আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলছে মাদ্রাসা-বাণিজ্য: শিক্ষা-বসবাসের পরিবেশ বনষ্টে বিপাকে বাসিন্দারা

২৪ নভেম্বর, ২০২৫ | ৫:৩৩ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাজধানী ঢাকার আবাসিক এলাকায় ভাড়া নেওয়া সাধারণ ফ্ল্যাটেই গড়ে উঠছে অসংখ্য আবাসিক মাদ্রাসা। পরিবার পরিচয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেও কিছুদিনের মধ্যে সেখানে শুরু হয় ছাত্রাবাস, শিক্ষা ও খাবারের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম। এতে একদিকে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে বাসিন্দাদের, অন্যদিকে শিশুদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি, মানসম্মত শিক্ষা এবং ভবনের স্থাপনা-নিরাপত্তা নিয়ে উঠছে গুরুতর প্রশ্ন। মোহাম্মদপুর, মুগদা, খিলগাঁও, জুরাইন, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৩০ জন বাড়িওয়ালা ও বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের পারিবারিক ভাড়াটিয়া পরিচয় দেয়। চুক্তির সময় বলা হয়—“দুই-তিনজন থাকবো।” কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই দেখা যায়, একই ফ্ল্যাটে ২০–৩০ জন শিশুর বসবাস। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীর আবাসিক অঞ্চলে যেভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবাসিক মাদ্রাসার বিস্তার ঘটছে, তাতে শিশুর শিক্ষা ও নিরাপত্তা যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাসিন্দাদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশও। প্রয়োজন জরুরি নীতিমালা, নিবন্ধন এবং নিয়মিত তদারকি—অন্যথায় আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য ও নিরাপত্তা দুটিই হুমকির মুখে পড়বে। এক বাড়ির মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- “শুরুতে বলেছিল পাঁচজন থাকবে। পরে দেখি ফ্ল্যাটে বিছানার পর বিছানা। বাচ্চারা করিডরে ঘুমায়। রান্নার ধোঁয়ায় পুরো বিল্ডিং অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়।” দিনরাত সম্মিলিত কোরাসে পড়া, হিফজ ক্লাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চলাচল—এসব কারণে বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দা বলেন, “রাত ১০টার পরও বাচ্চারা সুর করে পড়তে থাকে। বাচ্চাদের দোষ নেই, পরিবেশটাই অনুপযোগী। ঘুমানো যায় না।” পানি-লাইন ও লিফটে অতিরিক্ত চাপ, রান্নার ধোঁয়া, বাথরুমের লাইনে ভিড়, বাড়ির দরজার সামনে জুতা-স্যান্ডেলের সারি—এসব প্রতিদিনের দৃশ্য। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ নিরাপত্তা নিয়ে— অপরিচিত শিক্ষক ও আবাসিকদের নিয়মিত যাতায়াত কোনো কোনো এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। এ ধরনের মাদ্রাসার বেশিরভাগেরই কোনো সরকারি নিবন্ধন বা স্বীকৃতি নেই। শিক্ষকদের যোগ্যতা, শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্যতালিকা কিংবা নিরাপত্তা—কোনোটির ওপরই সরকারি তদারকি নেই। শিশু অধিকারকর্মী এক বিশেষজ্ঞ বলেন- “একটি ১,০০০–১,২০০ স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটে ৩০ জন শিশু—এটি মানবিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, খেলাধুলা নেই—এতে শিশুর মানসিক ও শিক্ষাগত বিকাশ স্থবির হয়ে পড়ে।” কিছু ফ্ল্যাটে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বের হওয়ার পর্যাপ্ত পথ নেই—এটিকেও বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছেন দমকল কর্মকর্তারা। মুগদার একটি ভবনের একজন বাসিন্দা বলেন— “আমি প্রতিদিন দেখি করিডরে বাচ্চারা বই মুখে দাঁড়িয়ে পড়ছে। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বের হয়ে পুরো ফ্লোর ধোঁয়াটে হয়ে থাকে। রাতে দেরি পর্যন্ত কোরাসে পড়ায় পরিবারের ছোট বাচ্চারাও ঘুমাতে পারে না।” আরেকজন জানান— “এক ফ্ল্যাটে শুরু করে পরে পাশের ফ্ল্যাটটাও নিয়ে নেয়। পুরো ফ্লোরটাই যেন ছাত্রাবাস।” রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক ভবনে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক ছাত্রাবাস বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে চাইলে আগেই অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু ছোট আকারে শুরু হওয়ায় এসব মাদ্রাসা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন— “এ ধরনের কার্যক্রম অনুমতি ছাড়া চলতে পারে না। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বাসিন্দারা বলছেন—ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে নয় তারা। তাদের আপত্তি পদ্ধতি নিয়ে। এক বাসিন্দা বলেন, “মানুষ ঘর ভাড়া নেয় পরিবারের জন্য। হঠাৎ ৩০–৪০ জন শিশু এসে উঠলে পুরো বিল্ডিংয়ের জীবনযাত্রা পাল্টে যায়। ধর্মীয় শিক্ষার উপযোগী আলাদা পরিবেশ থাকা উচিত।”