ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নামল ১২ ডিগ্রিতে
অবৈধ বিচারিক রায় বাতিল এবং অবৈধ দখলদার ইউনুস সরকারের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল
জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র!
বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আজাদের মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শোক
২৬ নভেম্বর বন্দর অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ
কক্সবাজারে ‘শয়তানের নিশ্বাস’ আতঙ্ক: পাকিস্তানি দুই যুবকের অভিনব প্রতারণায় সর্বস্ব লুট
‘শেখের বেটি আসবে, আমরাও ঘরে ফিরবো’— রিকশাচালকের বিশ্বাস ও ভাইরাল স্ট্যাটাস ‘মামা আপনি সাবধানে থাকবেন
গোলাপ গ্রাম এখন ‘মরুভূমি’
ঢাকার অদূরে সাভারের ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিত গোলাপ গ্রাম এখন তার খ্যাতি হারানোর পথে। গ্রামটির নানা রঙের গোলাপের সুবাস বিলীন হচ্ছে এক আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনে। ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ নামে আবাসন কোম্পানি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে গোলাপ গ্রামের বাগান, সরকারি খাসজমি, এমনকি নদী-জলাশয়ও।
একের পর এক গোলাপের বাগান কেটে সেখানে তৈরি হচ্ছে প্লট, উঠছে সাইনবোর্ড, চলছে হরিণ পালনের মতো বেআইনি কার্যক্রম। নলকূপ উপড়ে ফেলায় পানির অভাবে শুকিয়ে মরছে ফুলের চারা, বন্ধ হচ্ছে জীবিকা। এতে গোলাপ চাষের সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই হাজার চাষি পেশা বদলে অন্য পথে পা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
অথচ ফাল্গুন বা ভালোবাসা দিবসসহ বিভিন্ন দিবস উদযাপন ঘিরে নানা ফুলের চাহিদা যখন
বাড়ছে, তখন আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনে সাভারের গোলাপ গ্রাম ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার সুবাস। জানা যায়, ঢাকার কাছাকাছি ভ্রমণের আদর্শ স্থান ছিল গোলাপ গ্রাম। একটু মুক্ত হাওয়া ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে সুযোগ পেলেই রাজধানীবাসী ছুটে যেতেন সেখানে। লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি—বিভিন্ন রং ও আকৃতির গোলাপের চাষ হতো এ গ্রামে। বিভিন্ন জাতের গোলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মিরিন্ডা গোলাপ, চায়না গোলাপ ও ইরানি গোলাপ। গোলাপের পাশাপাশি চাষ হতো জারবেরা, রজনিগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা ফুল। তবে এসবই এখন অতীত। সরেজমিন দেখা যায়, একসময় ফুলপ্রেমীদের প্রিয় গোলাপ গ্রাম এখন অনেকটাই মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। রাজধানীবাসীর আকর্ষণীয় ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি
কেটে তৈরি করা হচ্ছে গভীর গিরিখাত। সেই মাটি আবার ট্রাকে করে ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে। পরে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন আকারের প্লট। পুরো গোলাপ বাগানে টানানো হয়েছে রং-বেরঙের সাইনবোর্ড, তাতে ‘প্লট বিক্রয় চলছে’—এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন। হাতেগোনা কয়েকটি বাগান এখনো টিকে আছে, তবে চারপাশের মাটি কেটে গর্ত তৈরি করায় সেগুলোও চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক স্থান থেকে মাটি কেটে অন্য স্থানে ফেলে এভাবে প্লট বানানোর কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। সরেজমিন দেখা যায়, গোলাপ বাগানের প্রবেশমুখে হাতের ডানপাশেই বিশাল এক গিরিখাত। তার পাশের কয়েকটি বাগানের চারপাশে প্রায় ১০ ফুটেরও বেশি গভীর গর্ত করা হয়েছে। ফলে সেসব বাগানে গোলাপের ফলন হচ্ছে না; চারা মরে যাচ্ছে।
চারদিকে গভীর গর্ত থাকায় পরিচর্যার জন্য বাগানে ঢোকাও এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হলে জায়গাগুলো ছোট ছোট জলাশয়ে পরিণত হয়। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক চাষি তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্থানীয় গোলাপ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ নামে একটি আবাসন কোম্পানি প্রথমে বাগানের মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করে। এরপর রাস্তার দুপাশের কিছু জমি কিনে সেখানে মাটি কেটে বড় বড় গর্ত তৈরি করে। এতে আশপাশের জমিগুলো চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে। চাষিরা জানান, কেউ জমি বিক্রি করতে না চাইলে তাদের চলাচলে বাধা দেওয়া হয় সেই রাস্তা দিয়ে, এমনকি ফুল পরিবহনেও নানা রকম বাধা দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আবাসন
কোম্পানিটির নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী আছে। যারা জমি বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে এ বাহিনী। চাষিদের দাবি, লেক আইল্যান্ড গ্রুপের এ ক্যাডার বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন হাকিম ও বারেক নামে দুই ব্যক্তি। তাদের নেতৃত্বে স্থানীয়দের হুমকি-ধমকি দিয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্থানীয়রা আরও জানান, গোলাপ চাষে প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। এজন্য তারা বাগানের ভেতরে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিলেন। তবে আবাসন কোম্পানির লোকজন জোরপূর্বক নলকূপগুলো তুলে ফেলেছে। এতে পানির অভাবে গোলাপের ফলন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেক চারাই রোদে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। পেটের দায়ে এখন অনেকে নামমাত্র মূল্যে তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন ওই কোম্পানির কাছে। একসময় সরাসরি গোলাপ চাষে যুক্ত
ছিলেন প্রায় দুই হাজার কৃষক; তাদের অধিকাংশই এখন পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গোলাপ গ্রাম মূলত কুমার খোদা ও শিশার চর—এই দুই মৌজায় বিস্তৃত। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট নদী, স্থানীয়ভাবে যা শিশাচর নদী নামে পরিচিত। নদীটি তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। বর্ষাকালে আশপাশের গ্রামের পানি এ নদী দিয়ে তুরাগে গিয়ে পড়ে। আবার শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা সেই নদীর পানি বাগানে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সেটিও অতীত। আবাসন কোম্পানি নদীর এক-তৃতীয়াংশ মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলেছে। প্রতিদিনই এক্সক্যাভেটর দিয়ে নদী, জলাশয় ও আশপাশের জমিতে ফেলা হচ্ছে মাটি। প্লট বিক্রি করতে ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ কোম্পানিটি ব্রুশিয়ারে যে ম্যাপ তৈরি করেছে, তাতে
স্থানীয় খাসজমির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়িও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্থানীয়দের কয়েকজন বলেন, এরা প্রথমে অল্প একটু জমি কিনে এলাকায় প্রবেশ করেছে। পরে কয়েকজন প্রভাবশালীর সহায়তায় পুরো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে। গোলাপ চাষের জমি প্রায় সবটাই দখল নিয়েছে। খাসজমিও নিয়েছে। এখন নজর পড়েছে স্থানীয় জনগণের ভিটেমাটির ওপর। তারা বলেন, কোম্পানিটি যে ম্যাপ বানিয়েছে, তাতে এ এলাকার মানুষের বাড়িঘরের জমিও রয়েছে। স্থানীয় কৃষক কাব্বাছ পাহলোয়ান। বেশ জমি রয়েছে তার। চাষবাস করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। ২০১৩ সালে ৫০ শতাংশ জায়গা কেনার জন্য লেক আইল্যান্ড কোম্পানি ৫ লাখ টাকা বায়না করে। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। আর কোনো টাকা না দিয়েই দখলে নিয়েছে পুরো জমি। এরপর কাব্বাছ পাহলোয়ান মামলা করেন; আদালত তার পক্ষে রায় দিলেও এখনো জমি ফেরত দেয়নি কোম্পানিটি। গোলাপ গ্রামে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। অন্তত ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপ করেছে, যাদের সবাই জানান, লেক আইল্যান্ড প্রথমে সামান্য কিছু টাকা বায়না করে জমির দখল নেয়। এরপর আর টাকা দেয় না। আবার কেউ জমি দিতে না চাইলে পাশের জমিতে গভীর গর্ত করে দেয়। রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেয় জমির মাটি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে জমি ছাড়তে হয় কৃষককে। এমন আরেকজন ভুক্তভোগী কৃষক নাজিমউদ্দিন। তার প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে কোম্পানিটি। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘোরালেও জমি কিংবা টাকা—কোনোটিই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু নদী বা কৃষকদের ব্যক্তিগত জমিই নয়, সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের (নবাব স্টেট) সম্পত্তিও দখল করেছে কোম্পানিটি। স্থানীয় আমিনবাজার ভূমি অফিসের তথ্যানুযায়ী, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ৬.১৫৭৫ একর জমির মধ্যে প্রায় ৪.৯০৭৫ একর বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে লেক আইল্যান্ড কোম্পানি সরাসরি ২.১৫ একর জমি দখল করেছে। সেখানে তারা নির্মাণাধীন ভবন, সেমিপাকা অফিসঘর ও টিনশেড পশুপালন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। কিছু অংশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছও রোপণ করেছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের পাশে খাঁচা তৈরি করে সেখানে অন্তত ৯টি হরিণ পালনেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। সরকারি ওই সম্পত্তির আরও ১.৩০ একর জমি দখলে নিয়েছে মো. শরীফ গং এবং ১.৫০ একর জমি দখলে রেখেছে সালাম গং পরিবার। তারা সেখানে বাউন্ডারি ওয়াল ও টিনের বেড়া নির্মাণ করেছে। অবশিষ্ট প্রায় ১.২০ একর জমি এখন পতিত অবস্থায় রয়েছে। এক যুগ ধরে গোলাপ চাষের সঙ্গে যুক্ত সাদুল্লাহপুরের কৃষক মো. ইয়াসিন। তবে আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। ইয়াসিন বলেন, ‘কোম্পানি এমন অবস্থা তৈরি করছে যে, জমি বেচা ছাড়া উপায় নেই। তারা রাস্তা দিয়ে ক্ষেতে যেতে দেয় না, ফুল তুলতেও বাধা দেয়, এমনকি ক্ষেতের নলকূপও তুলে ফেলেছে। এখন জমি বেচা ছাড়া কিছু করার নেই।’ গত ১ জুন গোলাপ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এক কৃষক গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। কথা বলতে চাইলে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি কথা বলেছি কোম্পানি যদি সেটা জানতে পারে, তাহলে গরু নিয়েও এখানে আসতে দেবে না। তারা অনেক ক্ষমতাশালী।’ পঞ্চাশোর্ধ্ব এক কৃষক বলেন, ‘গোলাপের চারা একবার লাগিয়ে পরিচর্যা করলে এক যুগেরও বেশি সময় ফুল দেয়। শুধু সার ও পানি দিলে চলবে। সারা বছর ফুল হয়। কিন্তু কোম্পানি যেভাবে গর্ত করে জমি নষ্ট করছে, এভাবে চললে গোলাপ চাষ আর থাকবে না। পেট বাঁচাতে ভিটেবাড়ি ফেলে চলে যেতে হবে।’ পরিচয় গোপন করে ক্রেতা সেজে কথা হয় লেক আইল্যান্ড কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের হেড সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার সাইফুল নামে আর এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। জমি ক্রয়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্লট অনুযায়ী জমির দাম ৯ থেকে ২০ লাখ টাকা কাঠাপ্রতি। তবে একসঙ্গে বেশি জমি নিলে দাম কিছুটা কম রাখা যাবে।’ কাগজপত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্রে কোনো সমস্যা নেই।’ কৃষিজমি হওয়ায় আবাসিক প্লট রেজিস্ট্রেশনে সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে কোম্পানির এ প্রতিনিধি বলেন, ‘এখানে আগে গোলাপের চাষ হতো। কৃষি এবং আরবান দুটাই আছে। যে কারণে রেজিস্ট্রেশনে কোনো সমস্যা নেই। যদি সব কৃষি হতো, তাহলে ঝামেলা হতো।’ বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় লেক আইল্যান্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রশ্ন শুনে বলেন, অভিযোগ থাকলে রিপোর্ট করে দেন। কোনো অসুবিধা নেই। রিপোর্ট করে দেন।
বাড়ছে, তখন আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনে সাভারের গোলাপ গ্রাম ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার সুবাস। জানা যায়, ঢাকার কাছাকাছি ভ্রমণের আদর্শ স্থান ছিল গোলাপ গ্রাম। একটু মুক্ত হাওয়া ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে সুযোগ পেলেই রাজধানীবাসী ছুটে যেতেন সেখানে। লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি—বিভিন্ন রং ও আকৃতির গোলাপের চাষ হতো এ গ্রামে। বিভিন্ন জাতের গোলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মিরিন্ডা গোলাপ, চায়না গোলাপ ও ইরানি গোলাপ। গোলাপের পাশাপাশি চাষ হতো জারবেরা, রজনিগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা ফুল। তবে এসবই এখন অতীত। সরেজমিন দেখা যায়, একসময় ফুলপ্রেমীদের প্রিয় গোলাপ গ্রাম এখন অনেকটাই মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। রাজধানীবাসীর আকর্ষণীয় ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি
কেটে তৈরি করা হচ্ছে গভীর গিরিখাত। সেই মাটি আবার ট্রাকে করে ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে। পরে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন আকারের প্লট। পুরো গোলাপ বাগানে টানানো হয়েছে রং-বেরঙের সাইনবোর্ড, তাতে ‘প্লট বিক্রয় চলছে’—এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন। হাতেগোনা কয়েকটি বাগান এখনো টিকে আছে, তবে চারপাশের মাটি কেটে গর্ত তৈরি করায় সেগুলোও চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক স্থান থেকে মাটি কেটে অন্য স্থানে ফেলে এভাবে প্লট বানানোর কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। সরেজমিন দেখা যায়, গোলাপ বাগানের প্রবেশমুখে হাতের ডানপাশেই বিশাল এক গিরিখাত। তার পাশের কয়েকটি বাগানের চারপাশে প্রায় ১০ ফুটেরও বেশি গভীর গর্ত করা হয়েছে। ফলে সেসব বাগানে গোলাপের ফলন হচ্ছে না; চারা মরে যাচ্ছে।
চারদিকে গভীর গর্ত থাকায় পরিচর্যার জন্য বাগানে ঢোকাও এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হলে জায়গাগুলো ছোট ছোট জলাশয়ে পরিণত হয়। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক চাষি তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্থানীয় গোলাপ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ নামে একটি আবাসন কোম্পানি প্রথমে বাগানের মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করে। এরপর রাস্তার দুপাশের কিছু জমি কিনে সেখানে মাটি কেটে বড় বড় গর্ত তৈরি করে। এতে আশপাশের জমিগুলো চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে। চাষিরা জানান, কেউ জমি বিক্রি করতে না চাইলে তাদের চলাচলে বাধা দেওয়া হয় সেই রাস্তা দিয়ে, এমনকি ফুল পরিবহনেও নানা রকম বাধা দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আবাসন
কোম্পানিটির নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী আছে। যারা জমি বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে এ বাহিনী। চাষিদের দাবি, লেক আইল্যান্ড গ্রুপের এ ক্যাডার বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন হাকিম ও বারেক নামে দুই ব্যক্তি। তাদের নেতৃত্বে স্থানীয়দের হুমকি-ধমকি দিয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্থানীয়রা আরও জানান, গোলাপ চাষে প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। এজন্য তারা বাগানের ভেতরে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিলেন। তবে আবাসন কোম্পানির লোকজন জোরপূর্বক নলকূপগুলো তুলে ফেলেছে। এতে পানির অভাবে গোলাপের ফলন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেক চারাই রোদে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। পেটের দায়ে এখন অনেকে নামমাত্র মূল্যে তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন ওই কোম্পানির কাছে। একসময় সরাসরি গোলাপ চাষে যুক্ত
ছিলেন প্রায় দুই হাজার কৃষক; তাদের অধিকাংশই এখন পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গোলাপ গ্রাম মূলত কুমার খোদা ও শিশার চর—এই দুই মৌজায় বিস্তৃত। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট নদী, স্থানীয়ভাবে যা শিশাচর নদী নামে পরিচিত। নদীটি তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। বর্ষাকালে আশপাশের গ্রামের পানি এ নদী দিয়ে তুরাগে গিয়ে পড়ে। আবার শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা সেই নদীর পানি বাগানে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সেটিও অতীত। আবাসন কোম্পানি নদীর এক-তৃতীয়াংশ মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলেছে। প্রতিদিনই এক্সক্যাভেটর দিয়ে নদী, জলাশয় ও আশপাশের জমিতে ফেলা হচ্ছে মাটি। প্লট বিক্রি করতে ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ কোম্পানিটি ব্রুশিয়ারে যে ম্যাপ তৈরি করেছে, তাতে
স্থানীয় খাসজমির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়িও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্থানীয়দের কয়েকজন বলেন, এরা প্রথমে অল্প একটু জমি কিনে এলাকায় প্রবেশ করেছে। পরে কয়েকজন প্রভাবশালীর সহায়তায় পুরো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে। গোলাপ চাষের জমি প্রায় সবটাই দখল নিয়েছে। খাসজমিও নিয়েছে। এখন নজর পড়েছে স্থানীয় জনগণের ভিটেমাটির ওপর। তারা বলেন, কোম্পানিটি যে ম্যাপ বানিয়েছে, তাতে এ এলাকার মানুষের বাড়িঘরের জমিও রয়েছে। স্থানীয় কৃষক কাব্বাছ পাহলোয়ান। বেশ জমি রয়েছে তার। চাষবাস করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। ২০১৩ সালে ৫০ শতাংশ জায়গা কেনার জন্য লেক আইল্যান্ড কোম্পানি ৫ লাখ টাকা বায়না করে। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। আর কোনো টাকা না দিয়েই দখলে নিয়েছে পুরো জমি। এরপর কাব্বাছ পাহলোয়ান মামলা করেন; আদালত তার পক্ষে রায় দিলেও এখনো জমি ফেরত দেয়নি কোম্পানিটি। গোলাপ গ্রামে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। অন্তত ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপ করেছে, যাদের সবাই জানান, লেক আইল্যান্ড প্রথমে সামান্য কিছু টাকা বায়না করে জমির দখল নেয়। এরপর আর টাকা দেয় না। আবার কেউ জমি দিতে না চাইলে পাশের জমিতে গভীর গর্ত করে দেয়। রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেয় জমির মাটি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে জমি ছাড়তে হয় কৃষককে। এমন আরেকজন ভুক্তভোগী কৃষক নাজিমউদ্দিন। তার প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে কোম্পানিটি। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘোরালেও জমি কিংবা টাকা—কোনোটিই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু নদী বা কৃষকদের ব্যক্তিগত জমিই নয়, সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের (নবাব স্টেট) সম্পত্তিও দখল করেছে কোম্পানিটি। স্থানীয় আমিনবাজার ভূমি অফিসের তথ্যানুযায়ী, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ৬.১৫৭৫ একর জমির মধ্যে প্রায় ৪.৯০৭৫ একর বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে লেক আইল্যান্ড কোম্পানি সরাসরি ২.১৫ একর জমি দখল করেছে। সেখানে তারা নির্মাণাধীন ভবন, সেমিপাকা অফিসঘর ও টিনশেড পশুপালন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। কিছু অংশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছও রোপণ করেছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের পাশে খাঁচা তৈরি করে সেখানে অন্তত ৯টি হরিণ পালনেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। সরকারি ওই সম্পত্তির আরও ১.৩০ একর জমি দখলে নিয়েছে মো. শরীফ গং এবং ১.৫০ একর জমি দখলে রেখেছে সালাম গং পরিবার। তারা সেখানে বাউন্ডারি ওয়াল ও টিনের বেড়া নির্মাণ করেছে। অবশিষ্ট প্রায় ১.২০ একর জমি এখন পতিত অবস্থায় রয়েছে। এক যুগ ধরে গোলাপ চাষের সঙ্গে যুক্ত সাদুল্লাহপুরের কৃষক মো. ইয়াসিন। তবে আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। ইয়াসিন বলেন, ‘কোম্পানি এমন অবস্থা তৈরি করছে যে, জমি বেচা ছাড়া উপায় নেই। তারা রাস্তা দিয়ে ক্ষেতে যেতে দেয় না, ফুল তুলতেও বাধা দেয়, এমনকি ক্ষেতের নলকূপও তুলে ফেলেছে। এখন জমি বেচা ছাড়া কিছু করার নেই।’ গত ১ জুন গোলাপ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এক কৃষক গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। কথা বলতে চাইলে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি কথা বলেছি কোম্পানি যদি সেটা জানতে পারে, তাহলে গরু নিয়েও এখানে আসতে দেবে না। তারা অনেক ক্ষমতাশালী।’ পঞ্চাশোর্ধ্ব এক কৃষক বলেন, ‘গোলাপের চারা একবার লাগিয়ে পরিচর্যা করলে এক যুগেরও বেশি সময় ফুল দেয়। শুধু সার ও পানি দিলে চলবে। সারা বছর ফুল হয়। কিন্তু কোম্পানি যেভাবে গর্ত করে জমি নষ্ট করছে, এভাবে চললে গোলাপ চাষ আর থাকবে না। পেট বাঁচাতে ভিটেবাড়ি ফেলে চলে যেতে হবে।’ পরিচয় গোপন করে ক্রেতা সেজে কথা হয় লেক আইল্যান্ড কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের হেড সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার সাইফুল নামে আর এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। জমি ক্রয়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্লট অনুযায়ী জমির দাম ৯ থেকে ২০ লাখ টাকা কাঠাপ্রতি। তবে একসঙ্গে বেশি জমি নিলে দাম কিছুটা কম রাখা যাবে।’ কাগজপত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্রে কোনো সমস্যা নেই।’ কৃষিজমি হওয়ায় আবাসিক প্লট রেজিস্ট্রেশনে সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে কোম্পানির এ প্রতিনিধি বলেন, ‘এখানে আগে গোলাপের চাষ হতো। কৃষি এবং আরবান দুটাই আছে। যে কারণে রেজিস্ট্রেশনে কোনো সমস্যা নেই। যদি সব কৃষি হতো, তাহলে ঝামেলা হতো।’ বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় লেক আইল্যান্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রশ্ন শুনে বলেন, অভিযোগ থাকলে রিপোর্ট করে দেন। কোনো অসুবিধা নেই। রিপোর্ট করে দেন।



