কাশিমপুর কারাগার নাকি ‘মৃত্যুকূপ’ কাউন্সিলর মুরাদের মৃত্যু এবং প্রশ্নবিদ্ধ ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’-এর নেপথ্যে ভয়াবহ আলামত

১৯ নভেম্বর, ২০২৫ | ১০:০৪ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আবারও ভেসে এলো মৃত্যুর খবর। এবার সেই ‘লাশের মিছিলে’ যুক্ত হলো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেনের নাম। গত ১৬ মাসে (আগস্ট ২০২৪ – ডিসেম্বর ২০২৫) কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতাদের মৃত্যুর তালিকায় তিনি হলেন ৪৫তম সংযোজন। কারাবন্দী অবস্থায় এই একের পর এক মৃত্যু এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের গৎবাঁধা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র সাফাই—পুরো কারা ব্যবস্থাকে এক ‘গোপন বধ্যভূমি’ বা ‘ডেথ ট্র্যাপ’ হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। মুরাদ হোসেনের মৃত্যু কি শুধুই অসুস্থতা, নাকি এটি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ (Structural Murder)-এর অংশ? তথ্যানুসন্ধান ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে লোমহর্ষক সব অসঙ্গতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, মিরপুরের জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেন বর্তমান সরকারের দায়ের করা মামলায় বন্দী ছিলেন। গত ১৬ মাসে কারাগারে মারা যাওয়া অন্য নেতাদের মতোই তার পরিবারের অভিযোগ—কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে সুচিকিৎসা দেওয়া হয়নি। বিনা চিকিৎসায় তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটির পক্ষ থেকে এই মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আগস্ট ২০২৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত—এই ১৬ মাসে ৪৫ জন (মুরাদ হোসেনসহ ৪৬ জন) নেতার মৃত্যু একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করছে। কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে প্রায় সবার মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘হৃদরোগ’ বা ‘স্ট্রোক’। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে হঠাৎ ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ ‘হৃদরোগ’ হওয়া অত্যন্ত অস্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, কারাগারে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন অথবা খাবারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বিষাক্ত রাসায়নিক (Slow Poisoning) প্রয়োগ করা হলে তার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে হার্ট ফেইলিয়র বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ফরেনসিক তদন্তের অস্বচ্ছতা। আতার রহমান ‘অ্যাঙ্গুর’, আবদুল লতিফ বা শাহিদুল ইসলাম রতনের মতো নেতাদের মৃত্যুর পর পরিবার ‘বিষক্রিয়া’র অভিযোগ তুললেও কেন টক্সিকোলজি (Toxicology) পরীক্ষা করা হলো না? বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্সেনিক, থ্যালিয়াম বা নির্দিষ্ট কিছু কার্ডিয়াক ড্রাগ দীর্ঘদিন অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করলে তা ধীরে ধীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল করে দেয়, যা সাধারণ ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে না। চুল, নখ বা হাড়ের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ছাড়া এই মৃত্যুগুলোর প্রকৃত কারণ জানা অসম্ভব। এই পরীক্ষাগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা রিপোর্ট গায়েব করে দেওয়া প্রমাণ করে যে, নেপথ্যে বড় কোনো সত্য ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। শাহিদুল ইসলাম রতন, শাহাদাত আলম ঝুনু এবং সর্বশেষ মুরাদ হোসেনের ঘটনা প্রমাণ করে, কারাগারে চিকিৎসা অবহেলাকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জরুরি মুহূর্তে রোগীকে হাসপাতালে নিতে দেরি করা বা চিকিৎসার ‘গোল্ডেন আওয়ার’ নষ্ট করা পরোক্ষ হত্যার শামিল। সৈদুর রহমান সুজনের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হলেও, আদালতে তোলার ঠিক আগমুহূর্তে তার মৃত্যু এবং শরীরের আঘাতের চিহ্ন বিচারবহির্ভূত হত্যার দিকেই ইঙ্গিত করে। সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি বাংলাদেশের কারা কর্তৃপক্ষের চরম অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা ‘নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস’ এবং ‘ডাব্লিউএমএ মাল্টা ডিক্লারেশন’-এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটি কেবল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, বরং মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার এক ঘৃণ্য প্রয়াস। বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেনের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি গত ১৬ মাস ধরে চলা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক যোগসাজশ এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অস্বচ্ছতা দেশীয় তদন্ত ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখার সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। এমতাবস্থায়, মৃতদেহগুলো কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত (Exhumation) এবং আন্তর্জাতিক ল্যাবে টক্সিকোলজি পরীক্ষার দাবি জোরালো হচ্ছে। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের (ICRC) ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের অধীনে ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন’ গঠন করা না হলে—কারাগারের চার দেয়ালে এই মৃত্যুগুলো ‘রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে সংঘটিত ঠান্ডা মাথার অপরাধ’ হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। মুরাদ হোসেনের মতো আর কতজন নেতার লাশ বের হলে এই ‘মৃত্যুকূপের’ রহস্য উন্মোচিত হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।