শাহরিয়ার কবিরের অপরাধ : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ানো

২৪ নভেম্বর, ২০২৫ | ৫:২৯ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল যখন শাহরিয়ার কবিরের মুক্তি দাবি করে, তখন ব্যাপারটা আর সাধারণ কোনো গ্রেপ্তারির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা হয়ে ওঠে একটা রাষ্ট্রের চরিত্রের প্রশ্ন। ইউএনএইচআরসি স্পষ্ট করে বলেছে, শাহরিয়ার কবিরের গ্রেপ্তারিতে আইনি মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়েছে। তারা ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, দায়ীদের বিচার চেয়েছে। কিন্তু ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার কী করেছে? জাতিসংঘের চিঠির জবাব দিতে দেরি করেছে, এবং সেই জবাব এতটাই দুর্বল ছিল যে ইউএনএইচআরসি সেটা আমলেই নেয়নি। এটা কোনো প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটা সুচিন্তিত এড়িয়ে যাওয়া। কারণ তারা জানে, শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে তাদের হাতে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। এই লোকটাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কী অভিযোগে? টক শোতে কথা বলেছেন বলে। হাস্যকর শোনাচ্ছে না? একজন মানুষ টেলিভিশনে বসে তার মতামত দিয়েছেন, আর সেটাকে অপরাধ বানিয়ে তাকে এক বছরেরও বেশি সময় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। ইউএনএইচআরসি পরিষ্কার বলেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দেখাতে পারেনি যে শাহরিয়ার কবিরের কথা কীভাবে হত্যা বা সহিংসতায় প্ররোচিত করেছে। তারা কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি যে তার বক্তব্য আইনের 'অনুমোদিত সীমা' লঙ্ঘন করেছে। তাহলে এত দিন তাকে আটকে রাখার ভিত্তি কী? ভিত্তি একটাই, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। শাহরিয়ার কবিরের আসল অপরাধ তার কাজের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তিনি তথ্যচিত্র বানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাসবাদের সংযোগ নিয়ে। ইউএনএইচআরসি নিজেই তাদের প্রতিবেদনে এটা উল্লেখ করেছে যে শাহরিয়ার কবির 'চরমপন্থি মতাদর্শ' এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি তৈরি করেছেন 'শক্তিশালী রাজনৈতিক শত্রু'। সেই শত্রুরাই এখন ক্ষমতায়, আর তারা বসে থাকবে কেন? একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে শাহরিয়ার কবিরের ভূমিকা ছিল মৌলিক। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনি এই কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি একটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, যেটা ক্রমাগত চাপ তৈরি করে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা যখন একের পর এক যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে, তার পেছনে এই কমিটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং এই কমিটিকে যে মানুষটা দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাকে জামায়াত ক্ষমা করবে কী করে? জুলাই মাসের ঘটনাকে যত আবেগি ভাষায় 'গণ-অভ্যুত্থান' বলা হোক না কেন, সত্যটা হলো এটা ছিল একটা সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় ক্যু। বিদেশি তহবিল ঢুকেছে, ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়েছে, আর সামরিক বাহিনী নীরব থেকে পরিস্থিতি পাকাপোক্ত হতে দিয়েছে। একটা নির্বাচিত সরকারকে জোর করে সরিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনুসকে, আর তার পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এই পুরো কাঠামোটা তৈরিই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। আর শাহরিয়ার কবির সেই চেতনার একজন প্রধান ধারক। অন্তর্বর্তী সরকারের আচরণ দেখলেই বোঝা যায় তারা কতটা ভীত। ইউএনএইচআরসি ২৭ ফেব্রুয়ারি তাদের চিঠি পাঠিয়েছিল, জবাব দেওয়ার সময় ছিল ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত। তারা জবাব দিয়েছে ১৩ মে। প্রায় দুই সপ্তাহ দেরিতে। আর সেই জবাবের মান এমন ছিল যে ইউএনএইচআরসি সেটাকে তাদের প্রতিবেদনে আমলই নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ সেখানে কোনো কঠিন তথ্য ছিল না, ছিল না শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে কোনো বাস্তব অভিযোগের প্রমাণ। একটা সরকার যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে নিজের নাগরিককে আটকে রাখার যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই সরকারের বৈধতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে। শাহরিয়ার কবির এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে, কিন্তু তার বিচার শুরুই হয়নি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী, একজন আটক ব্যক্তির নিয়মিত ও অর্থবহ বিচারিক পর্যালোচনার অধিকার থাকতে হবে। সেটা হয়নি। তাকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জামিনের আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু দেওয়া হয়নি। কেন? কারণ এটা আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটা মনোবৈজ্ঞানিক নির্যাতন। একজন মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে রেখে তার ভাঙনের অপেক্ষা করা হচ্ছে। ইউনুস নিজে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। কিন্তু সেই খ্যাতি দিয়ে তিনি যে কাজ করছেন, সেটা তার সমস্ত কীর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একজন মানুষ যখন ক্ষমতায় আসার জন্য জামায়াতে ইসলামীর মতো একটা সংগঠনের সাথে হাত মেলান, যারা একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে সহযোগিতা করেছিল, তখন তার নৈতিক অবস্থান কোথায় থাকে? ইউনুস হয়তো ভাবছেন তিনি একটা 'সংস্কার' প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। কিন্তু যে সংস্কার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের কারাগারে পাঠিয়ে শুরু হয়, সেটা সংস্কার নয়, সেটা প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিষ্ঠা। জামায়াতে ইসলামী এখন উল্লসিত। তারা এতদিন পর আবার ক্ষমতার কাছাকাছি এসেছে, এবং এবার তারা তাদের পুরনো হিসাব চুকিয়ে নিতে চায়। শাহরিয়ার কবির, যিনি তাদের নেতাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, যিনি তাদের কুকীর্তি তুলে ধরে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, তাকে শায়েস্তা করার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে? এবং এখানে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে। কারণ এই সরকার টিকে আছে জামায়াতের মদদে। ইউনুস জানেন, জামায়াত ছাড়া তার ক্ষমতার ভিত নেই। তাই জামায়াত যা চায়, সেটাই হচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা শুধু একজন মানুষের গ্রেপ্তারি নয়। এটা একটা পরিকল্পিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার। শাহরিয়ার কবিরকে কারাগারে রেখে তারা একটা বার্তা দিতে চাইছে যে, এই দেশে এখন আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা নিরাপদ নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া যাবে না। জামায়াতের অপকর্মের কথা তুলে ধরা যাবে না। যারা এসব করবে, তাদের এই পরিণতি হবে। এটা একটা ভয়ের রাজত্ব তৈরির চেষ্টা। ইউনুস নিজে একজন সুদী মহাজন হিসেবে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণের নামে দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করে তিনি আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু সেই সম্মান এসেছে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চায়। জুলাই মাসের ক্যুতে সেই বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল, এটা আর গোপন কিছু নেই। টাকা এসেছে বাইরে থেকে, সমর্থন এসেছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছ থেকে। আর ভেতরে যন্ত্রটা সচল রেখেছে জামায়াত আর তাদের সহযোগী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। শাহরিয়ার কবির একজন বাংলা একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী লেখক। তিনি শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। তার সারাজীবনের কাজ হলো মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরা। ১৯৭২ সালে বিচিত্রায় সাংবাদিকতা শুরু করে ১৯৯২ পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মানুষটা কি একজন সন্ত্রাসী? কি একজন খুনি? তাকে কারাগারে পচতে হচ্ছে কেন? কারণ তিনি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। কারণ তিনি মানবতায় বিশ্বাসী। কারণ তিনি মনে করেন একাত্তরের গণহত্যার বিচার হওয়া উচিত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এই প্রতিবেদন একটা দলিল হয়ে থাকবে। এটা প্রমাণ করবে যে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার আর তার সহযোগী জামায়াতে ইসলামী কীভাবে আইনের শাসনকে পদদলিত করেছে। কীভাবে একজন নিরপরাধ মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি বানানো হয়েছে। কীভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রশ্নের জবাব দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদেরকে দেখায়, এই ধরনের প্রচেষ্টা কখনো সফল হয় না। শাহরিয়ার কবিরকে যত দিনই কারাগারে রাখা হোক না কেন, তার কাজ থেকে যাবে। তার তথ্যচিত্র থেকে যাবে। তার লেখা থেকে যাবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তার নীতিবোধ থেকে যাবে। একজন মানুষকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু একটা আদর্শকে আটকে রাখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই দেশের মাটিতে প্রোথিত, এবং সেটা কোনো অবৈধ সরকার বা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মুছে ফেলতে পারবে না।