নিয়োগই যদি অসাংবিধানিক হয়, রায়ের বৈধতা কোথায়? বিচারপতিদের স্থায়ী নিয়োগ: ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার নিয়ে আইনি প্রশ্ন ও বিতর্ক

১৬ নভেম্বর, ২০২৫ | ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

হাইকোর্ট বিভাগে ২২ জন অতিরিক্ত বিচারপতিকে এক বছরের মাথায় স্থায়ী নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন অঙ্গনে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দুজন বিচারপতির এখতিয়ার নিয়েও সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠেছে, যা বিচারাধীন মামলার ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলতে পারে। আইনজীবীদের একাংশ ল্যাটিন প্রবাদ "Coram non judice"-এর কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই প্রবাদটির অর্থ হলো, এমন কোনো বিচারক কর্তৃক রায় প্রদান করা, যার ওই বিষয়ে বিচার করার আইনগত এখতিয়ারই নেই। এ ধরনের রায় আইনগতভাবে শুরু থেকেই বাতিল (void ab initio) বলে গণ্য হয়। আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এক বছর আগে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া ২২ জন অতিরিক্ত বিচারপতির বিষয়টি। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। এই সময়কালে তাদের কর্মদক্ষতা সন্তোষজনক বিবেচিত হলে রাষ্ট্রপতি তাদের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি মাত্র এক বছর দায়িত্ব পালনের পরই এই ২২ জন অতিরিক্ত বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সমালোচকদের প্রশ্ন, কোন বিশেষ যোগ্যতা বা ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই স্থায়ী করা হলো? এই বিতর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেল। স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া ২২ বিচারপতির মধ্যে দুজন—বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার (চেয়ারম্যান) এবং বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ (সদস্য)—বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কর্মরত আছেন। এক বছর আগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিন পরই তাদের ট্রাইব্যুনালে নিযুক্ত করা হয়। আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এখানেই সাংবিধানিক ও আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৬ নম্বর ধারায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক হওয়ার জন্য যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তাতে ভাবে সংবিধানের ৯৪ ও ৯৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নিযুক্ত বিচারকদের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদগুলো সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বা স্থায়ী বিচারপতিদের বিষয়ে প্রযোজ্য। তাদের মতে, সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিযুক্ত "অতিরিক্ত বিচারপতি" পদের কোনো ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের বিচারক, বিশেষ করে চেয়ারম্যান পদে আসীন হতে পারেন না। এটি কেবল আইনের লঙ্ঘনই নয়, বরং অসাংবিধানিক। এই যুক্তিতে, বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার এবং বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ শুরু থেকেই আইনগতভাবে বৈধ ছিল না। সমালোচকরা আরও বলছেন, এখন তাদের স্থায়ী নিয়োগ দিলেও তা তাদের পূর্বের কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে পারে না। কারণ, যে সময়ে তারা ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন, তখন তাদের পদবি ছিল "অতিরিক্ত বিচারপতি", যা ট্রাইব্যুনাল আইনের শর্ত পূরণ করে না। এই আইনি বিতর্কের ফলে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায় এবং চলমান বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদি আদালত এই যুক্তি গ্রহণ করে যে তাদের নিয়োগ অসাংবিধানিক ছিল, তবে তাদের দেওয়া রায়গুলো "Coram non judice" নীতির আওতায় পড়ে যেতে পারে, যা বিচারিক ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের সংকট তৈরি করার আশঙ্কা রাখে।