ওয়াশিংটনে গোপন দলিলে ২৬ মার্চ: ‘শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন’

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৬:১০ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। বাংলাদেশে যখন কালরাত নেমে এসেছে, তখন হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউসের টেবিলে পৌঁছে গিয়েছিল এক গোপন বার্তা। ‘ডিআইএ স্পট রিপোর্ট’ নামের সেই গোয়েন্দা দলিলে স্পষ্ট স্বীকার করা হয়েছিল—পাকিস্তান ভেঙে গেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। দীর্ঘ সময় গোপন থাকার পর প্রকাশিত এই দলিলে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর মুহূর্তের এক গভীর বিশ্লেষণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (DIA) সেই রিপোর্টে মূলত চারটি প্রধান দিক উঠে এসেছে যা ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১. স্বাধীনতার ঘোষণার দালিলিক প্রমাণ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হলেও মার্কিন এই গোপন দলিলটি তা নস্যাৎ করে দেয়। রিপোর্টের প্রথম অনুচ্ছেদেই স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে: “পাকিস্তান আজ গৃহযুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, যখন শেখ মুজিবুর রহমান দেশটির পূর্ব অংশকে ‘সার্বভৌম স্বাধীন পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ (Sovereign Independent People's Republic of Bangla Desh) হিসেবে ঘোষণা করেছেন।” গোয়েন্দা সংস্থাটি নিশ্চিত করে যে, এই ঘোষণার পরপরই ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। অর্থাৎ, ২৬ মার্চেই বিশ্বশক্তি জানত যে এটি আর কোনো বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলন নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। ২. অসম যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের আগাম বার্তা রিপোর্টে তৎকালীন সমরশক্তির একটি চিত্র পাওয়া যায়। মার্কিন গোয়েন্দারা জানায়, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় ২৩,০০০ নিয়মিত সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়ছে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (EPR)-এর ১০,০০০ সদস্য, পুলিশ এবং সাধারণ জনতা। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধের প্রথম দিনেই মার্কিন গোয়েন্দারা পাকিস্তানের পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। রিপোর্টে বলা হয়, “লজিস্টিক বা রসদ সরবরাহের জটিলতার কারণে ইসলামাবাদের (পশ্চিম পাকিস্তান) এই জোরপূর্বক দখলদারিত্ব সম্ভবত ব্যর্থ হবে।” তবে তারা সতর্ক করে বলেছিল, এই ব্যর্থতার আগে প্রচুর প্রাণহানি ঘটবে। ৩. বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইতিবাচক মূল্যায়ন ও মার্কিন শঙ্কা স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও, তাদের গোয়েন্দা রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর প্রতি এক ধরনের আস্থা প্রকাশ পায়। রিপোর্টে বলা হয়, শেখ মুজিব পররাষ্ট্র বিষয়ে খুব আগ্রহী না হলেও, “সুযোগ থাকলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।” উল্টোদিকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলাকে মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে। গোয়েন্দারা আশঙ্কা করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের এই সহিংস দমনপীড়ন পূর্ব পাকিস্তানকে উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা আমেরিকার জন্য শুভ হবে না। ৪. ভূ-রাজনীতি ও ভারতের অবস্থান যুদ্ধের শুরুর দিকে ভারতের ভূমিকা কী ছিল, তা স্পষ্ট হয় এই দলিলে। ভারতীয় কর্মকর্তারা তখন জানিয়েছিলেন, তারা এই যুদ্ধে জড়াতে চান না। তবে মার্কিন বিশ্লেষণ ছিল—যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাপ সীমান্ত অতিক্রম করে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে ভারতের ‘হাত গুটিয়ে রাখা’র নীতি বেশিক্ষণ টিকবে না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের এই দলিলটি প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, জনগণের প্রতিরোধ এবং ভৌগোলিক অবস্থান পাকিস্তানের পরাজয় ত্বরান্বিত করবে—যা মার্কিন গোয়েন্দারাও যুদ্ধের প্রথম দিনেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। এই রিপোর্টটি কেবল একটি গোয়েন্দা তথ্য নয়, বরং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক ঐতিহাসিক দলিল।