ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
নির্বাচনের সময় পুরোপুরি ক্ষমতা চায় ইসি
পতিত স্বৈরাচার সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার দায়ে ৩৭ জন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। সোমবার (১৮ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ এবং সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এ বিষয়টি জানানো হয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সদস্যপদ স্থগিত হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন- নূরুল আমিন প্রভাষ, জায়েদুল আহসান পিন্টু, মোজাম্মেল বাবু, আশীষ সৈকত, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সোহেল হায়দার চৌধুরী, ফারজানা রূপা, অশোক চৌধুরী, আজমল হক হেলাল, আবুল খায়ের, মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম, প্রণব সাহা, নঈম নিজাম, খায়রুল আলম, আবেদ খান, সুভাষ চন্দ বাদল, জহিরুল ইসলাম মামুন (জ.ই মামুন), জাফর ওয়াজেদ, সাইফুল ইসলাম কল্লোল, পাভেল রহমান, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, শাবান মাহমুদ, মুহম্মদ শফিকুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, শ্যামল সরকার, অজয় দাশগুপ্ত, আলমগীর হোসেন, রমাপ্রসাদ সরকার বাবু, সঞ্জয় সাহা পিয়াল, ফারাজী আজমল হোসেন, আনিসুর রহমান, এনামুল হক চৌধুরী, নাঈমুল ইসলাম খান, মো. আশরাফ আলী, মোল্লা জালাল, ইখতিয়ার উদ্দিন এবং আবু জাফর সূর্য। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিন দফায় মোট ১৬৭ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি)। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ স্থগিত হলো যাদের আরও ২৯ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল এ বিষয়ে সোমবার সন্ধ্যায় কপ-২৯ পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, পিআইডি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হওয়ায় যেসব সাংবাদিক মনে করছেন তাদের প্রতি অবিচার হয়েছে, তারা আবেদন করতে পারেন। যাচাই-বাছাই করে তা দেখা হবে। গত ৭ নভেম্বর সবশেষ ১১৮ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়। এর আগে, ২৯ অক্টোবর ২০ সাংবাদিকের ও ৩ নভেম্বর আরও ২৯ জনের কার্ড বাতিল করে পিআইডি।
গণভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর পরামর্শ
সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলোর সমঝোতা স্বাক্ষর জরুরি
ইসি গঠনে ৭ নভেম্বরের মধ্যে নাম চেয়েছে সার্চ কমিটি
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে দলগুলোর মত নেবে কমিশন
বিদ্যমান আইনেই নির্বাচন কমিশনের হাত-পা বাঁধা
নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা। আইন অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে বাধ্য সরকার। এর পরও নানা সময় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। বিশেষ করে বিগত তিনটি নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা সব মহলেই সমালোচিত। একতরফা নির্বাচন, রাতের ভোট এবং ডামি নির্বাচনের কলঙ্ক বহন করতে হয়েছে বিগত সরকার ও নির্বাচন কমিশনগুলোকে।
ইসির পক্ষে এসব নির্বাচন কি এড়ানো সম্ভব ছিল, নাকি সাংবিধানিকভাবে বাধ্যবাধকতা ছিল এরকম বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে; সরকার কি নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেছিল, নাকি নির্বাচন কমিশনই সরকারের সহযোগী হিসেবে এসব বিতর্কিত ভোট আয়োজন করে সরকারকে ক্ষমতা নবায়নের সুযোগ করে দিয়েছে; সরকারের চাপের মুখে কীই—বা করার ছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির—এসব নানা প্রশ্ন
ঘুরপাক খাচ্ছে সব মহলে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ইসি সংস্কারে গঠন করা কমিশনের কাছে এসব প্রশ্ন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন অনুযায়ী সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সরকারকেও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কমিশনকে সেই ভোট আয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা করে যেতে হবে। সরকার সহযোগিতা না করলে কমিশন চাইলেই আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। অন্যদিকে ইসি সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের হাত-পা বাঁধা। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকার এবং প্রশাসনের সহযোগিতাই মুখ্য। তবে কাঙ্ক্ষিত ভোট আয়োজনে বাধাপ্রাপ্ত হলে কমিশন পদত্যাগ করে তার প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক
কারণে সেটিও সম্ভব হয় না। পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের আন্তরিকতা, বিদ্যমান আইনের আমূল পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এবং সর্বোপরি ভোটারদের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর জোর দেন তারা। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ইসির। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোট গ্রহণ, নির্বাচনের ফল ঘোষণা এবং নির্বাচনী অভিযোগ-মোকদ্দমা মীমাংসার লক্ষ্যে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা কমিশনেরই কাজ। সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন গঠন কাঠামো, ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ (৪), অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪-এ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ বলে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে
এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবে। নির্বাচন কমিশনারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে প্রয়োজনে কমিশনের সভাপতিকে বা এর যে কোনো সদস্যকে বা এর কোনো কর্মচারীকে আইনের অধীনে থেকে কমিশনের পক্ষে ক্ষমতা অনুশীলনের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫-এর ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তাদের চারজন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে বিদায় নেন। সরকারের কাজে অসন্তোষ থেকে পদত্যাগ করেন একজন।
আর একজন স্বাস্থ্যগত কারণে বিদায় নিয়েছিলেন। সর্বশেষ মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও তার আড়াই বছর গড়াতেই পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একাই নন, তার সহকর্মী অন্য চার কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ কমিশনের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ‘ডামি’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেই নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে মাত্র সাত মাসের মাথায় বিদায় নিলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তার আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে থেকেই
একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে কমিশন। আর ২০১৮ সালে নানা প্রতিশ্রুতির পর বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনা হলেও প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটের আগের রাতেই সারা দেশে ব্যালট বাক্স ভরে নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা, যা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। ওই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে রাতের সরকার ও রাতের কমিশন বলেও তকমা দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। আরেকটু সহজ করে বললে, অতীতের কমিশনগুলো নিজেদের শপথ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই
তৎপর ছিল। কারণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করা আছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সরকার কাজ না করলে আইনের বরখেলাপ হবে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত আইন অনুযায়ী কমিশনের অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তাদের অনেকেই নিজেদের ক্ষমতার কথা ভুলে গিয়ে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করেছেন। সরকার কোনো কাজে সহযোগিতা না করলে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার সুযোগ ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশে এ রকম অনেক নজির রয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো কমিশনই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায়নি। আসলে তারা সরকারের বিরাগভাজন হতে চাননি। তবে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যেমন ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি আবার আইনে অস্পষ্টতাও রেখে দিয়েছে বলে মত সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা অথবা না করা হলে সে ক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে, এটা নিয়ে আইনে সরাসরি কিছুই বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে সে ক্ষেত্রেও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে অতীতের বিভিন্ন সরকার। যেমন ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন নির্বাচনের দুদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিলেও তাতে সায় দেয়নি সরকার। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা খানিকটা হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, আসলে কমিশনের হাত-পা বাঁধা। সরকার ও মাঠ প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া এককভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করার সক্ষমতা কমিশনের নেই। তবে কমিশন চাইলে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে পদত্যাগ করতে পারে। কিন্তু ওই কমিশনারের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক নানা কারণে সেটি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা কোথায়—জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও বাস্তবে তা নয়। কারণ, কোনো দলকে জোর করে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কমিশনকে এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আইনে বলা আছে, সচিবের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কমিশন দায়বদ্ধ থাকবে। এতে বাস্তবে অন্য কমিশনারদের তেমন ভূমিকা থাকে না। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কোনো কোনো ধারা এখনো সুষ্ঠু নির্বাচনে অন্তরায় হয়ে আছে। এখন একটি স্বাধীন কমিশন চাইলে প্রচলিত আইনগুলোর সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে। পাশাপাশি সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং জনগণকেও সচেতনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ তবে সরকারের সহযোগিতা না পেলে পদত্যাগ করার স্বাধীনতা কমিশনের রয়েছে বলেও জানান সাবেক এই কমিশনার।
ঘুরপাক খাচ্ছে সব মহলে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ইসি সংস্কারে গঠন করা কমিশনের কাছে এসব প্রশ্ন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন অনুযায়ী সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সরকারকেও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কমিশনকে সেই ভোট আয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা করে যেতে হবে। সরকার সহযোগিতা না করলে কমিশন চাইলেই আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। অন্যদিকে ইসি সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের হাত-পা বাঁধা। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকার এবং প্রশাসনের সহযোগিতাই মুখ্য। তবে কাঙ্ক্ষিত ভোট আয়োজনে বাধাপ্রাপ্ত হলে কমিশন পদত্যাগ করে তার প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক
কারণে সেটিও সম্ভব হয় না। পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের আন্তরিকতা, বিদ্যমান আইনের আমূল পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এবং সর্বোপরি ভোটারদের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর জোর দেন তারা। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ইসির। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোট গ্রহণ, নির্বাচনের ফল ঘোষণা এবং নির্বাচনী অভিযোগ-মোকদ্দমা মীমাংসার লক্ষ্যে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা কমিশনেরই কাজ। সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন গঠন কাঠামো, ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ (৪), অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪-এ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ বলে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে
এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবে। নির্বাচন কমিশনারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে প্রয়োজনে কমিশনের সভাপতিকে বা এর যে কোনো সদস্যকে বা এর কোনো কর্মচারীকে আইনের অধীনে থেকে কমিশনের পক্ষে ক্ষমতা অনুশীলনের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫-এর ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তাদের চারজন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে বিদায় নেন। সরকারের কাজে অসন্তোষ থেকে পদত্যাগ করেন একজন।
আর একজন স্বাস্থ্যগত কারণে বিদায় নিয়েছিলেন। সর্বশেষ মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও তার আড়াই বছর গড়াতেই পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একাই নন, তার সহকর্মী অন্য চার কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ কমিশনের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ‘ডামি’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেই নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে মাত্র সাত মাসের মাথায় বিদায় নিলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তার আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে থেকেই
একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে কমিশন। আর ২০১৮ সালে নানা প্রতিশ্রুতির পর বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনা হলেও প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটের আগের রাতেই সারা দেশে ব্যালট বাক্স ভরে নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা, যা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। ওই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে রাতের সরকার ও রাতের কমিশন বলেও তকমা দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। আরেকটু সহজ করে বললে, অতীতের কমিশনগুলো নিজেদের শপথ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই
তৎপর ছিল। কারণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করা আছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সরকার কাজ না করলে আইনের বরখেলাপ হবে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত আইন অনুযায়ী কমিশনের অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তাদের অনেকেই নিজেদের ক্ষমতার কথা ভুলে গিয়ে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করেছেন। সরকার কোনো কাজে সহযোগিতা না করলে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার সুযোগ ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশে এ রকম অনেক নজির রয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো কমিশনই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায়নি। আসলে তারা সরকারের বিরাগভাজন হতে চাননি। তবে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যেমন ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি আবার আইনে অস্পষ্টতাও রেখে দিয়েছে বলে মত সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা অথবা না করা হলে সে ক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে, এটা নিয়ে আইনে সরাসরি কিছুই বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে সে ক্ষেত্রেও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে অতীতের বিভিন্ন সরকার। যেমন ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন নির্বাচনের দুদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিলেও তাতে সায় দেয়নি সরকার। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা খানিকটা হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, আসলে কমিশনের হাত-পা বাঁধা। সরকার ও মাঠ প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া এককভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করার সক্ষমতা কমিশনের নেই। তবে কমিশন চাইলে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে পদত্যাগ করতে পারে। কিন্তু ওই কমিশনারের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক নানা কারণে সেটি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা কোথায়—জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও বাস্তবে তা নয়। কারণ, কোনো দলকে জোর করে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কমিশনকে এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আইনে বলা আছে, সচিবের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কমিশন দায়বদ্ধ থাকবে। এতে বাস্তবে অন্য কমিশনারদের তেমন ভূমিকা থাকে না। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কোনো কোনো ধারা এখনো সুষ্ঠু নির্বাচনে অন্তরায় হয়ে আছে। এখন একটি স্বাধীন কমিশন চাইলে প্রচলিত আইনগুলোর সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে। পাশাপাশি সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং জনগণকেও সচেতনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ তবে সরকারের সহযোগিতা না পেলে পদত্যাগ করার স্বাধীনতা কমিশনের রয়েছে বলেও জানান সাবেক এই কমিশনার।