বিডিআর বিদ্রোহের ‘দাবার ঘুঁটি’ ও খুনিদের মুক্তি: ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি- রুদ্র মুহম্মদ জাফর

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৬:০৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

।। বিশেষ নিবন্ধ ।। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি। পিলখানার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তার রক্তে। সেই দগদগে ক্ষত আজও জাতির হৃদয়ে বিদ্যমান। কিন্তু ১৬ বছর পর আজ যখন দেখি, সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই কেবল ‘রাজনৈতিক সহানুভূতিতে’ জেল থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি তবে খুনিদের অভয়ারণ্যে বাস করছি? সদ্য প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান এবং বর্তমান ড. ইউনূস সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো সেই পুরনো সমীকরণকেই আবার সামনে এনেছে—বিডিআর বিদ্রোহ কি নিছকই দাবি-দাওয়ার আন্দোলন ছিল, নাকি শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে বিএনপি-জামায়াতের সাজানো ষড়যন্ত্রের ‘দাবার ঘুঁটি’ ছিল এই বিদ্রোহীরা? ষড়যন্ত্রের নেপথ্য ও ‘দাবার ঘুঁটি’ তত্ত্ব ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মাত্র দেড় মাসের মাথায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে এসেছেন, এটি ছিল সদ্য গঠিত সরকারকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার এবং সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার এক গভীর চক্রান্ত। সেই সময়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসা ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যাওয়া এবং বিদ্রোহ চলাকালীন বিএনপি-জামায়াতের নীরব ভূমিকা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। আজকের প্রেক্ষাপট সেই সন্দেহের জট খুলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিদ্রোহে অংশ নেওয়া জওয়ানরা ছিল মূলত সেই ষড়যন্ত্রকারীদের ‘দাবার ঘুঁটি’। সরকার পতনের মিশনে তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল। মিশন ব্যর্থ হলেও, সেই ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ডরা ভোলেনি তাদের ‘নিজেদের লোকদের’। আজ বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই পুরনো দোসরদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে কার্যত নিজেদের সংশ্লিষ্টতাই প্রমাণ করছে। হাসিনার ইস্পাতকঠিন ন্যায়বিচার বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা পিলখানা ট্র্যাজেডির পর যে ধৈর্য, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা বিশ্বনেতাদের কাছেও প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি আবেগের বশবর্তী হয়ে তাৎক্ষণিক কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি, বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঐতিহাসিক রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মোট ৮৫০ জন আসামির বিচার সম্পন্ন করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন—অপরাধী যত বড়ই হোক, রেহাই নেই। শেখ হাসিনার এই বিচার ছিল শহীদ সেনা পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। ইউনূস আমল: খুনিদের তোষণ নাকি পুরস্কার? মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখা যাচ্ছে বর্তমান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনামলে। ইনফোগ্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, ‘শাস্তি বাতিল’ করে এ পর্যন্ত ২৯৩ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে ১৭৮, ১৩, ৪০, ২৭ ও ৩৫ জন করে এই মুক্তি প্রক্রিয়া চলমান। প্রশ্ন হলো, যারা আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত, যারা সেনা কর্মকর্তাদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে, তাদের মুক্তির ভিত্তি কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কোনো সাধারণ মুক্তি নয়, এটি ‘পুরস্কার’। ২০০৯ সালে যারা বিএনপি-জামায়াতের ইশারায় বিদ্রোহ করেছিল, আজ তাদের মিত্র সরকার ক্ষমতায় থাকায় তারা এই ‘ভিআইপি ট্রিটমেন্ট’ পাচ্ছে। ইউনুস সরকার এখানে কেবল একটি মাধ্যম মাত্র; এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সেই পুরনো অশুভ শক্তি। ইতিহাসের কাঠগড়ায় বর্তমান বিডিআর বিদ্রোহের আসামিদের এই ঢালাও মুক্তি দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি এক চপেটাঘাত। শেখ হাসিনা যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করেছিলেন, সেখানে বর্তমান সরকার খুনিদের মুক্তি দিয়ে পুনরায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করছে। আজ এটা স্পষ্ট যে, এই মুক্তি প্রক্রিয়া কোনো মানবিক কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, পিলখানার খুনিরা ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের ‘প্রজেক্ট’-এর অংশ। আজ তাদের মুক্তি দিয়ে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো। ইতিহাস সাক্ষী থাকবে—কে বিচার করেছিল, আর কারা খুনিদের বাঁচাতে জেলখানার দরজা খুলে দিয়েছিল। রুদ্র মুহম্মদ জাফর সম্পাদক, আজকের কন্ঠ