বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি লেভেলে নিশ্চিত করা হবে কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন, আইনের ঊর্ধ্বে নন। বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার গোড়াপত্তন যেন না ঘটে, সেটি নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায় যাতে কেউ পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। আমরা আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুণীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চাই। রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বৃহস্পতিবার বিকালে বিএনপি

আয়োজিত ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীষর্ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভার্চুয়ালি তিনি এসব কথা বলেন। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানের হাইকমিশনার এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ ৩৮ দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি। শুরুতে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের পটভূমি তুলে ধরেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ। তারেক রহমান বলেন, দেড় হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে গণঅভ্যুত্থানে হত্যা করার পরও আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কোনো অনুতাপ, অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনার নজির নেই। তিনি বলেন,

এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। আওয়ামী লীগের মতো পরিবারতন্ত্র ও অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি হবে না। বিভাজন ও বৈষম্য থাকবে না। সমাজের প্রতিটি স্তরে দলীয়করণ ও প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় ঘটবে না। সংস্কার প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, বর্তমানে দেশে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই বিএনপির ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পরিবেশ, পরিস্থিতি, দেশের প্রয়োজন এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ৩১ দফাতে সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্বিন্যাস বা পরিবর্তনও করা যেতে পারে। তবে তা হবে অংশীজনের পরামর্শ ও জনমত ঐক্যের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে তারেক রহমান বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা আছে; সেটিই স্বাভাবিক। তবে বিশ্বাস

করি, ভিন্ন-ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মাঝেও বৃহত্তর পরিসরে আমাদের সবার মাঝে একটি বিষয়ে আদর্শিক ঐকমত্য রয়েছে। আর সেই বিষয়টি হলো একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। গত ১৬ বছর ধরে এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন-গণতন্ত্রের পক্ষের প্রতিটি ব্যক্তি, দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী সবার আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে; প্রতিটি শ্রেণি-পেশা-মতের মানুষের অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের সমন্বিত অগ্রাধিকার। তারেক রহমান বলেন, সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝি, যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য নয়, বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ একজন মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হবে, তার ও পরিবারের আর্থ-সামাজিক

নিরাপত্তা ও সঞ্চয় নিশ্চিত হবে। সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী ও পুরুষের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করবে। নারীদের সম্মান, স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে। সব মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। দেশের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন করবে। মানুষকে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দেবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখবে। আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কৃষক, শ্রমিক এবং সব কর্মজীবী মানুষের ন্যায্য ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য তরুণ ও বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান, আর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী বেকার ভাতা প্রবর্তন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ, তৃণমূলের ক্ষমতায়ন এবং আবারও ঐতিহাসিক

খাল কাটা কর্মসূচির বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে আনতে চাই যুগোপযোগী আমূল পরিবর্তন। যেন তৈরি হয় দক্ষ মানবসম্পদ; বৃদ্ধি পায় রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স; স্থাপিত হয় মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কৃষক ও উৎপাদনকারীদের জন্য ন্যায্য মূল্য, চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও বহুভাষার প্রশিক্ষণ, বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সবার জন্য পর্যায়ক্রমিক আবাসন সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষা এ পরিকল্পনাগুলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী-সমতল-পাহাড়ি নির্বিশেষে সুষম ও সমঅধিকারের আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে একটি ঐকমত্যের ভিশন বলেই আমি মনে করি। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে চান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, গত ১৬ বছরে আমার নিজের,

আমার দলের এবং গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি তথা অনেকের ফ্রিডম অব স্পিচ, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন এবং ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়েছে। সেই উপলব্ধিকে ধারণ করে আমরা সব নাগরিক, বিশেষত মানবাধিকারকর্মী, সংবাদকর্মী ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করব। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও বিচার, পরোয়ানা ছাড়াই গণগ্রেপ্তার এবং চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে ভয়ের সংস্কৃতি ১৬ বছরে গড়ে উঠেছিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিএনপি সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে সেটি নির্মূল করা। জাতিসংঘ প্রণীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুসারে আমরা নিশ্চিতের চেষ্টা করব প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা। ফ্যাসিবাদের পতনের পর গত ৩ মাসে বিএনপির অনেক উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুন, হামলা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও দলীয়ভাবে তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো ইতিহাস নেই। বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রয়েছে। তারপরেও এত বিশাল সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো অপরাধে জড়িত হলে, তা জানামাত্রই আমরা দ্রুত সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় নেতা শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিন। বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর রফিকুল ইসলাম খান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও অ্যাডভোকেটে এলিনা খান। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকতউল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, আমানউল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আফরোজা খান রীতা, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীম প্রমুখ। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন-বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতের হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নুরুল আমিন বেপারি, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান, রাশেদ প্রধান, এনডিপির আবু তাহের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের হারুন চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের আশরাফ আলী আকন্দ প্রমুখ। আরও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক নুরুল আমিন, অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম প্রমুখ।