রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তোলপাড়

২৬ মে, ২০২৩ | ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করার পর ঢাকায় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক তোলপাড় হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্য অনেকটা নজিরবিহীনভাবে এই নীতি ঘোষণা করল যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আলোকে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। মার্কিন এই পদক্ষেপের সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এটা ভালো। তবে এই পদক্ষেপের কারণে ভালো নির্বাচন হবে কিনা-তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের কারণে পৃথিবীর কোনো দেশে ভালো নির্বাচন হওয়ার কোনো নজির এখনো নেই। ফলে এটা পরীক্ষিত নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন নতুন নীতি ঘোষণার পর তা ব্যাখ্যা করেছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বিষয়টি নিয়ে দিনভর ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি প্রথমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি নতুন ভিসা নীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পিটার হাস এসব আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নতুন ভিসানীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে সহায়তার লক্ষ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের এহেন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে সরকারি মহলে কিছুটা বিব্রতভাব লক্ষ করা গেলেও সরকারি প্রতিক্রিয়া ছিল সতর্ক, সংযত ও নমনীয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ অনেক দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে একই ধরনের ভিসার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কোনোটাই এখনো সুফল দেয়নি। বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা পরীক্ষামূলক এই পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসানীতিকে বাংলাদেশ গ্রহণ নাকি প্রত্যাখ্যান করেছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার। তারা তাদের ভিসানীতি কী নেবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারা এখন এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো দেশে সফল হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকারের সঙ্গে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিমতকে স্বাগত জানাই। মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে নির্বাচন বানচাল করতে যারা জ্বালাও-পোড়াও করে তা থেকে তাদের বিরত রাখতে সহায়ক হবে। অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি গ্রহণ করেছে। পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, এই ধরনের ভিসার পদক্ষেপ নিয়ে কোনো দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পেরেছে কিনা তা জানতে চেয়েছি। হাস তাকে (মোমেনকে) বলেছেন, এখনো তা পরীক্ষিত হয়নি। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া প্রভৃতি দেশে তারা প্রয়োগ করেছে। বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পতাকাবিহীন গাড়িযোগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ইদানীং তিনি তার গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করছেন না। রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে সর্বদা পতাকা ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি মহলে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হাস পতাকার ব্যবহার করছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। ঘণ্টাখানেকের মতো বৈঠকের পর পিটার হাস অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, এই বৈঠকের কর্মসূচি আগেই নির্ধারিত ছিল। আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তা নিয়েও আলোচনা করেছি। আমরা এই ভিসানীতি করেছি বাংলাদেশের জনগণ, বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান তাদের সহায়তা করার জন্য। গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি : বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর তার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের আওতায় তথাকথিত ৩সি বিধান অনুসারে মার্কিন সরকারের ভিসানীতি সংক্রান্ত ঘোষণাটির প্রতি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাটিকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব পর্যায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করছে। তবে বাংলাদেশ আশা করে যে, এই ভিসানীতি যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে অনুসরণ করা হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অব্যাহত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে দেশের জনগণ অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সুযোগ পেয়েছে। এর ফলে দেশের মাথাপিছু দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫% থেকে ২০২২ সালে ১৮.৭%-এ নেমে এসেছে এবং একই সময়ের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ২৫.১% থেকে ৫.৬%-এ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে উন্নয়নের একটি আন্তর্জাতিক রোল মডেল হিসাবে স্বীকৃত বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। গত চৌদ্দ বছরে টানা তিন মেয়াদে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতার কারণেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী কোনো সরকার টিকে থাকার নজির বাংলাদেশে নেই। জনগণের ভোটাধিকারকে আওয়ামী লীগ সরকার পবিত্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে এবং এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলটির কঠোর সংগ্রাম ও আÍত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। বর্তমান সরকার শান্তিপূর্ণ ও বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আওতায় সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্তির মতো অসংগতি দূর করার লক্ষ্যে ছবি সংবলিত ভোটার আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। ভোটারদের পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও এজেন্টদের মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবহার প্রচলন করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিবৃতিতে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ অনুমোদিত হয়েছে। এ আইন অনুসারে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পরিচালনার সুবিধার্থে সামগ্রিক নির্বাহী যন্ত্র তার নির্দেশনার আওতাধীন থাকবে। বিবৃতিতে বলা হয়, সে অনুযায়ী, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর যে কোনো অবৈধ প্রচেষ্টা বা হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সামগ্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়া কঠোর নজরদারির আওতায় রাখা হবে এবং এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও অংশগ্রহণ থাকবে। সরকার আশা করে যে, জাতীয় পর্যায়ে যেসব অগণতান্ত্রিক শক্তি সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের আশ্রয় নেয় তারা সতর্ক থাকবে এবং সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। কঠিন ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অর্জনকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপরই বর্তায়। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় সমর্থনকে বাংলাদেশ সরকার সর্বদাই ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে।