ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
পকেটে ৬ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের ছত্রছায়ায় গত ৪ বছরে বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়েছে। ‘সড়ক পরিবহণে সংগঠন পরিচালনা ব্যয়’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রণয়ন করে এই চাঁদাবাজিকে বৈধতাও দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ আছে, সড়কে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান। ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯ শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়েছে। এর একটি বড় অংশ নিয়মিত গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে পরিবহণ মালিক সমিতির অপর প্রভাবশালী নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। তার ছিল মাস্তান বাহিনী।
এ বাহিনীর কাছে বছরের পর বছর জিম্মি পরিবহণ মালিকরা। বিগত
সময়ে বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এর নেপথ্যেও ছিলেন এই শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহণ আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধাও ছিলেন তিনি। এদিকে নির্বাচনি হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যা ২০২৪ সালে হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ সময়ে তার আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। পরিবহণ শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, সড়ক পরিবহণ আইনে রাস্তা থেকে চাঁদা উঠানোর কোনো বিধান নেই। এরপরও পরিবহণ খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন
শাজাহান খান। বিভিন্ন টার্মিনাল, উপজেলা পর্যায়ে চাঁদা তুলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গেছে। এই ফেডারেশনের সবকিছুই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবহণ সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছে শাজাহান খানের লোকজন। তিনি আরও বলেন, শাজাহান খান ও সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহণে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আবেদন, অনতিবিলম্বে তদন্ত করে এসব অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হোক। সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায়
আসার পরপরই পরিবহণ খাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন নেতা শাজাহান খান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবহণ খাতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তার। ২০০৯ সাল থেকে সড়কে বিক্ষিপ্ত আকারে নানা অঙ্কের চাঁদা তোলা হতো। করোনাকালে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের পহেলা জুন থেকে গণপরিবহণ চালুর সিদ্ধান্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে ২০২০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস সড়কে চাঁদা তোলা বন্ধ ছিল। এ সময় চাঁদা তোলার নতুন ফন্দি আঁটা হয়। প্রণয়ন করা হয় সড়ক পরিবহণ সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বা সার্ভিস চার্জসংক্রান্ত নির্দেশিকা। এ নির্দেশিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি, সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। নির্দেশিকার ৪১টি ধারায় সড়কে চাঁদাবাজিকে দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নির্দেশিকায় ঢাকা মহানগর এলাকা ও শহরতলিতে কে কোথায় চাঁদা তুলবে, আন্তঃজেলায় চলা যানবাহনে ঢাকার কোন স্পটে কারা চাঁদা তুলবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর চাঁদা তোলার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিদিন একটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে একবার ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে এক দিনে ১৫ থেকে ২০ বারও চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে
নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৩টি। এসব যানবাহন থেকে দিনে একবার করে ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এ হিসাবে নির্দেশিকা প্রণয়নের পর ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত শুধু বিআরটিএর নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে। ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে শাজাহান খানের নামে পরিবহণ খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু হয়। টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবহণের লোকের বাইরে তার (শাজাহান খান) লোকেরা রাজনৈতিক প্রভাবে
চাঁদাবাজি করেছেন। তিনি বলেন, বাস মালিকদের নানাভাবে জিম্মি করে রাখতেন শাজাহান খান। তার জন্য সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি। কিছু অসাধু বাস মালিক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহণ খাতকে নাজেহাল করেছেন তিনি। অনেক মালিক তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার আয় বেড়ে প্রায় ৩২ গুণ হয়েছে। ২০০৮ সালে শাজাহান খানের অস্থাবর সম্পদ ছিল প্রায় ৫৭ লাখ টাকার। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (আসবাব, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও বন্দুকের দাম বাদে)। অর্থাৎ তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। মাদারীপুর-২ আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন শাজাহান খান। একই আসন থেকে তিনি পরের নির্বাচনগুলোতেও প্রার্থী হন। জানা যায়, শাজাহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ফুড ভিলেজ (সার্বিক হোটেল) সবকিছুই তার পরিবারের সদস্যদের নামে। বিশেষ করে ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহণ কোম্পানিতে একক আধিপত্য তার। এ পরিবহণের ব্যানারে ২০০টির বেশি গাড়ি চলাচল করত। এ পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করেছিলেন তার ছেলেকে। শাজাহান খানকে অনেকেই বলে থাকেন পরিবহণ শ্রমিকদের গডফাদার। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে শ্রমিকদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোশক ছিলেন এই শ্রমিক নেতা। বিএনপির আন্দোলন দমাতে গণপরিবহণ ধর্মঘট : বিগত সময়ে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকাদের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এসব পরিবহন ধর্মঘটের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করে বিএনপি। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তাদের সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম হচ্ছে, আর এই লোকসমাগম ঠেকাতে সরকার গণপরিবহণকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সূত্র জানায়, মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে কখনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই, আবার কখনো নানা অজুহাতে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন শাজাহান খান। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসতে পারেননি অনেক নেতাকর্মী। এতে সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে দেশের বাইরে থেকে এসে বিমানবন্দরে আটকে গেছেন। চিকিৎসার জন্য অনেকে দূর দূরান্তে যেতে পারেননি। তবে সরকারের বাহবা পেয়েছেন শাজাহান খান। সরকারের কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা। সড়ক পরিবহণ আইনের বিরোধিতা : ২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় সড়ক পরিবহণ শ্রমিক নেতা শাজাহান খান বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হন। শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনার জেরে ছাত্র-জনতার নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনেরও সমালোচনা করেছেন শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধা ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এই শ্রমিক নেতার ঘোর বিরোধিতার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি অওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেওয়া দরকার। কারণ তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেওয়া যায়। তার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে সর্বমহলে তীব্র সমালোচিত হয়।
সময়ে বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এর নেপথ্যেও ছিলেন এই শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহণ আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধাও ছিলেন তিনি। এদিকে নির্বাচনি হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যা ২০২৪ সালে হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ সময়ে তার আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। পরিবহণ শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, সড়ক পরিবহণ আইনে রাস্তা থেকে চাঁদা উঠানোর কোনো বিধান নেই। এরপরও পরিবহণ খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন
শাজাহান খান। বিভিন্ন টার্মিনাল, উপজেলা পর্যায়ে চাঁদা তুলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গেছে। এই ফেডারেশনের সবকিছুই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবহণ সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছে শাজাহান খানের লোকজন। তিনি আরও বলেন, শাজাহান খান ও সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহণে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আবেদন, অনতিবিলম্বে তদন্ত করে এসব অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হোক। সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায়
আসার পরপরই পরিবহণ খাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন নেতা শাজাহান খান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবহণ খাতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তার। ২০০৯ সাল থেকে সড়কে বিক্ষিপ্ত আকারে নানা অঙ্কের চাঁদা তোলা হতো। করোনাকালে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের পহেলা জুন থেকে গণপরিবহণ চালুর সিদ্ধান্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে ২০২০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস সড়কে চাঁদা তোলা বন্ধ ছিল। এ সময় চাঁদা তোলার নতুন ফন্দি আঁটা হয়। প্রণয়ন করা হয় সড়ক পরিবহণ সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বা সার্ভিস চার্জসংক্রান্ত নির্দেশিকা। এ নির্দেশিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি, সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। নির্দেশিকার ৪১টি ধারায় সড়কে চাঁদাবাজিকে দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নির্দেশিকায় ঢাকা মহানগর এলাকা ও শহরতলিতে কে কোথায় চাঁদা তুলবে, আন্তঃজেলায় চলা যানবাহনে ঢাকার কোন স্পটে কারা চাঁদা তুলবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর চাঁদা তোলার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিদিন একটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে একবার ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে এক দিনে ১৫ থেকে ২০ বারও চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে
নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৩টি। এসব যানবাহন থেকে দিনে একবার করে ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এ হিসাবে নির্দেশিকা প্রণয়নের পর ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত শুধু বিআরটিএর নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে। ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে শাজাহান খানের নামে পরিবহণ খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু হয়। টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবহণের লোকের বাইরে তার (শাজাহান খান) লোকেরা রাজনৈতিক প্রভাবে
চাঁদাবাজি করেছেন। তিনি বলেন, বাস মালিকদের নানাভাবে জিম্মি করে রাখতেন শাজাহান খান। তার জন্য সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি। কিছু অসাধু বাস মালিক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহণ খাতকে নাজেহাল করেছেন তিনি। অনেক মালিক তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার আয় বেড়ে প্রায় ৩২ গুণ হয়েছে। ২০০৮ সালে শাজাহান খানের অস্থাবর সম্পদ ছিল প্রায় ৫৭ লাখ টাকার। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (আসবাব, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও বন্দুকের দাম বাদে)। অর্থাৎ তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। মাদারীপুর-২ আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন শাজাহান খান। একই আসন থেকে তিনি পরের নির্বাচনগুলোতেও প্রার্থী হন। জানা যায়, শাজাহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ফুড ভিলেজ (সার্বিক হোটেল) সবকিছুই তার পরিবারের সদস্যদের নামে। বিশেষ করে ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহণ কোম্পানিতে একক আধিপত্য তার। এ পরিবহণের ব্যানারে ২০০টির বেশি গাড়ি চলাচল করত। এ পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করেছিলেন তার ছেলেকে। শাজাহান খানকে অনেকেই বলে থাকেন পরিবহণ শ্রমিকদের গডফাদার। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে শ্রমিকদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোশক ছিলেন এই শ্রমিক নেতা। বিএনপির আন্দোলন দমাতে গণপরিবহণ ধর্মঘট : বিগত সময়ে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকাদের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এসব পরিবহন ধর্মঘটের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করে বিএনপি। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তাদের সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম হচ্ছে, আর এই লোকসমাগম ঠেকাতে সরকার গণপরিবহণকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সূত্র জানায়, মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে কখনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই, আবার কখনো নানা অজুহাতে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন শাজাহান খান। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসতে পারেননি অনেক নেতাকর্মী। এতে সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে দেশের বাইরে থেকে এসে বিমানবন্দরে আটকে গেছেন। চিকিৎসার জন্য অনেকে দূর দূরান্তে যেতে পারেননি। তবে সরকারের বাহবা পেয়েছেন শাজাহান খান। সরকারের কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা। সড়ক পরিবহণ আইনের বিরোধিতা : ২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় সড়ক পরিবহণ শ্রমিক নেতা শাজাহান খান বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হন। শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনার জেরে ছাত্র-জনতার নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনেরও সমালোচনা করেছেন শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধা ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এই শ্রমিক নেতার ঘোর বিরোধিতার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি অওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেওয়া দরকার। কারণ তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেওয়া যায়। তার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে সর্বমহলে তীব্র সমালোচিত হয়।