দুই হত্যা, দুই বিশ্ববিদ্যালয়, এক নিস্ক্রিয় সরকার : বিচার পাবে কবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তোফাজ্জল হোসেন আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, অথচ একটি মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। আরেকটির চার্জশিট এতটাই দায়সারা যে আদালত নিজেই অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই দুই খুনের বিচারের গতিপ্রকৃতি দেখে একটা প্রশ্ন মাথায় আসাই স্বাভাবিক যে, মানুষের জীবনের দাম কি শূন্য হয়ে গেছে এই দেশে? তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষ। ফজলুল হক মুসলিম হলে মোবাইল চুরির অভিযোগে তাঁকে পেটানো হয়। মারধরের এক পর্যায়ে ক্ষুধার্ত জানালে তাঁকে খাবার খাইয়ে আবার পেটানো হয়েছিল। এই নৃশংসতার চিত্র শুনলে গা শিউরে ওঠে। অথচ পুলিশের তদন্তে ২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হলেও গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে যে আট জনের নাম এসেছিল, তাদের নাম চার্জশিটে নেই। সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইলে ধারণ করা মারধরের ছবি আর ভিডিও পর্যন্ত ঠিকমতো বিশ্লেষণ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নারাজি আবেদনে যে অভিযোগ তুলেছে, তা শুনলে মনে হয় তদন্ত কর্মকর্তা হয় অযোগ্য, না হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই ঢিলেঢালা তদন্ত করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ নিয়ে যাওয়া কনস্টেবলকে পর্যন্ত সাক্ষী হিসেবে নেওয়া হয়নি। এমন তদন্তের পর আদালতের পক্ষে পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল? এপ্রিল মাসে মামলার ডকেট হাতে পাওয়ার পর এখনো তদন্ত চলমান বলে জানিয়েছে পিবিআই। চার্জশিটে নাম থাকা আসামিদের মধ্যে ছয়জন কারাগারে, বাকি ১৫ জন পলাতক। তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার যখন বলেন যে জড়িতদের একজনও যেন চার্জশিটের বাইরে না থাকে, তখন তার কণ্ঠে যে আর্তি শোনা যায়, সেটা কোনো কৃত্রিম ক্ষোভ নয়। তার একমাত্র ভাই মারা গেছেন, বাবা-মা মারা গেছেন। এখন তার মামাতো ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চায় সে। কিন্তু এক বছরেও তদন্ত শেষ না হলে কবে পাবে সে ন্যায়বিচার? অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। শামীম মোল্লাকে হত্যার অভিযোগে যে আট জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজন গ্রেপ্তার হন, একজন আত্মসমর্পণ করেন, বাকিরা পলাতক। কিন্তু যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখন জামিনে বাইরে। এক বছর পরেও তদন্ত শেষ হয়নি। আর যারা বাইরে আছেন, তারা প্রকাশ্যেই ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছয় মাসের জন্য তাদের বহিষ্কার করেছিল, সেই বহিষ্কারাদেশের মেয়াদ শেষে এখন তারা ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছেন। এখানে আরও মজার ব্যাপার হলো, হত্যা মামলার আসামি আহসান লাবিব জাকসুর সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক পদে বিজয়ী হয়েছেন। রাজু আহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন। মানে, একদিকে হত্যা মামলার তদন্ত চলছে, অন্যদিকে আসামিরা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পদ পেয়ে যাচ্ছেন। এর থেকে স্পষ্ট বার্তা কী যায়? হত্যা করে পার পাওয়া যায়, যদি সঠিক সময়ে সঠিক দলে থাকা যায়। শামীম মোল্লার ভাই শাহীন মোল্লার কথাটা খুবই হৃদয়বিদারক। তিনি বলছেন, আসামিরা ঘোরাফেরা করলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। এক বছর পার হলেও তদন্ত শেষ হয়নি। কবে বিচার পাবেন, তা আল্লাহই ভালো জানেন। এই যখন স্বজনদের অবস্থা, তখন আর কী বলার থাকে? এখন প্রশ্ন হলো, যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে, তাদের কাছে কি এই দুই হত্যাকাণ্ডের বিচার অগ্রাধিকার নয়? যে সরকার নিজেদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে ক্ষমতায় এসেছে, তারা কি পারে না এই মামলা দুটো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে? নাকি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে এই হত্যাগুলো এতটাই তুচ্ছ যে সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই? মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার বারবার মানবাধিকার, আইনের শাসন আর ন্যায়বিচারের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে এই দুই মামলার গতিপ্রকৃতি দেখলে মনে হয় না যে তারা সত্যিই এসব নিয়ে চিন্তিত। এক বছর পেরিয়ে গেলেও একটি মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। অন্যটির চার্জশিট এতটাই দুর্বল যে আদালত পুনর্তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এই হলো বাস্তবতা। তোফাজ্জল আর শামীম মোল্লা এই দুজনের কোনো পরিচয় নেই, কোনো ক্ষমতা নেই। তারা কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ নন, তাই তাদের হত্যার বিচার নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। এই যে মানুষের জীবনের প্রতি চরম উদাসীনতা, এটাই হচ্ছে বর্তমান শাসনব্যবস্থার আসল চেহারা। যে সরকার নিজেদের গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ধারক-বাহক হিসেবে জাহির করে, তাদের শাসনামলে হত্যা মামলার তদন্ত এক বছরেও শেষ হয় না। আসামিরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে, রাজনীতিতে পদ পায়। এই হচ্ছে এখানকার নিয়ম। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, তোফাজ্জল আর শামীমের পরিবার এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছে। তারা জানে না আদৌ কোনোদিন বিচার পাবে কিনা। এক বছরেও যদি তদন্ত শেষ না হয়, তাহলে বিচার শেষ হবে কবে? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। কারণ যে সরকার নিজেই অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছে আইনের শাসন বা ন্যায়বিচার কোনো অগ্রাধিকার নয়। তারা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার খেলায় ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের জীবন, সাধারণ খুনের বিচার, এসব তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ বিষয়।
