পুঁজিবাজারে সূচক-মূলধন-পুঁজি কমে বিনিয়োগকারীরা হতাশ
বিদেশে অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট এবং দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে তলানিতে ঠেলে দিয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারে ধরাবাহিকভাবে সূচকের পতনের সঙ্গে কমেছে বাজার মূলধন। এতে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাই বছড়জুড়ে পুঁজিবাজারে সূচক, মূলধন ও পুঁজি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে চলতি বছরের শেষের পাঁচ মাস রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি) কঠোর অবস্থান নিলেও তা কাজে আসেনি। ফলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা না ফেরায় বছরজুড়েই ছিল বিনিয়োগকারীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ
কর্মসূচি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারের পতনের মাত্র বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের ‘লংমার্চ’ কর্মসূচিতে বিএসইসির কার্যালয় ঘেরাও এবং প্রধান ফটকে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপ কামনা করে স্মারকলিপি দেন বিনিয়োগকারীরা। তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি বাধ্য হয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সেহিসেবে তিনি চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে
দায়িত্ব দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। আর গত ১৯ আগস্ট তিনি বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেহিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৪ মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। গত এক বছরের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ২৩২.৮৭ পয়েন্টে। আর ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৫ হাজার ২২১.৫৭ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১ হাজার ১১.৩০ পয়েন্ট বা ১৬.২২ শতাংশ। এদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার দিন গত ১৯ আগস্ট
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৫ হাজার ২২১.৫৭ পয়েন্টে। ফলে তার কাজে যোগদানের সাড়ে ৪ মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৫৫৩.৯২ পয়েন্ট বা ৯.৫৯ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক সর্বনিম্ন কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে। এর আগের দিন সূচকটি ১৪৯.২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছিল ৪ হাজার ৯৬৫.৩৯ পয়েন্টে। যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে। আর ডিএসইএক্স সূচকটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ বেড়েছিল ৬ হাজার ৪৪৭.০৭
পয়েন্টে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস সূচক ছিল ১ হাজার ৩৬১.২৩ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএস সূচক অবস্থান করছে ১ হাজার ১৬৭.৩৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক কমেছে ১৯৩.৮৮ পয়েন্ট বা ১৪.২৪ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএস৩০ সূচক ছিল ২ হাজার ৯১.৫৪ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএস৩০ সূচক কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৩৮.২৯ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক কমেছে ১৫৩.২৫ পয়েন্ট বা ৭.৩২ শতাংশ। এদিকে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি ৪২ লাখ ২
হাজার টাকা। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২০৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই’র বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ১৫.৫৮ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ২৯ লাখ টাকায়, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদিকে চলতি বছরের ২৮ মে ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বনিম্ন করে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫১ হাজার ২৮৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়। বিনিয়োগকারী বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি বছরে স্মরণকালের সবচেয়ে
বেশি পতন ঘটেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চার বছরে মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। চীত বছরের গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক কমে ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। ২০১০ সালের চেয়ে চলতি বছরে বিনিয়োগকারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, কোনো কোনো শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে টানা দরপতনের ফলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিনিয়োগকারীরা আস্থা অর্জন করতে পারেননি। ধারাবাহিক পতনের কারণে প্রতিদিনই পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সব হারিয়ে তারা প্রায় নিঃস্ব। বিপর্যস্ত এমন পরিস্থিতিকে নীরব ‘রক্তক্ষরণ’ বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি: গত ১৯ অক্টোবর বড় দরপতনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও অস্তিত্বহীন কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তি ও জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের সীমা পরিবর্তনসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বাজারের প্রকৃত অবস্থা ঢেকে রাখা হয়েছিল। এখন কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় অনিয়ম, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে বাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, সুশাসন নিশ্চিতে বিএসইসি ও সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএসইসি। পুনর্গঠিত বিএসইসির গৃহীত উদ্যোগ: গত ১৯ আগস্ট বিএসইসিতে যোগদানের দিন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ গণমাধ্যমকে জানান, পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করা ও আস্থা ফেরানো তার প্রথম কাজ। পূ্ঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। গত একদশকে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। গত ৪ মাসে পুঁজিবাজারে সুশাসন অনতে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২২ কোটি টাকার জরিমানা করেছে। যা বিএসইসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ জরিমানার সিদ্ধান্ত। পুঁজিবাজারে পুনগর্ঠত বিএসইসির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- অনিয়ম-কারসাজি-দুর্নীতি অনুসন্ধানে সমন্বিত তদন্ত কমিটি গঠন করা। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গত ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালটেন্ট জিয়া ইউ আহমেদ, ফিনান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট ইয়াওয়ার সাইদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। গঠিত সমন্বিত তদন্ত কমিটি পুঁজিবাজারের বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- পুঁজিবাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ৭ অক্টোবর একটি বিশেষ পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর সিনিয়র পার্টনার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন। এ টাস্ক ফোর্স সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত বিবেচনা করে যৌক্তিক সময়ে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন (বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়াদি) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিকট হস্তান্তর করবে। চলতি বছরে পুনর্গঠিত বিএসইসির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যানসহ সকল স্বতন্ত্র পরিচালকদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা। ২. ডিএসই ও সিএসইর কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে পৃথক দুইটি পরিদর্শন কমিটি গঠন। ৩. পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ১১ ব্যক্তির বেনিফিসিয়াল ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও অ্যকাউন্ট) জব্দ করা। ৪. মাল্টি সিকিউরিটিজের সকল সুবিধায় নিষেধাজ্ঞা। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ ব্যক্তির লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা। ৫. বিএসইসির দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম' এর শুভেচ্ছা দূত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নিয়োগ বাতিল। ৬. শেয়ারের দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) প্রত্যাহার। ৭. জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সঙ্গে বিএসইসির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব বাতিল। ৮. শেয়ার দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে পুরনো সার্কিট ব্রেকার পুর্নবহাল করা হয়। ৯. সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ ২০ জনের বিও হিসাব জব্দ। ১০. সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। একই সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ তার পরিবার অন্যান্য সদস্য ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের স্ত্রী, মেয়ের স্বামী, আত্মীয়সহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হবে। ১১. অ্যাসেট ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান স্ট্রাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। ১২. ব্রোকারেজ হাউজ সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওদের ব্যাংক ও বিও হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ১৩. মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে তালিকাভুক্ত সিডব্লিউটি প্রাইভেট ইক্যুইটি লিমিটেডের পরিচালিত চার ফান্ডের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ। ১৪. মার্চেন্ট ব্যাংক এসএফআইএল ফাইন্যান্স পিএলসির (পূর্বের নাম স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড) অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন। ১৫. লেনদেন নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এ জন্য ডি্এসই ও সিএসইতে সমন্বিত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬. বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সিস্টেম আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। ১৭. জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষা দিতে গ্রামীণফোন ও বিএসইসি একসঙ্গে কাজ করবে। ১৮. ২৮টি কোম্পানিকে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগারি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১৯. পুঁজিবাজারের ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৬ সদষ্যের কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৯টি কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা পুনঃ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আরপিও) মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থ কোথায় ও কিভাবে বিনিয়োগ করেছে তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত। ২১. পুঁজিবাজারের স্বার্থে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও পিএইচপি গ্রুপের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিএসইসি আলোচনা। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের অন্যতম বৃহৎ তিনটি শিল্পগোষ্ঠী বিএসআরএম, পিএইচপি ও প্যাসিফিক জিন্সের সঙ্গে বৈঠক করে বিএসইস্ভি ২২. ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত করা যেসব কোম্পানি ইতোমধ্যে অনুমোদিত লভ্যাংশের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ বিতরণ সম্পন্ন করেছে সেসব কোম্পানির ক্যাটাগরি স্থানান্তরের নির্দেশ। ২৩. অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে নীতি সহায়তার প্রস্তাব। ২৪. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মূলধনী মুনাফার ওপর কর কমানোর সুপারিশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ার লেনদেন থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর করের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে করহার ছিল ৩০ শতাংশ। ২৫. এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার এবং বিগত ৬ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। ২৬. কাট্টলি টেক্সটাইলের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সংগ্রহীত তহবিল "নয়ছয়" করার অভিযোগ বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ। ২৭. সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৯১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ১১৭টি বিও অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ। ২৮. অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সম্পদ, ব্যবসা ও আর্থিক সক্ষমতাসহ সার্বিক বিষয় যাচাই বাছাইয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন। ২৯. বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাত করে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহায়তা কামনা। ৩০. পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও ঋণশোধের জন্য সাভরেন গ্যারান্টির বিপরীতে রাষ্ট্রয়াত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) স্বল্প সুদ হারে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের সুপারিশ। ৩১. পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত বেক্সিমকো গ্রুপের তিনটি কোম্পানি- বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (বেক্সিমকো), বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদনের বিশেষ নিরীক্ষার নির্দেশ।
কর্মসূচি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারের পতনের মাত্র বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের ‘লংমার্চ’ কর্মসূচিতে বিএসইসির কার্যালয় ঘেরাও এবং প্রধান ফটকে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপ কামনা করে স্মারকলিপি দেন বিনিয়োগকারীরা। তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি বাধ্য হয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সেহিসেবে তিনি চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে
দায়িত্ব দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। আর গত ১৯ আগস্ট তিনি বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেহিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৪ মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। গত এক বছরের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ২৩২.৮৭ পয়েন্টে। আর ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৫ হাজার ২২১.৫৭ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১ হাজার ১১.৩০ পয়েন্ট বা ১৬.২২ শতাংশ। এদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার দিন গত ১৯ আগস্ট
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৫ হাজার ২২১.৫৭ পয়েন্টে। ফলে তার কাজে যোগদানের সাড়ে ৪ মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৫৫৩.৯২ পয়েন্ট বা ৯.৫৯ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক সর্বনিম্ন কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে। এর আগের দিন সূচকটি ১৪৯.২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছিল ৪ হাজার ৯৬৫.৩৯ পয়েন্টে। যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে। আর ডিএসইএক্স সূচকটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ বেড়েছিল ৬ হাজার ৪৪৭.০৭
পয়েন্টে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস সূচক ছিল ১ হাজার ৩৬১.২৩ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএস সূচক অবস্থান করছে ১ হাজার ১৬৭.৩৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক কমেছে ১৯৩.৮৮ পয়েন্ট বা ১৪.২৪ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএস৩০ সূচক ছিল ২ হাজার ৯১.৫৪ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএস৩০ সূচক কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৩৮.২৯ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক কমেছে ১৫৩.২৫ পয়েন্ট বা ৭.৩২ শতাংশ। এদিকে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি ৪২ লাখ ২
হাজার টাকা। আর চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২০৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই’র বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ১৫.৫৮ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ২৯ লাখ টাকায়, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদিকে চলতি বছরের ২৮ মে ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বনিম্ন করে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫১ হাজার ২৮৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়। বিনিয়োগকারী বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি বছরে স্মরণকালের সবচেয়ে
বেশি পতন ঘটেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চার বছরে মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। চীত বছরের গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক কমে ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। ২০১০ সালের চেয়ে চলতি বছরে বিনিয়োগকারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, কোনো কোনো শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে টানা দরপতনের ফলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিনিয়োগকারীরা আস্থা অর্জন করতে পারেননি। ধারাবাহিক পতনের কারণে প্রতিদিনই পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সব হারিয়ে তারা প্রায় নিঃস্ব। বিপর্যস্ত এমন পরিস্থিতিকে নীরব ‘রক্তক্ষরণ’ বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি: গত ১৯ অক্টোবর বড় দরপতনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও অস্তিত্বহীন কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তি ও জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের সীমা পরিবর্তনসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বাজারের প্রকৃত অবস্থা ঢেকে রাখা হয়েছিল। এখন কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় অনিয়ম, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে বাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, সুশাসন নিশ্চিতে বিএসইসি ও সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএসইসি। পুনর্গঠিত বিএসইসির গৃহীত উদ্যোগ: গত ১৯ আগস্ট বিএসইসিতে যোগদানের দিন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ গণমাধ্যমকে জানান, পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করা ও আস্থা ফেরানো তার প্রথম কাজ। পূ্ঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। গত একদশকে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। গত ৪ মাসে পুঁজিবাজারে সুশাসন অনতে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২২ কোটি টাকার জরিমানা করেছে। যা বিএসইসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ জরিমানার সিদ্ধান্ত। পুঁজিবাজারে পুনগর্ঠত বিএসইসির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- অনিয়ম-কারসাজি-দুর্নীতি অনুসন্ধানে সমন্বিত তদন্ত কমিটি গঠন করা। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গত ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালটেন্ট জিয়া ইউ আহমেদ, ফিনান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট ইয়াওয়ার সাইদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। গঠিত সমন্বিত তদন্ত কমিটি পুঁজিবাজারের বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- পুঁজিবাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ৭ অক্টোবর একটি বিশেষ পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর সিনিয়র পার্টনার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন। এ টাস্ক ফোর্স সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত বিবেচনা করে যৌক্তিক সময়ে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন (বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়াদি) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিকট হস্তান্তর করবে। চলতি বছরে পুনর্গঠিত বিএসইসির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যানসহ সকল স্বতন্ত্র পরিচালকদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা। ২. ডিএসই ও সিএসইর কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে পৃথক দুইটি পরিদর্শন কমিটি গঠন। ৩. পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ১১ ব্যক্তির বেনিফিসিয়াল ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও অ্যকাউন্ট) জব্দ করা। ৪. মাল্টি সিকিউরিটিজের সকল সুবিধায় নিষেধাজ্ঞা। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ ব্যক্তির লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা। ৫. বিএসইসির দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম' এর শুভেচ্ছা দূত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নিয়োগ বাতিল। ৬. শেয়ারের দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) প্রত্যাহার। ৭. জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সঙ্গে বিএসইসির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব বাতিল। ৮. শেয়ার দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে পুরনো সার্কিট ব্রেকার পুর্নবহাল করা হয়। ৯. সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ ২০ জনের বিও হিসাব জব্দ। ১০. সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। একই সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ তার পরিবার অন্যান্য সদস্য ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের স্ত্রী, মেয়ের স্বামী, আত্মীয়সহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হবে। ১১. অ্যাসেট ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান স্ট্রাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। ১২. ব্রোকারেজ হাউজ সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওদের ব্যাংক ও বিও হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ১৩. মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে তালিকাভুক্ত সিডব্লিউটি প্রাইভেট ইক্যুইটি লিমিটেডের পরিচালিত চার ফান্ডের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ। ১৪. মার্চেন্ট ব্যাংক এসএফআইএল ফাইন্যান্স পিএলসির (পূর্বের নাম স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড) অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন। ১৫. লেনদেন নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এ জন্য ডি্এসই ও সিএসইতে সমন্বিত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬. বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সিস্টেম আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। ১৭. জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষা দিতে গ্রামীণফোন ও বিএসইসি একসঙ্গে কাজ করবে। ১৮. ২৮টি কোম্পানিকে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগারি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১৯. পুঁজিবাজারের ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৬ সদষ্যের কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৯টি কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা পুনঃ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আরপিও) মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থ কোথায় ও কিভাবে বিনিয়োগ করেছে তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত। ২১. পুঁজিবাজারের স্বার্থে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও পিএইচপি গ্রুপের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিএসইসি আলোচনা। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের অন্যতম বৃহৎ তিনটি শিল্পগোষ্ঠী বিএসআরএম, পিএইচপি ও প্যাসিফিক জিন্সের সঙ্গে বৈঠক করে বিএসইস্ভি ২২. ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত করা যেসব কোম্পানি ইতোমধ্যে অনুমোদিত লভ্যাংশের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ বিতরণ সম্পন্ন করেছে সেসব কোম্পানির ক্যাটাগরি স্থানান্তরের নির্দেশ। ২৩. অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে নীতি সহায়তার প্রস্তাব। ২৪. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মূলধনী মুনাফার ওপর কর কমানোর সুপারিশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ার লেনদেন থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর করের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে করহার ছিল ৩০ শতাংশ। ২৫. এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার এবং বিগত ৬ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। ২৬. কাট্টলি টেক্সটাইলের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সংগ্রহীত তহবিল "নয়ছয়" করার অভিযোগ বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ। ২৭. সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৯১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ১১৭টি বিও অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ। ২৮. অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সম্পদ, ব্যবসা ও আর্থিক সক্ষমতাসহ সার্বিক বিষয় যাচাই বাছাইয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন। ২৯. বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাত করে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহায়তা কামনা। ৩০. পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও ঋণশোধের জন্য সাভরেন গ্যারান্টির বিপরীতে রাষ্ট্রয়াত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) স্বল্প সুদ হারে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের সুপারিশ। ৩১. পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত বেক্সিমকো গ্রুপের তিনটি কোম্পানি- বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (বেক্সিমকো), বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদনের বিশেষ নিরীক্ষার নির্দেশ।