রাজধানীতে ‘লকডাউন প্রতিরোধে’ জামায়াতের ভঙ্গুর উপস্থিতি, সাংগাঠনিক শক্তি কী নগরীতে নগণ্য?

১৫ নভেম্বর, ২০২৫ | ১০:২৫ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ঢাকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই দৃশ্যমান একটি বাস্তবতা—জামায়াতে ইসলামী রাজধানীর কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রভাব বিস্তারে বিশেষ জোর দিয়ে এসেছে। যাত্রাবাড়ী, রামপুরা ও উত্তরা—এই তিন এলাকায় গত এক দশকে সংগঠনের আর্থিকভাবে সক্ষম সদস্যদের ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসব এলাকায় নতুন মাদ্রাসা, দাওয়াহ সেন্টার ও সাংগঠনিক হাব গড়ে তোলা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় এই এলাকাগুলোতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের শক্তিশালী উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। সেসময় সারাদেশ থেকে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের লোকবল মাঠে নামিয়েছিল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সারাদেশের জনবলের বাইরে ঢাকার স্থানীয় শক্তিতে ‘লকডাউন প্রতিরোধে’ জনসমাগম করতে না পারা কিংবা ১১ই নভেম্বরে ঢাকা ও প্বার্শবর্তী জেলা নিয়ে গণভোটের দাবিতে সমাবেশে নগন্য উপস্থিতি নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, চব্বিশ সালের জুলাইয়ে মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি ও রাতভর প্রতিরোধ—সবকিছু মিলিয়ে জামায়াত রাজধানীর ওই বেষ্টনী অঞ্চলে একটি দৃশ্যমান শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বাইরের কর্মীরা ঢাকা ছেড়ে যাওয়ায় জামায়াত-শিবিরের সাংগাঠনিক অবস্থা শক্তিশালী অবস্থায় নেই। যা ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর আওয়ামী লীগ-জামায়াতে ইসলামী মাঠের লড়াইয়ে জামায়াতে ইসলামীর শোচনীয় পরাজয় ছিল দীর্ঘদিনের আলোচনায়। জুলাই থেকে নভেম্বর—সমাবেশে অংশগ্রহণে বড় পার্থক্য ২০২৫ সালে এসে চিত্র বদলে গেছে বলে মনে করছেন দলটির দীর্ঘদিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তার মতে, এ বছরের ১৯শে জুলাই জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত সমাবেশে ঢাকায় লাখো লোকের সমাগম হয়েছিল—যা সাম্প্রতিক সময়ে দলের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ১১ই নভেম্বর গণভোটের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে দশ হাজারের মতো লোক উপস্থিত হয়। যুব র‌্যালিতে জামায়াতের রাস্তা দখলের চেষ্টাকে ‘বাতাস ভরা চিপসের প্যাকেট’ আখ্যায় সামাজিক মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে সংবাদ-পর্যবেক্ষক ওই সাংবাদিকের মতে, “জুলাইয়ের তুলনায় নভেম্বরের সমাবেশে অংশগ্রহণ নাটকীয়ভাবে কমেছে। এটি সংগঠনের বর্তমান সক্ষমতা ও মাঠমোবিলাইজেশনক্ষমতার পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।” ঢাকা লকডাউন প্রতিরোধে মাঠে নেমে ভেঙে পড়া সাংগঠনিক কাঠামো ১৩ই নভেম্বর আওয়ামী লীগের ডাকা লকডাউন প্রতিরোধে জামায়াতে ইসলামী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মহাসমাবেশ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সমাবেশের আকার ও লোকসংখ্যা দেখে দলের ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থাই বেশি চোখে পড়ে। পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে— মোহাম্মদপুর মোড়ে ৪০–৫০ জন, শ্যামলী মোড়ে ২০–২৫ জন, উত্তরায় ১০০ জন, বাড্ডাতে ১০০ জনের উপস্থিতি ছিল জামায়াতে ইসলামীর মিছিল-সমাবেশে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, এত কম উপস্থিতি ঢাকা শহরের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জামায়াতের সাংগঠনিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। শুধু দুটি জায়গায় তুলনামূলক বড় মিছিল দেখা যায়— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডাকসু ভিপি সাদেক কায়েমের নেতৃত্বে ২৫০–৩০০ জন আর তারা সেখান থেকে যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ইনকিলাব মঞ্চের সাথে যৌথভাবে আওয়ামী লীগ কার্যালয় দখল ও অগ্নিসংযোগ ঘটাতে যায় তখন প্রায় ২০০-৩০০ নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল। এক সপ্তাহ আগেই মোটরসাইকেল শোডাউন—কিন্তু মাঠে ভিন্ন চিত্র এর বিপরীতে রাজনৈতিক মহলে আলোচিত আরেকটি বিষয় হলো—ঢাকা–৫ ও ঢাকা–৯ আসনের নির্বাচনী প্রচারণায় গত সপ্তাহে জামায়াতের সশস্ত্রাধিক মোটরসাইকেল শোডাউন, যা তাদের সাংগঠনিক শক্তির নতুন প্রদর্শনী হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু ১৩ই নভেম্বরের লকডাউন প্রতিরোধে যখন দলের প্রকৃত কর্মীসংখ্যা ও মাঠের উপস্থিতির পরীক্ষা হয়, তখন তা আশঙ্কাজনকভাবে কম দেখা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “প্রচারণার শোডাউনে যে শক্তি দেখা গেছে, তা মূলত প্রদর্শনীমূলক সংগঠনের শক্তি। বাইরে থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা অনেক কর্মী থাকে এসব নির্বাচনী শোডাউনে। তবে বাস্তব রাজনৈতিক ময়দানে সংগঠনের স্থায়ী মোবিলাইজেশন ক্ষমতা অনেক কমে গেছে।” রাজধানীতে জামায়াত দৃশ্যমান শক্তি সারাদেশ থেকে কর্মী নিয়ে আসার পরে নির্ভর করে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। এর বাইরে দলটি এখনও যাত্রাবাড়ী–রামপুরা–উত্তরা বেল্টে কিছু সামাজিক ও আর্থিক ভিত্তি ধরে রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক আন্দোলন-সমাবেশে উপস্থিতির ধারাবাহিক পতন এবং লকডাউনে ব্যর্থ মাঠ মোবিলাইজেশন—রাজধানীতে জামায়াতের অবস্থান আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়েছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আমিনুল হক বলেন, দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাংগঠনিক সমন্বয় দুর্বল, দীর্ঘদিনের নেতিবাচক চাপ এবং তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি। তিনি বলেন, “জামায়াতের ঢাকার সাংগঠনিক শক্তি এখন মূলত অনলাইন জোন, নির্বাচনী শোডাউন এবং ছাত্রসংগঠনের ছোট-বড় কিছু সেলভিত্তিক কার্যক্রমে সীমিত হয়ে পড়ছে।” এসব কারণে ঢাকায় জামায়াতের সরাসরি মাঠ-সংগঠন দ্রুত সংকুচিত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।