চীন–পাকিস্তান ঘুরে বাংলাদেশের আকাশ নিরাপত্তা: ড্রোন ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে ব্যয়, ঝুঁকি ও গোপন প্রশ্ন
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত একটি বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি এখন গুরুতর বিতর্কের কেন্দ্রে। চীনের সঙ্গে দেশে ড্রোন উৎপাদনের চুক্তি এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠেছে অর্থ অপচয়, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ। প্রায় হাজার কোটি টাকার এই সামরিক প্রকল্প কোন প্রক্রিয়ায়, কার স্বার্থে এবং কতটা স্বচ্ছভাবে হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ☑️ দেশে ড্রোন উৎপাদন: চুক্তি আছে, তথ্য নেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অধীনে চীনের একটি প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে দেশে সামরিক ড্রোন তৈরির পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে সীমান্ত নজরদারি, আকাশ পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় • এই প্রকল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ, •প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাত্রা, • সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ, • এবং মেধাস্বত্ব (intellectual property) কার হাতে থাকবে এসব বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক নথি জনসমক্ষে প্রকাশ হয়নি। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, চীনের মাঝারি মানের সামরিক নজরদারি ড্রোনের একক মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১৮ থেকে ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ২০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নয়, বরং ২০–৫০ কোটি টাকার মধ্যে)। অথচ পাকিস্তানের মাধ্যমে একই শ্রেণির ড্রোন কেনা হলে সেই দাম ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করছে। ☑️ পাকিস্তানের মাধ্যমে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: সরাসরি কেন নয় অনুসন্ধানে জানা গেছে, চীনের তৈরি একটি স্বল্প-পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (SHORAD বা HQ সিরিজের কাছাকাছি প্রযুক্তি) পাকিস্তানের মাধ্যমে ক্রয় করা হচ্ছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি লালমনিরহাট অঞ্চলে স্থাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই ধরনের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাটারির আনুমানিক মূল্য • সরাসরি চীন থেকে কিনলে: ৮০ থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার • পাকিস্তানের মাধ্যমে কিনলে সম্ভাব্য মূল্য: ১৩০ থেকে ১৮০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পাকিস্তান যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে সংশ্লিষ্ট মহল। এই বাড়তি অর্থ কোথায় যাচ্ছে, কারা এই মধ্যস্থতার সুবিধাভোগী—এই প্রশ্নের কোনো স্বচ্ছ উত্তর এখনো মেলেনি। ☑️ নিরাপত্তা ঝুঁকি: সফটওয়্যার ও কমান্ড কার হাতে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, আধুনিক ড্রোন ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শুধু হার্ডওয়্যার নয়, সম্পূর্ণভাবে সফটওয়্যার ও এনক্রিপ্টেড কমান্ড সিস্টেম নির্ভর। তৃতীয় পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের মাধ্যমে এই সরঞ্জাম কেনা হলে কয়েকটি গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয় ! • অপারেটিং সফটওয়্যারে ব্যাকডোর থাকার সম্ভাবনা •রিয়েল-টাইম অপারেশন ডেটা বিদেশি সার্ভারে চলে যাওয়ার আশঙ্কা • যুদ্ধ বা সংকট পরিস্থিতিতে দূরনিয়ন্ত্রিত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঝুঁকি একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি শতভাগ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে সেটা প্রতিরক্ষা নয়, বরং নিরাপত্তার জন্য নিজেই একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।” ☑️ ড্রোন ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্য: আন্তর্জাতিক বাজার বনাম বাংলাদেশ তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, একই প্রযুক্তির নজরদারি ড্রোন ! • তুরস্ক, •দক্ষিণ কোরিয়া, • এমনকি সরাসরি চীন থেকেও অনেক কম দামে কেনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ সেই পথ না বেছে পাকিস্তানের মাধ্যমেই ক্রয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর ফলে প্রতি ইউনিটে আনুমানিক ১০–১৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদি ২০ থেকে ৩০টি ড্রোন কেনা হয়, তবে মোট অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়াতে পারে ২০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকারও বেশি। ☑️ সংসদীয় তদারকি নেই, সব সিদ্ধান্ত গোপনে এই পুরো প্রকল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো • কোনো সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে প্রকাশ্য আলোচনার প্রমাণ নেই । • গণমাধ্যমে সরকারি দরপত্র বা টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি নেই । • স্বাধীন অডিট বা ব্যয় বিশ্লেষণও প্রকাশ হয়নি। সুশাসন সংশ্লিষ্ট এক গবেষণা সংস্থার মতে, “এ ধরনের বড় সামরিক চুক্তিতে সাধারণত একাধিক স্তরের তদারকি থাকে। এখানে সেই স্বচ্ছতার ঘাটতি গুরুতরভাবে চোখে পড়ছে।” ☑️ সরকারের বক্তব্য: সীমিত ও অস্পষ্ট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র শুধু জানিয়েছে, “সব ধরনের সামরিক ক্রয় জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে করা হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই হচ্ছে।” তবে কত দামে কেনা হচ্ছে, কেন পাকিস্তানের মাধ্যমেই কেনা হচ্ছে, চুক্তির শর্ত কী—এই প্রশ্নগুলোর কোনোটিরই নির্দিষ্ট উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। ☑️ উন্নয়ন না কি পরিকল্পিত অপচয় দেশে ড্রোন উৎপাদন ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন নিঃসন্দেহে একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত যদি • অস্বচ্ছ চুক্তি, • অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্থতা, • অতিরিক্ত ব্যয়, • এবং সম্ভাব্য সাইবার ও সামরিক নিরাপত্তা ঝুঁকির সঙ্গে জড়িয়ে যায় । তাহলে তা জাতীয় নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করার বদলে উল্টো দুর্বল করে দিতে পারে। চীন–পাকিস্তান ঘুরে বাংলাদেশের আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে অর্থ, প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ঢুকে পড়ছে, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব আজও জনসমক্ষে নেই। ফলে এখনই স্বাধীন তদন্ত, সংসদীয় পর্যালোচনা এবং পূর্ণাঙ্গ হোয়াইট পেপার প্রকাশের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে ।
