পর্ব ছিল রাফেল ড্র। চড়ুইভাতির ঐতিহ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে রাফেল ড্রয়ের জন্য কোন অর্থ নেওয়া হয়না। পুরষ্কার স্পন্সর করেন অংশগ্রহণকারী স্বজনরা।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫
এবারের পুরষ্কার হারমোনিয়াম, তবলা সেট, গিটার, ব্লুটুথ সাউন্ড সিস্টেম এবং নগদ ১০১ ডলার স্পন্সর করেছেন যথাক্রমে স্বপন দত্ত ও শিল্পী দত্ত, আতিয়া সীমা ও জুলফিকার হোসেন বকুল, শাহরিয়ার সালাম ও সোমা আহমেদ, আইরিন রহমান ও রিশাদ রহমান, মিন্টু সাহা ও রনি সাহা। পুরষ্কার বিজয়ীরা মহাখুশী, বিজিতরা মনের দু:খে ফেইসবুকে কবিতা লিখে অভিশাপ দিয়েছে, কিন্তু এ অভিশাপ মর্মান্তিক নয়— মধুর।
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ রাফেল ড্রনিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
নিউ ইয়র্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলা ও চড়ুইভাতি ২০২৫ এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানএমন হাজারো মধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ হয়েছে চড়ুইভাতি। অনুষ্ঠানের অনুভূতি প্রকাশ করে স্যোশাল মিডিয়ার পিনাকী তালুকদার লিখেন, “অসাধারণ একটি দিন কাটালাম আমরা! সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সব রান্না হয়েছে বন্ধুদের আড্ডা আর বিপুলানন্দে! সাথে গান কবিতা আর খেলাধুলা সবই উপভোগ করলাম প্রাণভরে! বিশাল এই কর্মযজ্ঞে যে কয়েকজন কঠোর পরিশ্রম করেছেন তাদেরকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দেয়া ছাড়া আর কিছুই বলার নেই! আমাদের এই প্রাণের আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন সুতপা দিদি ও গোপন সাহা দাদা! মাথার উপরে ছিলেন তাজুল ঈমাম ভাই। আর তো সবাই আমরা আমরাই! এই মানুষ গুলোকে যখনই দেখি, তখনই আনন্দ পাই! সবাইকে নিয়ে এভাবে প্রাণ ভরে বাঁচার নামইতো জীবন! জয়তু চড়ুই বন্ধুরা”!
ইউ এস বাংলা নিউজ
ইউ এস বাংলা নিউজ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।