ওই পাখিরা কি আবার নীড়ে ফিরবে? – U.S. Bangla News




ওই পাখিরা কি আবার নীড়ে ফিরবে?

ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স:-
আপডেটঃ ৬ এপ্রিল, ২০২৪ | ৮:০৬
ষাট ও সত্তরের দশকের সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্বিনীত, অধিকার আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, পরাধীনতার শিকল ভাঙার ভ্যানগার্ড ছাত্র রাজনীতি কালের পরিক্রমায় আজ ছাত্রসমাজের কাছেই ঘৃণিত, পরিত্যাজ্য। বুয়েটের চলমান আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির এ বাস্তবতা আরেকবার আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন ছাত্র রাজনীতি তার অতীতের গৌরব হারিয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এ লেখা। কিছু লিখতে গেলে সাধারণত মাথায় একটা প্লট, একটা ভাবনা কাজ করে। তারপর শব্দ সাজিয়ে সেই ভাবনা একটা লেখায় পরিণত হয়। কিন্তু আজকের এ লেখাটা নিজের কাছেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা। যেন একটা একটা শব্দ জোড়া দিতে দিতে উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায়। বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন,

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, এমনকি সত্তরের নির্বাচনে ছাত্ররা তথা ছাত্র রাজনীতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাহান্ন থেকে সত্তর পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির এ সংগ্রামের যৌক্তিক পরিণতিতেই একাত্তরে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চালিকাশক্তিও ছিল ছাত্র রাজনীতি। এ রাজনীতি কেবল শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, পুরো জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই করেছে। এরশাদের পদত্যাগের পর ছাত্র রাজনীতি যে দুর্বৃত্তায়নের পথে পরিচালিত হয়েছে; তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে। এর জন্য দায়ী ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর দখলদারত্বের মানসিকতা। বুয়েটে সাবিকুন্নাহার সনি, আরিফ রায়হান দ্বীপ, আবরার ফাহাদদের এ পথভ্রষ্ট ছাত্র রাজনীতির বলি হতে হয়েছে। এরশাদের পর যারাই যখন ক্ষমতায়

এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের গত ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্র রাজনীতি এতটাই বীভৎসতা দেখিয়েছে যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতিকেই গ্রহণ করতে পারছে না। ছাত্রলীগ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনভাবে দখল করেছে যে, বুয়েটসহ দেশের সব শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্র রাজনীতির অর্থই দাঁড়িয়েছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বুয়েটের আলোচনায় ফেরা যাক। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বুয়েটের আবাসিক হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে বুয়েটে ছাত্রলীগের দখলদারত্বের অবসান ঘটে। সাড়ে চার বছর পর আবারও বুয়েটের দখল নিতে গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের সভাপতি দলবল নিয়ে বুয়েটে মহড়া দেয়। এরপরের ঘটনা প্রবাহ

আমরা প্রত্যেকেই জানি। স্বাভাবিকভাবেই সরকার এবং সরকারি দল ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেয়। এমনকি সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক তো আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অ্যাকশনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর আদালতের রায়ের ভিত্তিতে অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতগতিতে মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে একটি রিটের রায়ে ছাত্রলীগ আবারও বুয়েটে আধিপত্য বিস্তারের আইনি বৈধতা পায়। পরদিনই ছাত্রলীগ বুয়েটে কমিটি ঘোষণা করে। এতে স্পষ্ট হয়, দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটের দখল নিতে সবকিছু পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এখনো আদালতের রায় মানেনি। তারা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা অসহায় হয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখে নিজেদের দাবি জানিয়েছে। যারা

এ চিঠি লিখেছে তারাও কি বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী এসব ঘটনা প্রবাহ জানেন না কিংবা তার অনুমোদন ছাড়াই ছাত্রলীগ, সরকার, সরকারি দল বুয়েটের দখল নিতে মরিয়া হয়েছে? এর উত্তর আমরা সবাই জানি। আজকে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের যে ঘৃণা, তা যেমন প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের রাজনীতির প্রতি, তেমনি বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির যত অর্জন তাও এসেছে এ ছাত্রলীগের হাতেই। কিন্তু ভাববার বিষয়, যে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল রূপকার, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ছাত্রলীগ ছিল রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সমালোচিত। বলে রাখা ভালো, স্বাধীন দেশে এ ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে পারেনি। রাজনীতিতে টিকে থাকতে ছাত্রলীগের একটি অংশকে আলাদা দল করতে হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের

আন্দোলনে দেশের ক্রিয়াশীল সব ছাত্রসংগঠনই ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এ সংগঠনগুলোই ক্ষমতার চর্চা করতে গিয়ে দানবে পরিণত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির অর্থই দাঁড়িয়েছে বাণিজ্য, দখলদারত্ব, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস। ষাটের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বিশেষ করে ষাট এবং সত্তরের দশকে ছাত্রদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এক ধরনের বিপ্লবী রোমান্টিসিজমে আচ্ছন্ন ছাত্ররা শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দলে দলে রাজনীতিতে যুক্ত হয়। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা তখন তাদের আদর্শ। মার্ক্স তখন তাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষক। তাদের সামনে নক্সালবাড়ির হাতছানি। সোভিয়েত বিপ্লব তখন তাদের প্রেরণা, সাহসের উৎস। পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় বাংলায় সব মেধাবী ছাত্ররা তখন রাজনীতিতে দীক্ষিত হচ্ছে। সেসময় ছাত্রদের মধ্যে

আত্মকেন্দ্রিকতার বিকাশ ঘটেনি। বিপ্লবের আগুনে আত্মাহুতি দিতে তারা এক মুহূর্তও ভাবতে রাজি ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সেই চেতনায় ব্যাপকভাবে ধাক্কা দেয়। এরপর থেকে আমরা রাজনীতিতে এমন কোনো বয়ান তৈরি করতে পারিনি, মার্ক্সের মতো এমন কোনো মন্ত্র তৈরি করতে পারিনি, যাতে বিমোহিত হয়ে ছাত্ররা রাজনীতির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়। পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেমন ছাত্রদের সামনে কোনো আদর্শিক অবস্থান দাঁড় করাতে পারেনি, তেমনি সমাজতন্ত্রের অনিবার্য পরিণতি হিসাবে পৃথিবীব্যাপী একদলীয় থেকে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাত্রদের কেবল সমাজতান্ত্রিক চেতনায় আঘাত করেনি, সামগ্রিকভাবে রাজনীতিবিমুখ করেছে। নব্বইয়ের পর থেকে দিনে দিনে ছাত্র রাজনীতি আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে।

আর ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনকে আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে না তুলে ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করতে শুরু করে। এর পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে, এমন একটি বয়ান তৈরির চেষ্টা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। সাম্প্রতিক সময়ে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা এড়িয়ে গেছে। বুয়েটের চলমান আন্দোলনে ছাত্রদলের সংহতি প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষার্থীরা। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র আন্দোলনগুলো কখনো রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রাষ্ট্রক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়টি তারা এড়িয়ে গেছে সচেতনভাবে। এ আন্দোলনগুলো হয়েছে মূলত নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক ইস্যুতে। এক্ষেত্রে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছে নিজেদের

সহপাঠী হারানোর ক্ষোভ থেকে। এ আন্দোলনগুলোকে আপাত সফল মনে হলেও রাজনৈতিক নির্দেশনা না থাকায় পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্রশক্তির নিপীড়ন এবং ভয়ের সংস্কৃতি এর একটি কারণ। কেননা রাষ্ট্রশক্তি এবং ক্ষমতাসীনরা ইতঃপূর্বে কখনোই বর্তমান সময়ের মতো এত নিপীড়ন চালায়নি। রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য ছাত্র রাজনীতির কোনো বিকল্প হতে পারে না। তবে অবশ্যই তা এ দুর্বৃত্তায়িত, বেপথু ছাত্র রাজনীতি নয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারত্বমুক্ত এমন পরিশীলিত, কল্যাণমুখী ছাত্র রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করে এবং তাদেরকে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ছাত্র রাজনীতির এমন একটি ধারা যা জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে, যে রাজনীতি থেকে দেশের কল্যাণকামী ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু নব্বইয়ের পর থেকে আমরা সেই কল্যাণধর্মী রাজনীতির চর্চা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে মিলিয়ে জনগণের কল্যাণকে মূল লক্ষ্য হিসাবে সামনে রেখে কল্যাণ রাষ্ট্রের যে ধারণা তৈরি করেছে নর্ডিক অঞ্চল, আমরা সেটা গ্রহণ করতে পারিনি। আমরা একদিকে সমাজতন্ত্রকে অস্বীকার করেছি, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছি। আর এর মধ্য দিয়েই উড়ে পালিয়েছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত, দুর্বিনীত বিপ্লবী চেতনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উড়ে যাওয়া পাখিগুলো আর এদিকে ফিরে আসেনি। ওরা উড়ে গেছে ওই শীতের দেশে কিংবা অরোরা বোরিয়ালিস দেখতে। সাকিব আনোয়ার : অ্যাক্টিভিস্ট, প্রাবন্ধিক mnsaqeeb@gmail.com
ট্যাগ:

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
জীবন ওলটপালট করে গেল ‘আগ্রাসী’ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটিতে আলোচনা হয়নি: ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়াকে ফের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে কেন বাঙালি হত্যা, জবাব দিতে হবে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন প্রধানমন্ত্রী গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য অন্তহীন অপেক্ষা জোর করে নারীর হিজাব খুলল অ্যারিজোনা পুলিশ ঝুঁকির মধ্যেই ৩৭ জেলায় খোলা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবৃদ্ধির দৌড়ে চীন মালয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ নীতিমালা লঙ্ঘনে হজ চিকিৎসক দলের নার্সদের ৬ মাসের স্থগিতাদেশ রাজধানীর নিকুঞ্জে আবাসিক ভবনে বিস্ফোরণ মহান মে দিবস আজ ৭৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম, সারা দেশে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হয়েছে: নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর দেশের উন্নয়নে ইইউর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ: পরাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৮২৮ জন, প্রত্যাহার ১৭৭ প্রার্থীর ডিসেম্বরের আগেই কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে চায় বিএনপি ডিজেল পেট্রল অকটেনের দাম বাড়ল