
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আবহাওয়া আইন ২০১৮: গবেষণা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনকল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা

আবহাওয়া আইন, ২০১৮ একটি স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিস্ট আইন যা শেখ হাসিনার আমলে তৈরি করা হয়েছিল। এটি এমন এক আইন যা দেশের আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য এবং গবেষণা কার্যক্রমে একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এই আইনটির উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর শাসন আর জনগণের সামনে সঠিক তথ্য প্রকাশের পথ বন্ধ করে দেওয়া। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন কোনো আইনের অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ আছে। কোনো সভ্য দেশ তাদের গবেষকদেরকে তথ্য প্রচার করতে বাধা দেয় না। আবহাওয়া সম্পর্কিত বিশ্বের বহু গবেষক বিভিন্নভাবে অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে কেবল নিজ দেশ নয় বরং আন্তর্জাতিক জনগণকে সহায়তা দিচ্ছে। সে জায়গায় বাংলাদেশের গবেষকরা নিজেদের
জনগণকে যাতে আবহাওয়ার জ্ঞান দিতে না পারে, তার জন্য এই কালো কানুনটি তৈরি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন আমলে বেশ কয়েকটি জনবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যার মধ্যে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে সবাই সচেতন। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, ‘আবহাওয়া আইন’ নিয়ে কেউই সচেতন নয়। হাসিনার সরকার তখন একনিষ্ঠভাবে শক্তি ধরে রাখতে এবং জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে সবার বাকস্বাধীনতাকে নষ্ট করেছিল এবং আবহাওয়া আইন এর মাধ্যমে বেসরকারি গবেষকদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এই অথর্ব আইনটি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি, কারণ এটি গবেষণা ও আবহাওয়া পূর্বাভাসের স্বাধীনতা রোধ করে, বিশেষভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকদের কাজের ওপর কঠোর
বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই আইনটি গবেষণার স্বাধীনতা, তথ্যের প্রবাহ এবং পূর্বাভাস সংক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর ফলে, BWOTএবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং জনগণের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। আইনটি আবহাওয়া সম্পর্কিত ডেটা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যা দেশের উন্নয়ন এবং মানুষের কল্যাণের জন্য মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশের আবহাওয়া আইন, ২০১৮ এর মধ্যে কিছু ধারা স্বাধীন গবেষণা এবং পূর্বাভাসের কাজের জন্য প্রতিবন্ধক। আমরা এই আইনটি পড়ে বেশ কিছু সমস্যা খুঁজে পেয়েছি। যেমনঃ ১. আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহের একক কর্তৃপক্ষ: এই আইন অনুসারে, আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাস শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ (বিশেষত আবহাওয়া অধিদপ্তর) থেকে পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস
যেমন NOAA, ECMWF ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য প্রচার করা যাবে না, অথচ তা অনলাইনে প্রামাণ্য তথ্যসূত্র হিসেবে সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে বেসরকারি গবেষক প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীন গবেষকদের জন্য তথ্য সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। ২. অনুমোদন ছাড়া পূর্বাভাস বা তথ্য প্রকাশ নিষিদ্ধ: আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না। এতে স্বাধীন তথ্যপ্রকাশ এবং গবেষণার স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ এতে গবেষকরা তাদের কাজের ফলাফল স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবেন না। এ বিধান বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯(২)(খ) এর পরিপন্থি, যা প্রত্যেক নাগরিকের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ এবং ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করে। এ ছাড়াও,
এই আইন সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি, যা প্রত্যেক নাগরিককে ‘আইন দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে, যেকোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের’ অধিকার দেয়। আবহাওয়া সম্পর্কিত গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশ একটি পেশা হিসেবে গণ্য হতে পারে, এবং এই আইনের মাধ্যমে সেই পেশার উপর অযৌক্তিক বাধা আরোপ করা হয়েছে। ৩. আবহাওয়া তথ্য ও পূর্বাভাসের ব্যবহার: আইনের অধীনে, আবহাওয়া তথ্য ও পূর্বাভাস শুধুমাত্র সরকারের অনুমোদিত সংস্থা দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে, যা বেসরকারি বা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ৪. আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য একচেটিয়া অধিকার: এই ধারার মাধ্যমে, সরকারের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এর ফলে, বেসরকারি গবেষণাগুলো সরকারি অনুমোদনের অভাবে কাজ
করতে পারবে না এবং তাদের গবেষণার ফলাফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ থাকবে না। ৫. জরুরি অবস্থায় বিশেষ নিয়ন্ত্রণ: এই ধারার অধীনে, সরকার যেকোনো সময়েই আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাসের নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানকারী বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অতিরিক্ত বাধা তৈরি করতে পারে। বিকল্প প্রস্তাব: এই ফ্যাসিস্ট আইনটিকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং এর পরিবর্তে একটি নতুন গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন করতে হবে অথবা বিদ্যমান আইনটিকে আমূল সংস্কারের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন অথবা সংস্কারকৃত আইনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে: ১. বেসরকারি গবেষণা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের নিশ্চয়তা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকদের অবাধে আবহাওয়া গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশের
অধিকার দিতে হবে। কোনো প্রকার পূর্বানুমোদন বা লাইসেন্সিং-এর প্রয়োজন হবে না। ২. বিএমডি-র স্বচ্ছতা: বিএমডি-র কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ডেটা এবং তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। ৩. ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণ: ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, তবে এই ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে স্বাধীন গবেষণা এবং মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। ৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ: আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদাহরণ: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আবহাওয়া সেবা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো: ১. যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে National Weather Service (NWS) সরকারি সংস্থা হলেও, AccuWeather এবং The Weather Channel-এর মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো NWS-এর তথ্যের পাশাপাশি নিজস্ব মডেল এবং ডেটা ব্যবহার করে আরও উন্নত এবং বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে। ২. যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে Met Office সরকারি সংস্থা হলেও, BBC Weather এবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাস প্রদান করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো Met Office-এর তথ্যের উপর নির্ভর করে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজস্ব বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনা ব্যবহার করে। ৩. ইউরোপীয় ইউনিয়ন: ইউরোপীয় ইউনিয়নে European Centre for Medium-Range Weather Forecasts (ECMWF) একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা। এই সংস্থার তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া সেবা প্রদান করে। এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে আবহাওয়া সেবা আরও উন্নত এবং কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই মডেল অনুসরণ করা উচিত। বর্তমান সরকার, যারা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত, তাদের কাছে আমাদের একটি গুরুতর আবেদন, এই ফ্যাসিস্ট আইনটিকে বাতিল করে নতুন এবং সুষ্ঠু একটি আইনের প্রবর্তন করা। জনগণের জন্য সঠিক তথ্য, গবেষণা, এবং পূর্বাভাস সংযুক্ত একটি সিস্টেম থাকা প্রয়োজন, যা স্বাধীনভাবে চলতে পারে এবং জনকল্যাণে অবদান রাখতে পারে। বর্তমান সরকারের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, ক্ষতিকর এই আইনটি বাতিল করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও মুক্ত আবহাওয়া গবেষণা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার। গবেষণার স্বাধীনতা শুধু গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, এটি দেশের জনগণের কল্যাণের জন্যও অপরিহার্য। অবাধ তথ্য প্রবাহ, গবেষণা, এবং পূর্বাভাসের সুযোগ দেয়া, জনগণকে সঠিক এবং কার্যকরী প্রস্তুতির জন্য সহায়তা করবে। BWOT এবং অন্যান্য স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে, এই কালো আইনটিকে বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে জনগণের সকল অংশ সমানভাবে সচেতন নয়, সেখানে আবহাওয়া মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারে যার তার হাতে তুলে দেয়াও উচিত নয়। ভুয়া ইউটিউবার বা অন্যান্যদের কবল থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে একটি নতুন আইন প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের উচিত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা যা গবেষণার স্বাধীনতা এবং সঠিক তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করবে, তবে এটি ভুয়া তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণও রাখবে। বিশেষ করে, এমন কোনো পক্ষ যারা প্রতারণামূলক তথ্য ছড়ায়, তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা উচিত। তবে, এই নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে হতে হবে যাতে স্বাধীন গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। সঠিক রেগুলেশন থাকা উচিত যা গবেষকদের কাজের স্বাধীনতা এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর সুযোগ নিশ্চিত করবে। প্রয়োজনে রেজিস্ট্রেশন নেয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, গবেষণার স্বচ্ছতা এবং সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস তৈরির ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। এই আইনটি অবশ্যই এমনভাবে তৈরি হওয়া উচিত যাতে তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং গবেষকদের কাজ করতে সহায়ক হয়, এবং একই সঙ্গে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ সীমিত করা যায়। এর ফলে, তথ্যগত স্বচ্ছতা এবং গবেষণার নির্ভুলতা বজায় থাকবে এবং জনগণ সঠিকভাবে সুরক্ষিত থাকবে। লেখক: প্রধান আবহাওয়া গবেষক, বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম, বিডব্লিউওটি ইমেইলঃ khalidhossain.phy.buet@bwotweather.or
জনগণকে যাতে আবহাওয়ার জ্ঞান দিতে না পারে, তার জন্য এই কালো কানুনটি তৈরি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন আমলে বেশ কয়েকটি জনবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যার মধ্যে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে সবাই সচেতন। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, ‘আবহাওয়া আইন’ নিয়ে কেউই সচেতন নয়। হাসিনার সরকার তখন একনিষ্ঠভাবে শক্তি ধরে রাখতে এবং জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে সবার বাকস্বাধীনতাকে নষ্ট করেছিল এবং আবহাওয়া আইন এর মাধ্যমে বেসরকারি গবেষকদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এই অথর্ব আইনটি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি, কারণ এটি গবেষণা ও আবহাওয়া পূর্বাভাসের স্বাধীনতা রোধ করে, বিশেষভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকদের কাজের ওপর কঠোর
বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই আইনটি গবেষণার স্বাধীনতা, তথ্যের প্রবাহ এবং পূর্বাভাস সংক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর ফলে, BWOTএবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং জনগণের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। আইনটি আবহাওয়া সম্পর্কিত ডেটা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যা দেশের উন্নয়ন এবং মানুষের কল্যাণের জন্য মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশের আবহাওয়া আইন, ২০১৮ এর মধ্যে কিছু ধারা স্বাধীন গবেষণা এবং পূর্বাভাসের কাজের জন্য প্রতিবন্ধক। আমরা এই আইনটি পড়ে বেশ কিছু সমস্যা খুঁজে পেয়েছি। যেমনঃ ১. আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহের একক কর্তৃপক্ষ: এই আইন অনুসারে, আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাস শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ (বিশেষত আবহাওয়া অধিদপ্তর) থেকে পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস
যেমন NOAA, ECMWF ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য প্রচার করা যাবে না, অথচ তা অনলাইনে প্রামাণ্য তথ্যসূত্র হিসেবে সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে বেসরকারি গবেষক প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীন গবেষকদের জন্য তথ্য সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। ২. অনুমোদন ছাড়া পূর্বাভাস বা তথ্য প্রকাশ নিষিদ্ধ: আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না। এতে স্বাধীন তথ্যপ্রকাশ এবং গবেষণার স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ এতে গবেষকরা তাদের কাজের ফলাফল স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবেন না। এ বিধান বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯(২)(খ) এর পরিপন্থি, যা প্রত্যেক নাগরিকের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ এবং ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করে। এ ছাড়াও,
এই আইন সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি, যা প্রত্যেক নাগরিককে ‘আইন দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে, যেকোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের’ অধিকার দেয়। আবহাওয়া সম্পর্কিত গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশ একটি পেশা হিসেবে গণ্য হতে পারে, এবং এই আইনের মাধ্যমে সেই পেশার উপর অযৌক্তিক বাধা আরোপ করা হয়েছে। ৩. আবহাওয়া তথ্য ও পূর্বাভাসের ব্যবহার: আইনের অধীনে, আবহাওয়া তথ্য ও পূর্বাভাস শুধুমাত্র সরকারের অনুমোদিত সংস্থা দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে, যা বেসরকারি বা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ৪. আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য একচেটিয়া অধিকার: এই ধারার মাধ্যমে, সরকারের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এর ফলে, বেসরকারি গবেষণাগুলো সরকারি অনুমোদনের অভাবে কাজ
করতে পারবে না এবং তাদের গবেষণার ফলাফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ থাকবে না। ৫. জরুরি অবস্থায় বিশেষ নিয়ন্ত্রণ: এই ধারার অধীনে, সরকার যেকোনো সময়েই আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাসের নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানকারী বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অতিরিক্ত বাধা তৈরি করতে পারে। বিকল্প প্রস্তাব: এই ফ্যাসিস্ট আইনটিকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং এর পরিবর্তে একটি নতুন গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন করতে হবে অথবা বিদ্যমান আইনটিকে আমূল সংস্কারের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন অথবা সংস্কারকৃত আইনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে: ১. বেসরকারি গবেষণা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের নিশ্চয়তা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকদের অবাধে আবহাওয়া গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশের
অধিকার দিতে হবে। কোনো প্রকার পূর্বানুমোদন বা লাইসেন্সিং-এর প্রয়োজন হবে না। ২. বিএমডি-র স্বচ্ছতা: বিএমডি-র কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ডেটা এবং তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। ৩. ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণ: ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, তবে এই ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে স্বাধীন গবেষণা এবং মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। ৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ: আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদাহরণ: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আবহাওয়া সেবা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো: ১. যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে National Weather Service (NWS) সরকারি সংস্থা হলেও, AccuWeather এবং The Weather Channel-এর মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো NWS-এর তথ্যের পাশাপাশি নিজস্ব মডেল এবং ডেটা ব্যবহার করে আরও উন্নত এবং বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে। ২. যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে Met Office সরকারি সংস্থা হলেও, BBC Weather এবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবহাওয়া তথ্য এবং পূর্বাভাস প্রদান করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো Met Office-এর তথ্যের উপর নির্ভর করে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজস্ব বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনা ব্যবহার করে। ৩. ইউরোপীয় ইউনিয়ন: ইউরোপীয় ইউনিয়নে European Centre for Medium-Range Weather Forecasts (ECMWF) একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা। এই সংস্থার তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া সেবা প্রদান করে। এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে আবহাওয়া সেবা আরও উন্নত এবং কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই মডেল অনুসরণ করা উচিত। বর্তমান সরকার, যারা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত, তাদের কাছে আমাদের একটি গুরুতর আবেদন, এই ফ্যাসিস্ট আইনটিকে বাতিল করে নতুন এবং সুষ্ঠু একটি আইনের প্রবর্তন করা। জনগণের জন্য সঠিক তথ্য, গবেষণা, এবং পূর্বাভাস সংযুক্ত একটি সিস্টেম থাকা প্রয়োজন, যা স্বাধীনভাবে চলতে পারে এবং জনকল্যাণে অবদান রাখতে পারে। বর্তমান সরকারের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, ক্ষতিকর এই আইনটি বাতিল করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও মুক্ত আবহাওয়া গবেষণা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার। গবেষণার স্বাধীনতা শুধু গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, এটি দেশের জনগণের কল্যাণের জন্যও অপরিহার্য। অবাধ তথ্য প্রবাহ, গবেষণা, এবং পূর্বাভাসের সুযোগ দেয়া, জনগণকে সঠিক এবং কার্যকরী প্রস্তুতির জন্য সহায়তা করবে। BWOT এবং অন্যান্য স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে, এই কালো আইনটিকে বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে জনগণের সকল অংশ সমানভাবে সচেতন নয়, সেখানে আবহাওয়া মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারে যার তার হাতে তুলে দেয়াও উচিত নয়। ভুয়া ইউটিউবার বা অন্যান্যদের কবল থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে একটি নতুন আইন প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের উচিত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা যা গবেষণার স্বাধীনতা এবং সঠিক তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করবে, তবে এটি ভুয়া তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণও রাখবে। বিশেষ করে, এমন কোনো পক্ষ যারা প্রতারণামূলক তথ্য ছড়ায়, তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা উচিত। তবে, এই নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে হতে হবে যাতে স্বাধীন গবেষণা এবং তথ্য প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। সঠিক রেগুলেশন থাকা উচিত যা গবেষকদের কাজের স্বাধীনতা এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর সুযোগ নিশ্চিত করবে। প্রয়োজনে রেজিস্ট্রেশন নেয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, গবেষণার স্বচ্ছতা এবং সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস তৈরির ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। এই আইনটি অবশ্যই এমনভাবে তৈরি হওয়া উচিত যাতে তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং গবেষকদের কাজ করতে সহায়ক হয়, এবং একই সঙ্গে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ সীমিত করা যায়। এর ফলে, তথ্যগত স্বচ্ছতা এবং গবেষণার নির্ভুলতা বজায় থাকবে এবং জনগণ সঠিকভাবে সুরক্ষিত থাকবে। লেখক: প্রধান আবহাওয়া গবেষক, বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম, বিডব্লিউওটি ইমেইলঃ khalidhossain.phy.buet@bwotweather.or