
ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর

মৃত ২৩ লাখ নাম বাদ, দেশে নতুন ভোটার ৬৩ লাখ

নির্বাচন ঘিরে ইসির বৈঠক, ভোটের সামগ্রী কেনাকাটার প্রস্তুতি

নিবন্ধন পেল নতুন রাজনৈতিক দল

নির্বাচনি আচরণবিধির খসড়া তৈরি, প্রচারণায় পোস্টার থাকছে না: ইসি

নির্বাচনের আচরণ বিধি নিয়ে ইসির বৈঠক আজ

সংস্কার কমিশনের ৯ সুপারিশে আপত্তি নির্বাচন কমিশনের

১৯ দেশের মিশন প্রধানদের ডেকেছে নির্বাচন কমিশন
নির্বাচনের পথেই সমাধান

সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এর মধ্যে কোনো না কোনো ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিনই চলছে রাজপথে আন্দোলন। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে অস্থিরতা। আবার শেয়ারবাজারের অবস্থা চরম নাজুক, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। বলা যায়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানামুখী সংকট ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনকেই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দলগুলো ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো নির্বাচিত সরকারের পক্ষে দ্রুত সমাধান দেওয়া সম্ভব। এজন্য দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিলে এ সংকট থাকবে না। রোডম্যাপ দিলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পড়বে। স্বাভাবিক হবে দেশের পরিস্থিতি। কিন্তু নির্বাচন যত
দেরি হবে দেশ ও গণতন্ত্র তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটা উচিত বলে মনে করেন তারা। তিন দফা দাবিতে রাজধানীতে ৪ দিন ধরে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ও বিচার দাবিতে টানা ৩ দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল। কুয়েটসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো অস্থিরতা কাটেনি। রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা শনিবার সংবাদ সম্মেলন করবে। এর মধ্যে বিভিন্ন দাবিতে ডিপ্লোমা নার্সসহ কয়েকটি সংগঠনও আন্দোলন করেছে। গত দুদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগরভবনের সামনেও চলেছে অবরোধ।
কয়েকদিন ধরে এসব আন্দোলনের কারণে ঢাকা একরকম দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আর বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে চলে ‘মব জাস্টিস’। এছাড়া দুর্নীতিবাজ-আওয়ামী দোসর নিয়োগ নিষিদ্ধ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বিতর্কিত পদোন্নতি প্রক্রিয়া রিভিউসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রশাসনেও চলছে অস্থিরতা। মানবিক করিডর ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি, কলকারখানায় গ্যাস সংকটসহ নানা সেক্টরে সমস্যা বিদ্যমান। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা বাংলাভাষীদের জোরপূর্বক ঠেলে (পুশইন) দিচ্ছে বিএসএফ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা গতানুগতিক নির্বাচিত সরকারের মতো নয়। সুতরাং মানবিক করিডরের কথা বলেন বা আরও যে অনেক দাবিতে আন্দোলন করছে, এসব দাবি পূরণের জন্য
তারা যথার্থ কিনা তা আগে সরকারকে নিজ থেকেই বলতে হবে। সরকার সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। দৈনন্দিন অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু সরকার মনোযোগ দিচ্ছে অসংখ্য কাজের মধ্যে, যেগুলো তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, যা প্রয়োজন নেই। সরকারের উচিত ছিল সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা জায়গায় ঐকমত্য করানো। সেই কাজের তো কোনো খবর নেই। এতে করে আমাদের দেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কিন্তু সংকট উত্তরণের জন্য জনগণ নিয়ে এসেছে, এখন সরকার যদি সংকটে ফেলে দেয় তাহলে আমরা জাতি হিসাবে দুর্ভাগা। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা
করছেন রাজনীতিবিদরা। এজন্য নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যে ৫০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। ২ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে (ভার্চুয়ালি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত সংস্কার এবং নাগরিকের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি সব সময় জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দাবি জানাবে, এটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নীতি। অথচ আমরা খেয়াল করছি, কিছুদিন ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে এমন একটি
আবহাওয়া তৈরি করছে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করাটাই যেন একটা অপরাধ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য-মন্তব্য কিন্তু পলাতক স্বৈরাচারকেই আনন্দ দেয়। অপরপক্ষে এটি গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য কিন্তু অপমানজনক।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচিত যে প্রতিনিধি থাকে তাদের সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের একটা সংযুক্তি আছে। স্বাভাবিকভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, চিন্তা, দাবি-দাওয়াসহ নানা সমস্যা জবাবদিহিতামূলক সরকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু এখন সরকার ও জনগণের মাঝখানে তো কেউ নেই। সংসদ নেই, সরকার নেই, প্রতিনিধি নেই। কেউ তো নেই, কে নিশ্চিত করবে? নির্বাচন দ্রুত হওয়া দরকার। একটা নির্বাচিত সরকার যত তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় আসবে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক যে সমস্যার
আমরা সম্মুখীন হচ্ছি, সেগুলো নির্বাচিত সরকারের পক্ষে দ্রুত সমাধান দেওয়া সম্ভব। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। কিন্তু সেটা যত দেরি করবে দেশ তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাবে। সম্প্রতি জেলা ও মহানগরের আমির সম্মেলনে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা দুটি সময়কে উপযুক্ত মনে করি। একটি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে। তবে যদি এ সময়ের মধ্যে সংস্কারগুলো এবং বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া জনমনে আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে না আসে, তাহলে সর্বোচ্চ এপ্রিল পার হওয়া উচিত নয়। দেশের আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতার বিষয় আছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ এবং মার্চ মাসের তিন ভাগের দুই ভাগ রোজা থাকবে। সে সময়ে নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারকে আমরা নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ পর্যন্ত সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের নানা অংশের সহযোগিতার পরেও পরিস্থিতি কোনোভাবেই সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটছে, দেশব্যাপী এক ধরনের আধা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। প্রচণ্ড একটি অস্থিরতা চলছে। দেশে কোনো সরকার আছে তা জনজীবনে অনুভব করা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য রোজার সময় কিছু সহনীয় থাকলেও এরপরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। নানা আন্দোলনের কারণে ঢাকা শহর এক ধরনের স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ঘটনা ঘটছে। একটি অনিশ্চিত জায়গায় যাত্রা করেছি। অথচ একটি অনির্বাচিত সরকার তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের বেশি সময় তারা পার করে ফেলেছেন। এই নয় মাসে সরকারের কোনো কোনো ব্যাপারে হয়তো সদিচ্ছা আছে, তা তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্র প্রশাসনে যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও শক্তি থাকা দরকার, তা এ সরকারের নেই। যে কারণে তারা দেশ পরিচালনায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছেন। আগামী দিনগুলোতে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণের পথ হলো জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের ব্যাপারে খুব দ্রুত একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটা। বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংকট এই সরকার নিজে ডেকে এনেছে। কারণ শেখ হাসিনাকে যে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী বলতাম তার কারণ কী? সে (শেখ হাসিনা) যে নীতিতে দেশ চালাচ্ছিল ফ্যাসিবাদ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। এই সরকার এসেও একই নীতিতে শুধু দেশ চালাচ্ছে না, যেটা শেখ হাসিনা করে যেতে পারেনি-যেমন করিডর, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর দেওয়া সেই কাজটাই তারা করছে। সুতরাং সরকার তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে যখন বাড়তি কাজ করতে চাচ্ছে, তখন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সংকট উত্তরণের একটিই পথ অন্তর্বর্তী সরকার তার এখতিয়ার ঠিক রেখে দ্রুত সময়ে নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করবে, তা করে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা করুক। এছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, সরকারের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের দায়িত্বহীনতা এবং সমন্বয়হীনতা দেখতে পাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সরকারের কোনো ক্রাইসিস ম্যানেজার নেই। ক্রাইসিস ম্যানেজার যদি থাকত তাহলে এরকমের দাবি-নামা উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যেত। মনে হচ্ছে সরকারের সব ফোকাস নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করা এবং ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার মধ্যে। এমনকি স্পর্শকাতর চট্টগ্রাম বন্দরও বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। অথচ এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রুটিন কাজের বাইরে যাওয়ার তাদের কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। আর নির্বাচন নিয়ে দু-একটি দলের অনীহা তাও একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের প্রশ্ন হলো এসব দলের ভোটের মাঠে অবস্থান কী? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এই চিন্তাটা তাদের মধ্যে নেই। এই চিন্তা যদি থাকত তাহলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য যে প্রক্রিয়া তাতে এই সময়ে মনোযোগ দিত এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করত। সরকার সংস্কারের পাশাপাশি বিচারের কাজটা অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে অনেক কাজে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। যে কাজগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণার সঙ্গে যায় না। এর কারণেই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের একটি তারিখ ঘোষণা করতে সরকারের সমস্যা কোথায়? একটি তারিখ ঘোষণা করেন, পরবর্তী সময়ে যদি কোনো ধরনের ক্রাইসিস তৈরি হয় বা জাতীয় সমস্যা তৈরি হয় তখন সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারিখ পরিবর্তন করা যাবে। যদি নির্বাচনের একটি তারিখ দিত সরকার, সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকত এবং নানা দাবি নিয়ে কেউ আসত না। সরকারের মূল কথা বলা উচিত আমরা কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার, আমাদের একটা সময় দিন। জবাবহিতিমূলক সরকার তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজগুলো যেন করতে পারি এবং নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। এটি যদি সরকার পরিষ্কারভাবে বলত তাহলে চলমান সমস্যাগুলো থাকত না।
দেরি হবে দেশ ও গণতন্ত্র তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটা উচিত বলে মনে করেন তারা। তিন দফা দাবিতে রাজধানীতে ৪ দিন ধরে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ও বিচার দাবিতে টানা ৩ দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল। কুয়েটসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো অস্থিরতা কাটেনি। রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা শনিবার সংবাদ সম্মেলন করবে। এর মধ্যে বিভিন্ন দাবিতে ডিপ্লোমা নার্সসহ কয়েকটি সংগঠনও আন্দোলন করেছে। গত দুদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগরভবনের সামনেও চলেছে অবরোধ।
কয়েকদিন ধরে এসব আন্দোলনের কারণে ঢাকা একরকম দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আর বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে চলে ‘মব জাস্টিস’। এছাড়া দুর্নীতিবাজ-আওয়ামী দোসর নিয়োগ নিষিদ্ধ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বিতর্কিত পদোন্নতি প্রক্রিয়া রিভিউসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রশাসনেও চলছে অস্থিরতা। মানবিক করিডর ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি, কলকারখানায় গ্যাস সংকটসহ নানা সেক্টরে সমস্যা বিদ্যমান। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা বাংলাভাষীদের জোরপূর্বক ঠেলে (পুশইন) দিচ্ছে বিএসএফ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা গতানুগতিক নির্বাচিত সরকারের মতো নয়। সুতরাং মানবিক করিডরের কথা বলেন বা আরও যে অনেক দাবিতে আন্দোলন করছে, এসব দাবি পূরণের জন্য
তারা যথার্থ কিনা তা আগে সরকারকে নিজ থেকেই বলতে হবে। সরকার সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। দৈনন্দিন অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু সরকার মনোযোগ দিচ্ছে অসংখ্য কাজের মধ্যে, যেগুলো তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, যা প্রয়োজন নেই। সরকারের উচিত ছিল সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা জায়গায় ঐকমত্য করানো। সেই কাজের তো কোনো খবর নেই। এতে করে আমাদের দেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কিন্তু সংকট উত্তরণের জন্য জনগণ নিয়ে এসেছে, এখন সরকার যদি সংকটে ফেলে দেয় তাহলে আমরা জাতি হিসাবে দুর্ভাগা। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা
করছেন রাজনীতিবিদরা। এজন্য নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যে ৫০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। ২ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে (ভার্চুয়ালি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত সংস্কার এবং নাগরিকের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি সব সময় জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দাবি জানাবে, এটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নীতি। অথচ আমরা খেয়াল করছি, কিছুদিন ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে এমন একটি
আবহাওয়া তৈরি করছে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করাটাই যেন একটা অপরাধ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য-মন্তব্য কিন্তু পলাতক স্বৈরাচারকেই আনন্দ দেয়। অপরপক্ষে এটি গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য কিন্তু অপমানজনক।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচিত যে প্রতিনিধি থাকে তাদের সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের একটা সংযুক্তি আছে। স্বাভাবিকভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, চিন্তা, দাবি-দাওয়াসহ নানা সমস্যা জবাবদিহিতামূলক সরকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু এখন সরকার ও জনগণের মাঝখানে তো কেউ নেই। সংসদ নেই, সরকার নেই, প্রতিনিধি নেই। কেউ তো নেই, কে নিশ্চিত করবে? নির্বাচন দ্রুত হওয়া দরকার। একটা নির্বাচিত সরকার যত তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় আসবে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক যে সমস্যার
আমরা সম্মুখীন হচ্ছি, সেগুলো নির্বাচিত সরকারের পক্ষে দ্রুত সমাধান দেওয়া সম্ভব। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। কিন্তু সেটা যত দেরি করবে দেশ তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাবে। সম্প্রতি জেলা ও মহানগরের আমির সম্মেলনে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা দুটি সময়কে উপযুক্ত মনে করি। একটি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে। তবে যদি এ সময়ের মধ্যে সংস্কারগুলো এবং বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া জনমনে আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে না আসে, তাহলে সর্বোচ্চ এপ্রিল পার হওয়া উচিত নয়। দেশের আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতার বিষয় আছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ এবং মার্চ মাসের তিন ভাগের দুই ভাগ রোজা থাকবে। সে সময়ে নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারকে আমরা নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ পর্যন্ত সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের নানা অংশের সহযোগিতার পরেও পরিস্থিতি কোনোভাবেই সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটছে, দেশব্যাপী এক ধরনের আধা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। প্রচণ্ড একটি অস্থিরতা চলছে। দেশে কোনো সরকার আছে তা জনজীবনে অনুভব করা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য রোজার সময় কিছু সহনীয় থাকলেও এরপরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। নানা আন্দোলনের কারণে ঢাকা শহর এক ধরনের স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ঘটনা ঘটছে। একটি অনিশ্চিত জায়গায় যাত্রা করেছি। অথচ একটি অনির্বাচিত সরকার তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের বেশি সময় তারা পার করে ফেলেছেন। এই নয় মাসে সরকারের কোনো কোনো ব্যাপারে হয়তো সদিচ্ছা আছে, তা তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্র প্রশাসনে যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও শক্তি থাকা দরকার, তা এ সরকারের নেই। যে কারণে তারা দেশ পরিচালনায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছেন। আগামী দিনগুলোতে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণের পথ হলো জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের ব্যাপারে খুব দ্রুত একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটা। বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংকট এই সরকার নিজে ডেকে এনেছে। কারণ শেখ হাসিনাকে যে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী বলতাম তার কারণ কী? সে (শেখ হাসিনা) যে নীতিতে দেশ চালাচ্ছিল ফ্যাসিবাদ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। এই সরকার এসেও একই নীতিতে শুধু দেশ চালাচ্ছে না, যেটা শেখ হাসিনা করে যেতে পারেনি-যেমন করিডর, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর দেওয়া সেই কাজটাই তারা করছে। সুতরাং সরকার তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে যখন বাড়তি কাজ করতে চাচ্ছে, তখন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সংকট উত্তরণের একটিই পথ অন্তর্বর্তী সরকার তার এখতিয়ার ঠিক রেখে দ্রুত সময়ে নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করবে, তা করে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা করুক। এছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, সরকারের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের দায়িত্বহীনতা এবং সমন্বয়হীনতা দেখতে পাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সরকারের কোনো ক্রাইসিস ম্যানেজার নেই। ক্রাইসিস ম্যানেজার যদি থাকত তাহলে এরকমের দাবি-নামা উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যেত। মনে হচ্ছে সরকারের সব ফোকাস নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করা এবং ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার মধ্যে। এমনকি স্পর্শকাতর চট্টগ্রাম বন্দরও বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। অথচ এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রুটিন কাজের বাইরে যাওয়ার তাদের কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। আর নির্বাচন নিয়ে দু-একটি দলের অনীহা তাও একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের প্রশ্ন হলো এসব দলের ভোটের মাঠে অবস্থান কী? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এই চিন্তাটা তাদের মধ্যে নেই। এই চিন্তা যদি থাকত তাহলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য যে প্রক্রিয়া তাতে এই সময়ে মনোযোগ দিত এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করত। সরকার সংস্কারের পাশাপাশি বিচারের কাজটা অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে অনেক কাজে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। যে কাজগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণার সঙ্গে যায় না। এর কারণেই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের একটি তারিখ ঘোষণা করতে সরকারের সমস্যা কোথায়? একটি তারিখ ঘোষণা করেন, পরবর্তী সময়ে যদি কোনো ধরনের ক্রাইসিস তৈরি হয় বা জাতীয় সমস্যা তৈরি হয় তখন সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারিখ পরিবর্তন করা যাবে। যদি নির্বাচনের একটি তারিখ দিত সরকার, সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকত এবং নানা দাবি নিয়ে কেউ আসত না। সরকারের মূল কথা বলা উচিত আমরা কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার, আমাদের একটা সময় দিন। জবাবহিতিমূলক সরকার তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজগুলো যেন করতে পারি এবং নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। এটি যদি সরকার পরিষ্কারভাবে বলত তাহলে চলমান সমস্যাগুলো থাকত না।