ডিজিটাল ফোরাম থেকে টিটিপি নিয়োগ নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশি তরুণদের টেনে নিচ্ছে পাকিস্তানের জঙ্গি রিক্রুটাররা: ইমরান হায়দারের ছায়া নেটওয়ার্ক ।
২০২২ সালের শেষ দিকে ইমরান হায়দার নামে এক বাংলাদেশি যুবক অনলাইনে একটি ছোট ডিজিটাল ফোরাম গড়ে তোলেন। শুরুতে সেটি সাধারণ আদর্শিক আলোচনা বলে মনে হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তা রূপ নেয় একটি সংগঠিত উগ্রবাদী নিয়োগ নেটওয়ার্কে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত নয়জন বাংলাদেশি যুবক ভারতের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-তে যোগ দিয়েছেন। নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, ইমরান হায়দার বর্তমানে এই নতুন ধরনের ‘হাইব্রিড’ উগ্রবাদী কাঠামোর অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে চিহ্নিত। এই কাঠামোর মাধ্যমে আদর্শিক বিভ্রান্তি, ডিজিটাল উগ্রবাদ ছড়ানো এবং গোপন সীমান্ত পারাপারকে একীভূতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। উদীয়মান ইন্দো–টিটিপি সংযোগে হায়দার একই সঙ্গে নিয়োগকারী ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন। ‘এনেমি ডাইভার্শন প্রোগ্রাম’ ও বাংলাদেশের ঝুঁকি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে রয়েছে একটি কাঠামো, যাকে অভ্যন্তরীণ পরিভাষায় ‘এনেমি ডাইভার্শন প্রোগ্রাম’ বা ইডিপি বলা হচ্ছে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যার মাধ্যমে ভারতবিরোধী উগ্র ইসলামি ক্ষোভকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে পাকিস্তানকেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠনের জন্য জনবল সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশি উগ্রবাদী শক্তিগুলো হতাশ তরুণদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইমরান হায়দারের পটভূমি ত্রিশের কোঠায় থাকা ইমরান হায়দার বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের বিমান প্রকৌশলের স্নাতক। অনলাইনে তিনি নিজেকে ‘মিলিটারি সায়েন্স’-এ পারদর্শী হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাস্তবে বাংলাদেশের কোনো বেসামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ নেই। তদন্তকারীদের মতে, এটি ছিল তার তৈরি করা একটি পরিচয়, যার মাধ্যমে তিনি সম্ভাব্য নিয়োগপ্রাপ্তদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন। তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপস্থিতি সীমিত হলেও শনাক্তযোগ্য। বাস্তব নামে একটি ফেসবুক আইডি, @Black251094 নামে একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট এবং কয়েকটি গোপন মেসেজিং গ্রুপের মাধ্যমে তিনি আদর্শিক প্রচারণা চালাতেন। উগ্রপন্থায় যাওয়ার আগের জীবন উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার আগে হায়দারের যোগাযোগ ছিল উদীচী ও ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। ঢাকার ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার এবং ছাত্রলীগের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল বলে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সময়ে তিনি বিভিন্ন মতাদর্শিক পরিসরে অবাধে চলাচল করতে পারতেন। পরবর্তীতে এক স্থানীয় আলেমের প্রভাবে তার আদর্শিক রূপান্তর ঘটে। ওই আলেম উগ্রপন্থী মহলে ‘মুফতি উসমান’ বা ‘আবু ইমরান’ নামে পরিচিত বলে গোয়েন্দা সূত্রের ধারণা। কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানমুখী যাত্রা ২০২২ সালের জুনে হায়দার ভারত হয়ে কাশ্মীরে যান এবং আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ নামের একটি সংগঠনে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ভাষাগত সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি পাকিস্তানকেন্দ্রিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০২৩ সালের শুরুতে তিনি সরাসরি ‘ফ্যাসিলিটেটর’-এর ভূমিকায় যুক্ত হন। বাংলাদেশ থেকে যুবকদের বাছাই, অনলাইন মাধ্যমে উগ্রবাদে দীক্ষা, আর্থিক সহায়তা এবং সীমান্ত পারাপারের ব্যবস্থা করাই ছিল তার মূল কাজ। আন্তর্জাতিক রুট ও টেলিগ্রামের ভূমিকা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি কাজাখস্তান হয়ে আফগানিস্তান এবং সেখান থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার করিডোর ব্যবহার করতেন। ২০২৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারকেও অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এনক্রিপ্টেড প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামের মাধ্যমে তিনি টিটিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি টিটিপি প্রধান মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের তথ্যও গোয়েন্দা নথিতে রয়েছে। পাকিস্তানকে ‘মূল শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন টিটিপিতে যুক্ত হওয়ার পর হায়দার এমন এক প্রচারণা শুরু করেন, যেখানে তিনি পাকিস্তানকেই দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের ‘প্রধান শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরেন। তার ভাষায়, ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’-এর পথে প্রধান বাধা পাকিস্তানই। এই বয়ানের মাধ্যমে তিনি আফগান তালেবানকে আপসকামী এবং টিটিপিকে একমাত্র ‘খাঁটি’ জিহাদি সংগঠন হিসেবে তুলে ধরেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি রাজনীতিতে একটি কৌশলগত পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, এই ধরনের ডিজিটাল-ভিত্তিক উগ্রবাদী নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ধরনের হুমকি। সীমান্ত পারাপার, অনলাইন নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহারের মাধ্যমে এটি জটিল রূপ নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বর্তমানে সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ চ্যানেল, আর্থিক লেনদেন এবং সম্ভাব্য সহযোগীদের শনাক্ত করতে তদন্ত জোরদার করেছে।
