মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পীদের নির্যাতন: উগ্রবাদের উত্থানে সংকটে সংস্কৃতিচর্চা, দায় এড়াতে পারে না ইউনূস সরকার

২৪ নভেম্বর, ২০২৫ | ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পীদের ওপর তৌহিদি জনতার নামে সংগঠিত উগ্রবাদীদের বর্বরোচিত হামলা শিল্প-সংস্কৃতির স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। শনিবারের এই ঘটনায় বাউল শিল্পী আবুল সরকারের অন্তত ১০ জন ভক্ত-অনুসারী আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে শ্লোগান দিয়েছে— “একটা একটা বাউল ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।”এই ভয়াবহ উস্কানিমূলক শ্লোগান স্পষ্ট করে যে, ঘটনাটি কোনো আকস্মিক মারামারি নয়—বরং সংস্কৃতিচর্চাকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, হামলাটি পরিচালনা করেছে তৌহিদি জনতার ব্যানার ব্যবহারকারী একটি উগ্রবাদী দল, যার ভেতরে জামায়াত–শিবিরঘেঁষা সক্রিয় সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল। বাউল গান, মানবধর্ম, মানবিকতাভিত্তিক দার্শনিক চর্চা দীর্ঘদিন ধরেই উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির চোখে ‘টার্গেট’।এই হামলায় সেই বিরোধ আবারও সহিংস রূপে ফিরে এসেছে। এরচেয়ে উদ্বেগজনক হলো—আক্রমণকারীদের ব্যবহৃত রণহুঙ্কার। “ধইরা ধইরা জবাই করা”—এই ধরনের স্লোগান শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, বরং সাংস্কৃতিক ভিন্নমতকে নির্মূল করার মানসিকতা প্রকাশ করে। সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকারের অবস্থান সাংস্কৃতিক মানসিকতা ও মানবিক মতাদর্শের চর্চাকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। বিশেষত, বাউল ও লোকজ সংস্কৃতিকে “অসাংগত” বা “ধর্মবিরোধী” আখ্যা দিয়ে যেসব বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যম, মসজিদ ও ধর্মীয় সমাবেশে ছড়িয়ে পড়েছে—সেগুলোর লাগাম টানা হয়নি। ইউনূস সরকারের দায়িত্বহীন নীরবতা এবং মাঠপর্যায়ে তৌহিদি-ব্যানারধারী উগ্র গোষ্ঠীর প্রতি প্রশাসনিক শিথিলতা—এসবই এই সহিংসতাকে পুষ্ট করেছে বলে মনে করেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই। বাউল গবেষক সানোয়ার হোসেন বলেন, “এই হামলাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে উগ্রবাদীরা মনে করছে, সংস্কৃতি চর্চা রোধ করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এর দায় অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের।” ‘তৌহিদি জনতা’ নামের আড়ালে সংগঠিত রাজনীতি স্থানীয় প্রশাসন এখনও ঘটনাটিকে “দুটি পক্ষের সংঘর্ষ” হিসেবে বর্ণনা করলেও, মাঠের বাস্তবতা তার বিপরীত। তৌহিদি জনতার ব্যানার ব্যবহারকারী দলটি এলাকায় আগেও মেলা, গান-বাজনা, বাউল পালা–এসব আয়োজন বাধাগ্রস্ত করেছে। এবার তারা সরাসরি হামলায় নেমেছে। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এই গোষ্ঠীর মধ্যে জামায়াত–শিবিরের সক্রিয় সদস্যরা রয়েছে, রয়েছে হিযবুত তাহরীরসহ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনও। যারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে সাংস্কৃতিক বিরোধ গড়ে তুলছে। হামলার পর আহত বাউলদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সামনেই মারধর করেছে। কোন নিরাপত্তা পাচ্ছেন না তারা। এই উদাসীনতা বাউল সম্প্রদায়ের মনে আরও আতঙ্ক তৈরি করেছে। একজন স্থানীয় বাউল শিল্পী বলেন— “আমরা গান করি, মানুষের কথা বলি। এখন মনে হচ্ছে আমরা অপরাধী। সরকার যদি আমাদের রক্ষা না করে, তাহলে আর কে করবে?” মানিকগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বর্তমানে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।