ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স
আরও খবর
‘আমরা এখনো শ্রদ্ধার স্বর্ণ শিখরে রেখেছি শিক্ষকদের’
পলিথিন ব্যবহার ও জনসচেতনতা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ শুল্ক হ্রাসসহ ৫ সিদ্ধান্ত বাণিজ্য উপদেষ্টার
বায়ুদূষণ রোধ: জনস্বার্থে করা মামলার রায় কার্যকর হচ্ছে না
বর্বরতার ‘উৎসবে’ ঝরছে তাজা প্রাণ
ডেঙ্গুতে দুই সপ্তাহে ২৩ জনের মৃত্যু
জাতীয় ব্যবসা সংলাপ উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ আমলে লউন
বেহাত অস্ত্র কিশোর গ্যাংয়ের হাতে
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বেহাত হওয়া অস্ত্র এখন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে যে কোনো সময় বড় ধরনের নাশকতা, ডাকাতি, খুন ও অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। রাজধানীর থানাগুলো থেকে বেহাত হওয়া এক হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই হাতবদল হয়ে পেশাদার বা দাগি অপরাধীদের কাছে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেহাত হওয়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী একযোগে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।
পরবর্তী ২০ দিনে মাত্র ২১৬টি আগ্নেয়ান্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯২ জনকে। অথচ বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র হারিয়েছে ৫ হাজার ৮১৮টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৩৩টি অস্ত্র ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার ও স্বেচ্ছায় থানায় জমা দেওয়া হয়। ৪ সেপ্টেম্বরের পর রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, লালবাগ, মোহাম্মদপুর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বেহাত অস্ত্রের বেশিরভাগই এখনো উদ্ধারের বাইরেই থেকে গেছে। বেহাত হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার এক ডিআইজি বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লুণ্ঠিত অস্ত্রের বড় অংশ এখন কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। এসব অস্ত্র রাখা বা হাতবদল করে বিক্রির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত যারা পুলিশ,
র্যাব কিংবা যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র নিজেদের কাছে রেখেছে। ভবিষ্যতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ডাকাতি, খুনসহ বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।’ কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকা অস্ত্র উদ্ধারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে এলিট ফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের ইন্টেলিজেন্স উইংসহ বিভিন্ন ইউনিট লুণ্ঠিত অস্ত্র শনাক্ত ও উদ্ধারে কাজ করছে। আমরা যখন যেখান থেকে গোয়েন্দা তথ্য বা অন্য কোনো গোপন সংবাদে তথ্য পাই, সেখানে অভিযান পরিচালনা করি।’ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে থানার লুণ্ঠিত অস্ত্রসহ যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে,
তাদের বেশিরভাগই কিশোর বয়সী। এরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য কি না বা থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র তাদের হাতে মজুত কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে বিশ্লেষণের বিষয়। আমরা এখনো বিষয়টি বিশ্লেষণ করিনি। এটুকু বলতে পারি, কিশোর হোক বা যারাই হোক; তারা এসব অস্ত্র নিশ্চয়ই ভালো উদ্দেশ্যে নিজেদের কাছে রাখেনি।’ শুধু থানা বা ফাঁড়ি নয়, গত ৫ আগস্ট গণভবন থেকে নিরাপত্তা সংস্থা এসএসএফের ৩২টি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বেহাত হয়, যার মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল। এখন পর্যন্ত সেসব অস্ত্র উদ্ধারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সরেজমিন দেখা
যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে নজিরবিহীন ও ভয়াবহ হামলা হয়। ওই সময় পুলিশের অস্ত্র, পোশাক, থানার বিভিন্ন সরঞ্জাম গণহারে লুট হয়। ঘটনার দিন রাজধানীর ভাটারা, মোহাম্মদপুর, পল্টন, আদাবর ও মিরপুর থানায় দেখা যায়, যারা হামলা ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল তাদের সিংহভাগের বয়স ১২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। মিরপুর থানায় বিহারি ক্যাম্পের কিছু কিশোরকেও থানায় লুট করতে দেখা যায়। গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজধানীর ইসিবি, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা এলাকায় রাতে ডাকাতির চেষ্টার ভয়ানক খবর পাওয়া যায়। ইসিবি চত্বর এলাকায় থানা
থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র হাতে ডাকাতির চেষ্টাকালে কয়েকজনকে সেনা সদস্যরা আটকও করে। তারা বিহারি ক্যাম্প ও কালসী এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলেও জানা গেছে। রাজধানীর বাড্ডা থানা থেকে লুট হওয়া একটি অস্ত্র বিক্রির চেষ্টাকালে গত ৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় গ্রেপ্তার হয় তুহিন আলম (১৯) নামে এক কিশোর। তার কাছ থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। র্যাব-১১-এর সিপিসি-২, কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক লে. কমান্ডার মাহমুদুল হাসান জানান, গ্রেপ্তার হওয়া তুহিন রাজধানীর উত্তর বাড্ডা স্বাধীনতা সরণির সড়ক এলাকায় একটি হোটেলে কাজ করত। ৫ আগস্ট তুহিনসহ দুষ্কৃতকারীরা ঢাকার বাড্ডা থানায় আক্রমণ করে থানার ভেতর থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লুট ও
ধ্বংস করে। ওই সময় তুহিন আলম উদ্ধার করা পিস্তল, ম্যাগাজিন ও কার্তুজ লুট করে নিজ হেফাজতে রাখে। এক পর্যায়ে পুলিশের পিস্তল বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় নিয়ে যায় সে। র্যাবের দাবি তুহিন বাড্ডা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। অন্য ঘটনায় গত ১৭ আগস্ট ঢাকার একটি থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তল বিক্রির চেষ্টাকালে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে মনির আহাম্মদ (২০) নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে জানিয়েছে, তার আত্মীয় কাইয়ুম থানা থেকে অস্ত্র লুট করে। পুলিশের স্বীকারোক্তিতে মনির জানিয়েছে, তার আত্মীয় কাইয়ুম মিরপুরে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। সে তাকে অস্ত্রটি বিক্রির উদ্দেশ্যে দিয়েছে। অন্যদিকে গত ৩১ আগস্ট সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র, গুলিসহ মেহেদী হাসান (২০) ও ফরহাদ হোসেন (২৫) নামে দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে লুট করা অস্ত্রগুলো মাটিতে পুঁতে রাখে। তাদের কাছ থেকে দুটি ওয়ান শুটারগান, একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও ২৩টি গুলি উদ্ধার করা হয়। গত ১৫ আগস্ট ফেনী সদর থানা থেকে লুট করা একটি নাইন এমএম পিস্তল, ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন বিক্রির চেষ্টা করলে মো. রুবেল (২৫) নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ- পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ হাজার ৮১৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বেহাত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৩টি। উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র। উদ্ধার না হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ২৯৬টি চায়না রাইফেল, ৮টি বিডি রাইফেল, চায়না এসএমজি ৬০টি, এলএমজি ১১টি, চায়না পিস্তল ৫৪টি, ৯ বোরের পিস্তল ৬৫৩টি, এসএমজি একটি, ১২ বোরের শটগান ৬৫৩টি, সিঙ্গেল গ্যাস গান ১১৭টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ৫টি ও সিগন্যাল পিস্তল ২টি। উদ্ধার না হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বোরের গুলি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪০৫টি, টিয়ার গ্যাসের শেল ৮ হাজার ৮১১টি, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ৭৫১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ২ হাজার ৫৬৪টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ৭৭টি, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৩৭টি, ফ্লাশ ব্যাংক গ্রেনেড ৩৬০টি, হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে ৮৩টি। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর উদ্ধার ২১৬টি অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রিভলবার ১১টি, পিস্তল ৬২টি, রাইফেল ১৩টি, শটগান ২৮টি, পাইপগান ৬টি, শুটারগান ২৩টি, এলজি ২০টি, বন্দুক ৩১টি, একে-৪৭ একটি, গ্যাস গান ২টি, চায়নিজ রাইফেল ১টি, এয়ারগান ৪টি, এসবিবিএল ৫টি, এসএমজি ৫টি, টিয়ারগ্যাস লঞ্চার ২টি, থ্রি-কোয়ার্টার ২টি। এসব রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯২ জনকে। বেহাত অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে প্রায় অর্ধেক পাওয়া গেছে। যেসব অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না সেগুলো উদ্ধারের জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা টিম কাজ করছে। তাদের দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। যৌথ অভিযানের পাশাপাশি পুলিশ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমেও অস্ত্র লুটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রেপ্তার এবং অস্ত্র উদ্ধারে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর বা যাদের কাছেই থাকুক না কেন, লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে অপরাধীরা নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করতে পারে। লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর একটা অংশ অনুপস্থিত বা পলাতক পুলিশ সদস্যদের কারও কাছেও থাকতে পারে। এগুলোও দেখা হচ্ছে। তবে থানায় যারা হামলা করেছে, তাদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, বিভিন্ন ধরনের অপরাধী, দুর্বৃত্তও যুক্ত ছিল। মনে করা হচ্ছে, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো দাগি অপরাধীদের কাছেই থাকতে পারে বা হাতবদল হয়ে দাগি অপরাধীদের কাছে চলে যেতে পারে।’ খোয়া যাওয়া অস্ত্র কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকাটা বড় হুমকির কারণ উল্লেখ করে অপরাধ বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘থানা ও ফাঁড়িতে যারা লুট করেছে, তারা কিশোর বা কমবয়সী ছিল এটা ঠিক। লুণ্ঠিত অস্ত্রের বড় একটি অংশের মজুত কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশে ১২-১৩ বছর বয়সী বা ১৮ বছরের কম বয়সীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুন-ডাকাতির মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করতে আমরা দেখেছি। আমার বক্তব্য হলো, কিশোর গ্যাংয়ের কাছে থাকুক বা যার কাছেই থাকুক লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের বন্দোবস্ত করতেই হবে। কারণ এসব অস্ত্র তারা ভালো উদ্দেশ্যে নিজেদের কাছে রাখেনি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না করা গেলে আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে।’
পরবর্তী ২০ দিনে মাত্র ২১৬টি আগ্নেয়ান্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯২ জনকে। অথচ বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র হারিয়েছে ৫ হাজার ৮১৮টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৩৩টি অস্ত্র ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার ও স্বেচ্ছায় থানায় জমা দেওয়া হয়। ৪ সেপ্টেম্বরের পর রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, লালবাগ, মোহাম্মদপুর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বেহাত অস্ত্রের বেশিরভাগই এখনো উদ্ধারের বাইরেই থেকে গেছে। বেহাত হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার এক ডিআইজি বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লুণ্ঠিত অস্ত্রের বড় অংশ এখন কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। এসব অস্ত্র রাখা বা হাতবদল করে বিক্রির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত যারা পুলিশ,
র্যাব কিংবা যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র নিজেদের কাছে রেখেছে। ভবিষ্যতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ডাকাতি, খুনসহ বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।’ কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকা অস্ত্র উদ্ধারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে এলিট ফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের ইন্টেলিজেন্স উইংসহ বিভিন্ন ইউনিট লুণ্ঠিত অস্ত্র শনাক্ত ও উদ্ধারে কাজ করছে। আমরা যখন যেখান থেকে গোয়েন্দা তথ্য বা অন্য কোনো গোপন সংবাদে তথ্য পাই, সেখানে অভিযান পরিচালনা করি।’ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে থানার লুণ্ঠিত অস্ত্রসহ যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে,
তাদের বেশিরভাগই কিশোর বয়সী। এরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য কি না বা থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র তাদের হাতে মজুত কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে বিশ্লেষণের বিষয়। আমরা এখনো বিষয়টি বিশ্লেষণ করিনি। এটুকু বলতে পারি, কিশোর হোক বা যারাই হোক; তারা এসব অস্ত্র নিশ্চয়ই ভালো উদ্দেশ্যে নিজেদের কাছে রাখেনি।’ শুধু থানা বা ফাঁড়ি নয়, গত ৫ আগস্ট গণভবন থেকে নিরাপত্তা সংস্থা এসএসএফের ৩২টি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বেহাত হয়, যার মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল। এখন পর্যন্ত সেসব অস্ত্র উদ্ধারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সরেজমিন দেখা
যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে নজিরবিহীন ও ভয়াবহ হামলা হয়। ওই সময় পুলিশের অস্ত্র, পোশাক, থানার বিভিন্ন সরঞ্জাম গণহারে লুট হয়। ঘটনার দিন রাজধানীর ভাটারা, মোহাম্মদপুর, পল্টন, আদাবর ও মিরপুর থানায় দেখা যায়, যারা হামলা ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল তাদের সিংহভাগের বয়স ১২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। মিরপুর থানায় বিহারি ক্যাম্পের কিছু কিশোরকেও থানায় লুট করতে দেখা যায়। গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজধানীর ইসিবি, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা এলাকায় রাতে ডাকাতির চেষ্টার ভয়ানক খবর পাওয়া যায়। ইসিবি চত্বর এলাকায় থানা
থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র হাতে ডাকাতির চেষ্টাকালে কয়েকজনকে সেনা সদস্যরা আটকও করে। তারা বিহারি ক্যাম্প ও কালসী এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলেও জানা গেছে। রাজধানীর বাড্ডা থানা থেকে লুট হওয়া একটি অস্ত্র বিক্রির চেষ্টাকালে গত ৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় গ্রেপ্তার হয় তুহিন আলম (১৯) নামে এক কিশোর। তার কাছ থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। র্যাব-১১-এর সিপিসি-২, কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক লে. কমান্ডার মাহমুদুল হাসান জানান, গ্রেপ্তার হওয়া তুহিন রাজধানীর উত্তর বাড্ডা স্বাধীনতা সরণির সড়ক এলাকায় একটি হোটেলে কাজ করত। ৫ আগস্ট তুহিনসহ দুষ্কৃতকারীরা ঢাকার বাড্ডা থানায় আক্রমণ করে থানার ভেতর থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লুট ও
ধ্বংস করে। ওই সময় তুহিন আলম উদ্ধার করা পিস্তল, ম্যাগাজিন ও কার্তুজ লুট করে নিজ হেফাজতে রাখে। এক পর্যায়ে পুলিশের পিস্তল বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় নিয়ে যায় সে। র্যাবের দাবি তুহিন বাড্ডা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। অন্য ঘটনায় গত ১৭ আগস্ট ঢাকার একটি থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তল বিক্রির চেষ্টাকালে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে মনির আহাম্মদ (২০) নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে জানিয়েছে, তার আত্মীয় কাইয়ুম থানা থেকে অস্ত্র লুট করে। পুলিশের স্বীকারোক্তিতে মনির জানিয়েছে, তার আত্মীয় কাইয়ুম মিরপুরে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। সে তাকে অস্ত্রটি বিক্রির উদ্দেশ্যে দিয়েছে। অন্যদিকে গত ৩১ আগস্ট সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র, গুলিসহ মেহেদী হাসান (২০) ও ফরহাদ হোসেন (২৫) নামে দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে লুট করা অস্ত্রগুলো মাটিতে পুঁতে রাখে। তাদের কাছ থেকে দুটি ওয়ান শুটারগান, একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও ২৩টি গুলি উদ্ধার করা হয়। গত ১৫ আগস্ট ফেনী সদর থানা থেকে লুট করা একটি নাইন এমএম পিস্তল, ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন বিক্রির চেষ্টা করলে মো. রুবেল (২৫) নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ- পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ হাজার ৮১৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বেহাত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৩টি। উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র। উদ্ধার না হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ২৯৬টি চায়না রাইফেল, ৮টি বিডি রাইফেল, চায়না এসএমজি ৬০টি, এলএমজি ১১টি, চায়না পিস্তল ৫৪টি, ৯ বোরের পিস্তল ৬৫৩টি, এসএমজি একটি, ১২ বোরের শটগান ৬৫৩টি, সিঙ্গেল গ্যাস গান ১১৭টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ৫টি ও সিগন্যাল পিস্তল ২টি। উদ্ধার না হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বোরের গুলি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪০৫টি, টিয়ার গ্যাসের শেল ৮ হাজার ৮১১টি, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ৭৫১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ২ হাজার ৫৬৪টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ৭৭টি, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৩৭টি, ফ্লাশ ব্যাংক গ্রেনেড ৩৬০টি, হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে ৮৩টি। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর উদ্ধার ২১৬টি অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রিভলবার ১১টি, পিস্তল ৬২টি, রাইফেল ১৩টি, শটগান ২৮টি, পাইপগান ৬টি, শুটারগান ২৩টি, এলজি ২০টি, বন্দুক ৩১টি, একে-৪৭ একটি, গ্যাস গান ২টি, চায়নিজ রাইফেল ১টি, এয়ারগান ৪টি, এসবিবিএল ৫টি, এসএমজি ৫টি, টিয়ারগ্যাস লঞ্চার ২টি, থ্রি-কোয়ার্টার ২টি। এসব রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯২ জনকে। বেহাত অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে প্রায় অর্ধেক পাওয়া গেছে। যেসব অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না সেগুলো উদ্ধারের জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা টিম কাজ করছে। তাদের দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। যৌথ অভিযানের পাশাপাশি পুলিশ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমেও অস্ত্র লুটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রেপ্তার এবং অস্ত্র উদ্ধারে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর বা যাদের কাছেই থাকুক না কেন, লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে অপরাধীরা নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করতে পারে। লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর একটা অংশ অনুপস্থিত বা পলাতক পুলিশ সদস্যদের কারও কাছেও থাকতে পারে। এগুলোও দেখা হচ্ছে। তবে থানায় যারা হামলা করেছে, তাদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, বিভিন্ন ধরনের অপরাধী, দুর্বৃত্তও যুক্ত ছিল। মনে করা হচ্ছে, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো দাগি অপরাধীদের কাছেই থাকতে পারে বা হাতবদল হয়ে দাগি অপরাধীদের কাছে চলে যেতে পারে।’ খোয়া যাওয়া অস্ত্র কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকাটা বড় হুমকির কারণ উল্লেখ করে অপরাধ বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘থানা ও ফাঁড়িতে যারা লুট করেছে, তারা কিশোর বা কমবয়সী ছিল এটা ঠিক। লুণ্ঠিত অস্ত্রের বড় একটি অংশের মজুত কিশোর গ্যাংয়ের হাতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশে ১২-১৩ বছর বয়সী বা ১৮ বছরের কম বয়সীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুন-ডাকাতির মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করতে আমরা দেখেছি। আমার বক্তব্য হলো, কিশোর গ্যাংয়ের কাছে থাকুক বা যার কাছেই থাকুক লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের বন্দোবস্ত করতেই হবে। কারণ এসব অস্ত্র তারা ভালো উদ্দেশ্যে নিজেদের কাছে রাখেনি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না করা গেলে আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে।’