ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
ভারতের একটি ফোনেই রক্ষা পেয়েছিল শেখ হাসিনার প্রাণ! চাঞ্চল্যকর দাবি নতুন বইতে
পপি বীজ কেন নিষিদ্ধ, দেশে কি চাষ হয়, পাকিস্তান থেকে আমদানির কারণ
শেখ হাসিনা সরকারের মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন: কমলাপুরে চালু আন্ডারপাস
বছরের সবচেয়ে বড় সুপারমুন দেখা যাবে আজ
পদত্যাগ করে নির্বাচনের ঘোষণা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের দায়মুক্তির অবসান চায় ১৩ দেশ
আজ সংবিধান দিবসঃ বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি
ফিরছে অ্যাসিড সন্ত্রাসের পুরোনো আতঙ্ক
যৌতুকের দাবিতে স্বামীর পৈশাচিক নির্যাতনে শরীরের দগদগে ঘাঁ তখনও শুকায়নি। শরীরজুড়ে ছিল ব্যথা, ভেতরে ভেতরে জমে থাকা ভয় আর অপমানের ভার। তবুও ফেনীর ফুলগাজীর পূর্ব দরবারপুর গ্রামের বাপের বাড়ি, নিরাপদ আশ্রয় ভেবে নিশ্চিন্ত মনে শুয়েছিলেন খালেদা ইসলাম অমি। কিন্তু নিরাপত্তা শব্দটা তার জীবনের অভিধান থেকে চিরতরে মুছে যায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। ঠিক সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর আগে জানালা দিয়ে ছোঁড়া অ্যাসিডে মুহূর্তেই ঝলসে যায় তার মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ। ‘অমি এখনও চিকিৎসাধীন। আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। বলেন, ‘মুখটা আর মুখ নেই। আমি বেঁচে আছি, কিন্তু বেঁচে থাকা যেন শাস্তি।’
১০ মাসে দগ্ধ সাত নারী, মৃত্যু তিন
এক সময় অ্যাসিড
সন্ত্রাস বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর সামাজিক অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। প্রতিবাদ, আইন ও কঠোর নজরদারির কারণে সেই অভিশাপ অনেকটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই সহিংসতা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন সাত নারী, এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪) দেশে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন ৮৪ জন নারী, মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। অথচ ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ৩৯৯ জন, যেখানে প্রাণ হারান ১২ নারী। বিশ্লেষকদের মতে, এক দশক আগের তুলনায় হার কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে
অ্যাসিড সন্ত্রাস বেড়েছে। বিশেষত পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক ও প্রেমে প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কিশোরীর চিৎকার শুনতে পায়নি কেউ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কুমপুরপুর রানীনগর এলাকার ২০ বছর বয়সী মাহমুদা খাতুনও এমনই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী। ২০২১ সালের ২ অক্টোবর জামাই মুরাদ আলীর ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে যায় তার মুখ, ঘাড় ও হাতের অংশ। তার মা সেফালী বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য নির্যাতন করতো মুরাদ। শেষে মুখে অ্যাসিড ছুড়ে দিল। মামলা করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে ঠিকমতো চালাতে পারিনি। তিন মাসেই জামিন পেয়ে যায় আসামি।’ মাহমুদার চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব)। বিচারহীনতার কালচক্র নব্বইয়ের দশক থেকে
বাংলাদেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা দ্রুত বেড়ে যায়। ১৯৯৯ সালে দেশে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৬৮টি, আর ২০০২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৬-এ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে জায়গা-জমি বিষয়ক দ্বন্দ্বকে ঘিরে এ সন্ত্রাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারী ও শিশুর হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ, আর পুরুষের হার ছিল ২০ শতাংশ। অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করে, যেখানে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। শুধু সরকারই নয়, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও এ অপরাধ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে আসছে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে দেশে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন মোট ৩ হাজার ৮৭০ জন। আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন বলেন, ‘ঘটনা সত্য হলেও অনেক সময় এজাহার দুর্বল হয়, সাক্ষী মেলে না। আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা ধীরে ধীরে হার মানে।’ নারীপক্ষের আইনজীবী কামরুন নাহার বলেন, ‘অ্যাসিড সন্ত্রাস কমে যাওয়ায় প্রশাসন পুরোনো মামলাগুলোর ওপর নজরদারি কমিয়ে দিয়েছে। অথচ জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের প্রতি তিন মাসে একবার বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও, গত কয়েক বছরে একটি সভাও হয়নি।’ এদিকে, জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোর বৈঠকও নিয়মিত হয় না। এর
ফলে মনিটরিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। আইনের শূন্যতা ও অকার্যকরতা অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে প্রণীত হয় ‘অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন’ এবং ‘অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন’। পাশাপাশি, ২০০০ সালে গৃহীত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-ও প্রযোজ্য হয় এসব ক্ষেত্রে। কিন্তু ২৫ বছরেও এ আইনের কোনো বিধিমালা তৈরি হয়নি। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক বলেন, ‘বিধিমালা না থাকায় আইনের প্রয়োগ এলোমেলো। কোথায় কীভাবে তদন্ত হবে, ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে- এসব বিষয় স্পষ্ট নয়। ফলে আইনের ভেতর ফাঁক রয়ে গেছে, যেটা অপরাধীদের সাহস জোগাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত সমস্যার মূল ‘পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ চিহ্নিত করে পরিবর্তন না করা
যায়, ততদিন এ সহিংসতা চলতেই থাকবে। সমাজে নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে, তা বছর বছর ধরে পোষণ করা হচ্ছে।’ বেঁচে থাকার লড়াই অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ভুক্তভোগীদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা, অর্থনৈতিক, মানসিক, আইনি (মামলা পরিচালনা), পুনর্বাসন বা কর্মসংস্থান তৈরি এবং বায়োসাইকোসোশ্যাল সেবা দিত এসএসএফ। সংস্থাটি জানায়, গত পাঁচ বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪) অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১০৪টি। ২০১১ সালে এক বছরেই এ সংখ্যা ছিল একশোরও বেশি। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন অ্যাসিডদগ্ধ রোগী থাকত তাদের। রোগীর সংখ্যা কমার ক্ষেত্রে সরকারের আইন প্রণয়ন, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি অ্যাসিড-সন্ত্রাস নিয়ে গণমাধ্যমের সরব ভূমিকাও ছিল সহায়ক। এএসএফ-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৪৮০টি। এসব হামলায় অ্যাসিড সারভাইভারের সংখ্যা তিন হাজার ৮৮৬ জন। এদের মধ্যে দুই হাজার ৮০০ জনকে সেবার আওতায় আনার সাফল্য রয়েছে এএসএফ-এর। এখনেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ ২০০২ সালে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নাড়া দিয়েছিল সারাদেশকে। এএসএফ-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০১১-এ এক দশকে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। ২০০২ সালে ৪৯৪টি ঘটনার পর ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১টিতে। ২০০২ সালে আইন হওয়ার আগে একেকটি মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগত প্রায় দশ-বারো বছর। আইন হওয়ার পর তা চার মাসে নামিয়ে আনা সম্ভব হলো। কিন্তু যখনই মামলা উচ্চ আদালতে চলে যেত, তখনই আবার মামলার গতি ধীর হয়ে যেত। এদিকে, অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, সরকারি মনিটরিং কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রমও অনেক কমেছে। ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এ অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাশোনা সীমিত। এক সময় প্রতিটি জেলায় পোস্টার, স্কুল ক্যাম্পেইন, থানা পর্যায়ে মনিটরিং হতো। এখন এসব আর হয় না। প্রশাসনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অপরাধীরা মনে করছে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আশার আলোও আছে অ্যাসিড সারভাইভারদের অনেকে এখন সমাজে ফিরেছেন, কাজ করছেন অন্য ভুক্তভোগীদের পাশে। যেমন খুলনার জান্নাতুল ফেরদৌস- যিনি ২০১৮ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন, এখন এএসএফ-এর সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাঁচতে পেরেছি কারণ পাশে মানুষ ছিল। এখন অন্য মেয়েরা যেন ভয় না পায়, সেটাই আমার লক্ষ্য।’ দিন বদলের মেলায় বাংলাদেশের নারীরা আজ প্রতিবাদ করতে শিখেছেন, প্রতিরোধ গড়তে শিখেছেন। কিন্তু তারপরও নির্যাতনের হার কমছে না, বরং রূপ বদলে ফিরে আসছে আগুনে ঝলসানো দুঃসহ বাস্তবতা হয়ে। বিচারহীনতা, সামাজিক উদাসীনতা আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা- এই তিন শক্ত ঘূর্ণিপাকে এখনো দগ্ধ হচ্ছে নারীর মুখ, শরীর, জীবন। এই ঘূর্ণিপাক ভাঙতে হলে আইনের কার্যকর প্রয়োগের পাশাপাশি মানবিক শিক্ষা, সহানুভূতি, আর নারীর প্রতি শ্রদ্ধার নতুন সামাজিক চেতনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
সন্ত্রাস বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর সামাজিক অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। প্রতিবাদ, আইন ও কঠোর নজরদারির কারণে সেই অভিশাপ অনেকটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই সহিংসতা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন সাত নারী, এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪) দেশে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন ৮৪ জন নারী, মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। অথচ ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ৩৯৯ জন, যেখানে প্রাণ হারান ১২ নারী। বিশ্লেষকদের মতে, এক দশক আগের তুলনায় হার কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে
অ্যাসিড সন্ত্রাস বেড়েছে। বিশেষত পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক ও প্রেমে প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কিশোরীর চিৎকার শুনতে পায়নি কেউ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কুমপুরপুর রানীনগর এলাকার ২০ বছর বয়সী মাহমুদা খাতুনও এমনই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী। ২০২১ সালের ২ অক্টোবর জামাই মুরাদ আলীর ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে যায় তার মুখ, ঘাড় ও হাতের অংশ। তার মা সেফালী বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য নির্যাতন করতো মুরাদ। শেষে মুখে অ্যাসিড ছুড়ে দিল। মামলা করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে ঠিকমতো চালাতে পারিনি। তিন মাসেই জামিন পেয়ে যায় আসামি।’ মাহমুদার চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব)। বিচারহীনতার কালচক্র নব্বইয়ের দশক থেকে
বাংলাদেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা দ্রুত বেড়ে যায়। ১৯৯৯ সালে দেশে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৬৮টি, আর ২০০২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৬-এ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে জায়গা-জমি বিষয়ক দ্বন্দ্বকে ঘিরে এ সন্ত্রাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারী ও শিশুর হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ, আর পুরুষের হার ছিল ২০ শতাংশ। অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করে, যেখানে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। শুধু সরকারই নয়, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও এ অপরাধ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে আসছে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে দেশে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন মোট ৩ হাজার ৮৭০ জন। আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন বলেন, ‘ঘটনা সত্য হলেও অনেক সময় এজাহার দুর্বল হয়, সাক্ষী মেলে না। আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা ধীরে ধীরে হার মানে।’ নারীপক্ষের আইনজীবী কামরুন নাহার বলেন, ‘অ্যাসিড সন্ত্রাস কমে যাওয়ায় প্রশাসন পুরোনো মামলাগুলোর ওপর নজরদারি কমিয়ে দিয়েছে। অথচ জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের প্রতি তিন মাসে একবার বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও, গত কয়েক বছরে একটি সভাও হয়নি।’ এদিকে, জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোর বৈঠকও নিয়মিত হয় না। এর
ফলে মনিটরিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। আইনের শূন্যতা ও অকার্যকরতা অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে প্রণীত হয় ‘অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন’ এবং ‘অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন’। পাশাপাশি, ২০০০ সালে গৃহীত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-ও প্রযোজ্য হয় এসব ক্ষেত্রে। কিন্তু ২৫ বছরেও এ আইনের কোনো বিধিমালা তৈরি হয়নি। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক বলেন, ‘বিধিমালা না থাকায় আইনের প্রয়োগ এলোমেলো। কোথায় কীভাবে তদন্ত হবে, ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে- এসব বিষয় স্পষ্ট নয়। ফলে আইনের ভেতর ফাঁক রয়ে গেছে, যেটা অপরাধীদের সাহস জোগাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত সমস্যার মূল ‘পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ চিহ্নিত করে পরিবর্তন না করা
যায়, ততদিন এ সহিংসতা চলতেই থাকবে। সমাজে নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে, তা বছর বছর ধরে পোষণ করা হচ্ছে।’ বেঁচে থাকার লড়াই অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ভুক্তভোগীদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা, অর্থনৈতিক, মানসিক, আইনি (মামলা পরিচালনা), পুনর্বাসন বা কর্মসংস্থান তৈরি এবং বায়োসাইকোসোশ্যাল সেবা দিত এসএসএফ। সংস্থাটি জানায়, গত পাঁচ বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪) অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১০৪টি। ২০১১ সালে এক বছরেই এ সংখ্যা ছিল একশোরও বেশি। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন অ্যাসিডদগ্ধ রোগী থাকত তাদের। রোগীর সংখ্যা কমার ক্ষেত্রে সরকারের আইন প্রণয়ন, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি অ্যাসিড-সন্ত্রাস নিয়ে গণমাধ্যমের সরব ভূমিকাও ছিল সহায়ক। এএসএফ-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৪৮০টি। এসব হামলায় অ্যাসিড সারভাইভারের সংখ্যা তিন হাজার ৮৮৬ জন। এদের মধ্যে দুই হাজার ৮০০ জনকে সেবার আওতায় আনার সাফল্য রয়েছে এএসএফ-এর। এখনেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ ২০০২ সালে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নাড়া দিয়েছিল সারাদেশকে। এএসএফ-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০১১-এ এক দশকে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। ২০০২ সালে ৪৯৪টি ঘটনার পর ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১টিতে। ২০০২ সালে আইন হওয়ার আগে একেকটি মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগত প্রায় দশ-বারো বছর। আইন হওয়ার পর তা চার মাসে নামিয়ে আনা সম্ভব হলো। কিন্তু যখনই মামলা উচ্চ আদালতে চলে যেত, তখনই আবার মামলার গতি ধীর হয়ে যেত। এদিকে, অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, সরকারি মনিটরিং কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রমও অনেক কমেছে। ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এ অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাশোনা সীমিত। এক সময় প্রতিটি জেলায় পোস্টার, স্কুল ক্যাম্পেইন, থানা পর্যায়ে মনিটরিং হতো। এখন এসব আর হয় না। প্রশাসনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অপরাধীরা মনে করছে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আশার আলোও আছে অ্যাসিড সারভাইভারদের অনেকে এখন সমাজে ফিরেছেন, কাজ করছেন অন্য ভুক্তভোগীদের পাশে। যেমন খুলনার জান্নাতুল ফেরদৌস- যিনি ২০১৮ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন, এখন এএসএফ-এর সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাঁচতে পেরেছি কারণ পাশে মানুষ ছিল। এখন অন্য মেয়েরা যেন ভয় না পায়, সেটাই আমার লক্ষ্য।’ দিন বদলের মেলায় বাংলাদেশের নারীরা আজ প্রতিবাদ করতে শিখেছেন, প্রতিরোধ গড়তে শিখেছেন। কিন্তু তারপরও নির্যাতনের হার কমছে না, বরং রূপ বদলে ফিরে আসছে আগুনে ঝলসানো দুঃসহ বাস্তবতা হয়ে। বিচারহীনতা, সামাজিক উদাসীনতা আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা- এই তিন শক্ত ঘূর্ণিপাকে এখনো দগ্ধ হচ্ছে নারীর মুখ, শরীর, জীবন। এই ঘূর্ণিপাক ভাঙতে হলে আইনের কার্যকর প্রয়োগের পাশাপাশি মানবিক শিক্ষা, সহানুভূতি, আর নারীর প্রতি শ্রদ্ধার নতুন সামাজিক চেতনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।



