শেখ হাসিনার বিচার ও প্রত্যর্পণ: ঢাকায় ব্রিটিশ আইনজীবীরা, নেপথ্যে ভারত-পাকিস্তান ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা সমীকরণ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) মৃত্যুদণ্ডাদেশ-পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে ঢাকায় এসেছেন দুই বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনজীবী। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার (প্রত্যর্পণ) উদ্যোগ গ্রহণ করায় এই আইনজীবীদের আগমন বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। গত ১৯ নভেম্বর এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে (ইকে-৫৮৬) দুবাই হয়ে ঢাকায় পৌঁছান ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান ও আনাস্তাসিয়া মেদভেদেস্কায়া। আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ টবি ক্যাডম্যান আইসিটির চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি লন্ডনভিত্তিক 'দ্য গুইলিকা গ্রুপ'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রত্যর্পণ, সন্ত্রাসবাদ ও মানবাধিকার আইনে অভিজ্ঞ। অন্যদিকে, আনাস্তাসিয়া মেদভেদেস্কায়া আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং প্রত্যর্পণ মামলায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি এর আগে রাশিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের এই সফর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া এবং ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ আইনজীবীদের আগমনের সমসাময়িক সময়েই দিল্লির সঙ্গে ঢাকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভে যোগ দিতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) খলিলুর রহমান ১৮ নভেম্বর দিল্লি পৌঁছান। কনক্লেভটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলেও, প্রাপ্ত তথ্যমতে খলিলুর রহমান ১৯ নভেম্বর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বেশ কিছু নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে—সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কারাগার থেকে আগাম মুক্তি, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে (বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে) সন্দেহভাজন চরমপন্থীদের আস্তানা, এবং বাংলাদেশে মৌলবাদী কার্যক্রমের উত্থান। এর আগে গত ১৪ থেকে ১৭ অক্টোবর ভারতীয় মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (এমআই) একটি উচ্চপদস্থ দল বাংলাদেশ সফর করে। মেজর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে ওই দলটি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ১৬ নভেম্বর তারা লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুর ও নীলফামারীর মতো সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলো আকাশপথে পরিদর্শন করেন। তবে ভারতীয় দলটির সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সাক্ষাৎ করেননি বলে জানা গেছে। সফরকালে ভারতীয় দলটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে একটি 'ডজিয়র' বা নথি হস্তান্তর করে, যেখানে ভারতের নিরাপত্তা শঙ্কার তালিকা এবং চরমপন্থী কার্যক্রমে যুক্ত সন্দেহভাজন বাংলাদেশি নাগরিকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা আলোচনার পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গেও বাংলাদেশের সামরিক পর্যায়ের যোগাযোগ লক্ষ্য করা গেছে। ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঁচজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। একই দিনে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেন দেশটির হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ট্যাক্সিলার (এইচআইটি) চেয়ারম্যান লেফট্যানেন্ট জেনারেল শাকির উল্লাহ খট্টক। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের এই শীর্ষ কর্মকর্তা পূর্বে আইএসআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল (অ্যানালাইসিস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া, ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সামরিক যোগাযোগের এই ত্রিমুখী ঘটনাপ্রবাহ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
