৬ ডিসেম্বর: কূটনৈতিক বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ—বিশ্ব মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামের প্রতিষ্ঠা

৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১০:৩০ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখটি কেবল একটি দিন নয়, বরং বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এই দিনেই ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সমরবিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই স্বীকৃতিই ছিল ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের ভিত্তিপ্রস্তর। যুদ্ধের মোড় ঘোরানো সিদ্ধান্ত ও বিশ্লেষণ বিশ্লেষকদের মতে, ৬ ডিসেম্বরের স্বীকৃতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এর আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ বা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতির মাধ্যমে এই যুদ্ধ একটি ‘আন্তর্জাতিক রূপ’ লাভ করে। এই স্বীকৃতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল তিনটি: ১. আইনি বৈধতা: বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বৈধতা পায়। ২. যৌথ কমান্ড গঠন: স্বীকৃতির পরেই ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মিত্রবাহিনী’ বা যৌথ কমান্ড গঠন করে, যা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করে। ৩. মনস্তাত্ত্বিক বিজয়: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ভুটান ও ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা ৬ ডিসেম্বর সকালে ভুটান সরকার তারহীন বার্তার মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ভারতের লোকসভায় দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন— “বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা।” তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। এই সাহসী সিদ্ধান্ত তৎকালীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধিতার মুখে, ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু দূরদর্শী পদক্ষেপ। মৈত্রী দিবস: বন্ধুত্বের নতুন দিগন্ত ৬ ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ককে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত দিনটিকে ‘মৈত্রী দিবস’ (Maitri Diwas) হিসেবে পালন করে। ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনটিকে এই বিশেষ মর্যাদা দেন। এটি কেবল অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, উন্নয়ন ও সহযোগিতার এক ইতিবাচক বার্তা। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা যখন জীবন বাজি রেখে লড়ছিলেন, তখন ৬ ডিসেম্বরের এই কূটনৈতিক বিজয় তাদের জানিয়ে দিয়েছিল—তারা একা নয়। আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, ৬ ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আত্মত্যাগ আর অকৃত্রিম বন্ধুত্বের শক্তিতে। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের সেই সাহসী অভিষেক আজও জাতির জন্য এক বিশাল গর্বের উৎস।