বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেভাবে উপহাসে পরিনত হলো
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কেনো দরকার হয় বা সাধারন বিচারিক আদালতের আদালতের সাথে এর পার্থক্য কী- এ থেকে আমরা কথা শুরু করতে পারি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ কী? মুলতঃ ৩টি- জেনোসাইড, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ। এ ছাড়া শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, আগ্রাসন এগুলোওকে আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। কেনো এগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ? কারন এসব অপরাধের গভীরতা এতো প্রবল যে ধরে নেয়া হয় কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীই শুধু নয়, এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এধরনের বিচারের আওতা, কার্যক্রম, কার্যপদ্ধতি সাধারন আদালতের চেয়ে অনেক বিস্তৃত ও গভীর হয়। বিচারের পরিকাঠামো, তদন্ত ও বিচারিক মানদন্ড অনেক উঁচু পর্যায়ের থাকতে হয়। আইসিটি কে গঠন করতে পারে?– যে রাষ্ট্রে অপরাধ সংগঠিত হয় বা যে রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী ভিক্টিম সেই রাষ্ট্র যদি সক্ষম হয় তাহলে সে নিজে আইসিটি গঠন করে বিচার করতে পারে। ভিক্টিম রাষ্ট্র সক্ষম না হলে নিরাপত্তার পরিষদের অনুমোদনক্রমে জাতিসংঘের তত্বাবধানে আইসিটি পরিচালিত হবার অনেকগুলো উদাহরন আছে। ১৯৯৮ সালে আইসিসি( ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) গঠিত হবার এই আদালত এখন দায়িত্বশীল। তবু ভিক্টিম রাষ্ট্রের নিজস্ব এখতিয়ার এখনো বলবৎ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আইসিটি এক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধের আইনী প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১০ সাল থেকে সেই আইনের ভিত্তিতেই আইসিটি-বিডি ‘৭১ এর অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৪ এর ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর সেই বিচার কার্যক্রম বস্তুত বন্ধ হয়ে যায়। আইসিটি-বিডির প্রসিকিউটরগণ পদত্যাগ করেন বা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফাঁসীর দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহার সহ অভিযুক্ত অনেকেই মুক্তি পেয়ে যায়। যে ট্রাইব্যুনালে ‘৭১ এর অপরাধীদের বিচার চলছিলো সেই ট্রাইব্যুনালেই ‘২৪ এর জুলাই আগষ্টে সংগঠিত প্রাণহানীগুলোর বিচারের আয়োজন শুরু হয়। আমরা এই পর্যায়ে বুঝার চেষ্টা করবো- ২০২৪ এর ঘটনাগুলো আদৌ কি আন্তর্জাতিক অপরাধ? আগেই বলেছি- এরকম ট্রাইব্যুনালে মুলতঃ জেনোসাইড, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হয়। ‘২৪ এর জুলাইয়ে কি জেনোসাইড ঘটেছে? স্পষ্ট উত্তর- না। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্রনীত জেনোসাইড কনভেনশনে সংজ্ঞা দেয়া আছে- কোন জনগোষ্ঠীর জাতি(National/গোত্র(Race)/ নৃতাত্বিক( Anthropological)/ ধর্মীয়( Religious) পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে(Intent to destroy) যদি সুপরিকল্পিত ভাবে অপরাধ সংগঠিত করা হয় তাহলে এই অপরাধটি জেনোসাইড। ‘২৪ যারা ভিক্টিম তারা উল্লেখিত চারটি গ্রুপের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরও এরকম গ্রুপ টার্গেট করে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্য প্রমান করা সম্ভব নয়। সুতরাং এটি কোন জেনোসাইড নয়। ইউনুসের পোষ্য বুদ্ধিজীবিরা অনেকেই শুরু থেকে জেনোসাইড বলে প্রচার করা শুরু করেছিল। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের বর্তমান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামও এক পর্যায়ে স্বীকার করেছেন- এখানে জেনোসাইড ঘটেনি। ‘২৪ এ কি যুদ্ধাপরাধ(War Crime) সংগঠিত হয়েছে? স্পষ্ট উত্তর না। যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয় যুদ্ধরত দুটি পক্ষের মধ্যে। যেমন আত্মসমর্পণের পরও যদি হত্যা করা হয়, যুদ্ধকালীন সময়ে যদি বেসামরিক নাগরিককে উদ্দেশ্যমুলকভাবে হত্যা করা হয়, জেনেভা কনভেশন লঙ্ঘন করা হয়- ইত্যাদি। বাকী থাকলো শুধু- ক্রাইমন্স এগেইন্সট হিউম্যানিটিজ বা মানবতা বিরোধী অপরাধ। এই অপরাধের সংজ্ঞা, জেনোসাইড বা যুদ্ধাপরাধের চেয়ে কিছুটা অস্পষ্ট। এই অস্পষ্টতার সুযোগ নিতে চেয়েছে ইউনুস গং। একটি তথ্য ইন্টারেস্টিং- সেই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কোন ট্রায়ালে শুধু মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার হয়নি। সাথে যুদ্ধাপরাধ ছিলো, বা জেনোসাইড ছিলো। বাংলাদেশের বর্তমান ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও আওয়মী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সহ গুরুত্বপুর্ন সাংবাদিক বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচারের আয়োজন করছে। আসুন দেখি মানবতা বিরোধী অপরাধ কী? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) রোম সংবিধির ধারা ৭ অনুযায়ী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ গণ্য হবে তখনই, যদিএটি কোনো বিস্তৃত বা পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ যা নিরস্ত্র বেসামরিক জনগোষ্ঠী (সিভিলিয়ান) এর বিরুদ্ধে পরিচালিত। আক্রমনকারী অবগত তার কর্মকান্ড বিষয়ে। এতে খুন, নির্যাতন, জোরপূর্বক নিখোঁজ করা, কারাবন্দি করা, যৌন সহিংসতা, নিপীড়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত থাকে। এখানে একটি প্রশ্ন আমি উত্থাপন করতে চাই। জুলাই যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে এক দফা তথা সরকার পতনে আন্দোলনে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা কি নিরস্ত্র বেসামরিক জনগোষ্ঠী ছিলেন? প্রথম নিহতের ঘটনা ঘটে ১৬ জুলাই। সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরে ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকায় নিহত হন আন্দোলন বিরোধী ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী এবং একজন হকার। চট্টগ্রামে ছাত্রদল কর্মী ওয়াসিম, রংপুরে আবু সাইদ। ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী কে কারা হত্যা করলো?- নিরস্ত্র বেসামরিক জনগন? ১৯ ও ২০ জুলাই ঢাকায় হত্যা করা হয় তিনজন পুলিশকে। এরা কেউ আন্দোলন প্রতিহতের দায়িত্ব পালনে ছিলেন না। পুলিশ পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ছুটিতে ছিলেন বাসায়, সন্ধ্যার পর সাধারন পোষাকে বাসার নীচে চা খেতে গেলে তাঁকে হত্যা করা হয়। পুলিশ সদস্য গিয়াস অফিসে যাওয়ার পথে নিহত হন, তিনিও সাধারন পোষাকে ছিলেন। সাধারন পোষাক পরিহিত এএসআই মোক্তাদিরকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় ওভারব্রীজে। এগুলো তো টার্গেট কিলিং। নিরস্ত্র পুলিশকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। নিরস্ত্র সিভিলিয়ানের কাজ এটা? ৪ আগষ্ট এনায়েতপুর থানায় আগুন দিয়ে হত্যা করা হলো ১৫ জন পুলিশ, এরা কিন্তু আন্দোলন দমানোর কাজে ছিলেন না। নিজেদের কার্যালয়ে ছিলেন। থানায় আগুন দিয়ে ১৫ জন পুলিশ হত্যা কি নিরস্ত্র সিভিলিয়ানের কাজ? ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ি পুলিশ স্টেশন ও উড়ালসেতুর টোলপ্লাজায় আগুন, ১৮ জুলাই রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি ও বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে আগুন। ঐদিনই নারায়নগঞ্জে পাসপোর্ট অফিস সহ ১৩টি সরকারী কার্যালয়ে আগুন দিয়ে ধ্বংস, ১৯ জুলাই নরসিংদী কারাগার আক্রমন করে অস্ত্র লুট ও জঙ্গীদের মুক্ত করা, ঐদিনই ঢাকায় মেট্রোরেল সহ গুরুত্বস্থাপনায় আগুন- এগুলো কি নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের কাজ? সুতরাং মানবতা বিরোধী অপরাধ চিহ্নিত হবার জন্য যে civilian population এর বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের কথা বলা হয়েছে তা দৃশ্যতঃ প্রমানিত নয়। পরবর্তীতে ঐ আন্দোলনের গুরুত্বপুর্ণ অনেকের মুখে আমরা শুনেছি তারা সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যেমন উপদেষ্টা আসিফ, নাহিদ এরা এরকম বলেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য যাদের প্রস্তুতি থাকে তারা তো কোন ভাবেই নিরস্ত্র সিভিলিয়ান নয় বরং সশস্ত্র সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। এবার আসি দ্বিতীয় আলাপে। ট্রাইব্যুনালে এই বিচারের আয়োজন কারা করছেন। ডঃ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার। একটি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করার ব্যবস্থা তারা করেছেন, তাদের নিজেদের আইনী/ সাংবিধানিক অস্তিত্বই তো প্রশ্নবিদ্ধ। চীফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কাকে? তাজুল ইসলাম। তাজুল ইসলাম ছিলো এবি পার্টির যুগ্ম মহাসচিব। এ ছাড়া দীর্ঘদিন তিনি একই ট্রাইব্যুনালে ‘৭১ এর অপরাধী জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় তিনি বারবার এই ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এখন সেই তাজুল ইসলামই ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর। এটি কি সাংঘর্ষিক নয়? জেলা জজ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত লোকজনকে তুলে এনে আপিল বিভাগের মর্যাদাপ্রাপ্ত বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালের বিচারক করা হয়েছে। শফিউল আলম মাহমুদ নামের জাতীয়তাবাদী আইনজীবি ফোরামের একজন এডভোকেট, তাকেও বিচারক বানিয়ে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার এই সময়ের মধ্যে চারবার অধ্যাদেশ জারী করে ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী এনেছে। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় কমিয়েছে, গ্রেপ্তারের ক্ষমতা সহ প্রসিকিউটরদের ক্ষমতয়া বাড়িয়েছে এবং সংগঠনের বিচার করার ক্ষমতাও প্রদান করেছে। প্রশ্ন হলো- অধ্যাদেশ বিষয়টিই তো প্রশ্নসাপেক্ষ। পরবর্তী জাতীয় সংসদ যদি অধ্যাদেশ অনুমোদন না করে তাহলে এই অধ্যাদেশগুলো বৈধতা পাবেনা। সে ক্ষেত্রে এইসব অধ্যাদেশ বিচারের ক্ষেত্রে যে প্রভাব ফেলবে তার কী হবে? তৃতীয় আলাপটি গুরুত্বপুর্ণ। চীফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছিলেন- “আগামী নির্বাচিত সরকার আওয়ামী লীগের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এগোবে কিনা, সেই অনিশ্চয়তার কারনে বিচারকাজে তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে । ফলে যতটা নিখুঁতভাবে এ কাজ করার প্রয়োজন ছিল, তা সম্ভব হচ্ছে না”। এটি খুব ভয়ংকর কথা। জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়ড এই কথা যেমন সত্য তেমনি সত্য আরেকটি কথা- জাস্টিস হারিড, জাস্টিড ব্যুরিড। বিচারের ক্ষেত্রে যেমন দেরী করা যাবে না তেমনি বিচারের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। জাস্টিস মাস্ট বি জাস্ট। তাড়াহুড়ো করা মানেই আপনি ন্যায় বিচার করছেন না। আমরা অপরাপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের উদাহরন যদি দেখি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ও টোকিও ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছিল ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে। এই দুটি ছিল মুলতঃ মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তী যেসব আইসিটি হয়েছে- যেমন আইসিটিওয়াই- যুগোশ্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল সমাপ্ত করতে লেগেছে ২৪ বছর( ১৯৯৩- ২০১৭), আইসিটিআর- রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল সম্পন্ন করতে লেগেছে ২১ বছর(১৯৯৪- ২০১৫), সিয়েরালিওনে ১১ বছর( ২০০২-২০১৩), কম্বোডিয়ায় ২০০৪ সালে শুরু হয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়নি। আমাদের আইসিটি-বিডিতে ‘৭১ এর অপরাধীদের বিচার চলছে ২০১০ সাল থেকে। জাতিসংঘ, আইসিসির তত্বাবধানে সংগঠিত ট্রাইব্যুনালগুলোই কাজ করছে এক যুগ, দুই যুগ ধরে সেখানে ইউনুস, তাজুলদের ট্রাইব্যুনাল এক বছরের আগেই বিচার সম্পন্ন করে ফেললো? হাতে যাদু আছে নাকি? নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে যে বিচার ডমেস্টিক আদালতে হতে পারে সেটাকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া, পক্ষপাতভুক্ত অযোগ্য ব্যক্তিদের বিচারক ও চীফ প্রসিকিউটর বানানো, একাধিক অধ্যাদেশ জারী করা, অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া করা- এগুলো প্রমান করে যে বিচার নয়, বিচারের নামে প্রহসন চলছে। প্রহসনের উদ্দেশ্য বহুমুখী। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক অপরাধের দন্ডে দন্ডিত করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা গেলো পাশাপাশি ‘৭১ এর অপরাধীদের বিচারের প্রতিশোধ নেয়া গেলো এবং একই সাথে ‘৭১ এর অপরাধকে স্বাভাবিকীকরন করা হলো। একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করা দরকার। জুলাই এবং পরবর্তী সময়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন- আন্দোলনকারী, আন্দোলনের বিপক্ষে, আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্য প্রত্যেকে বাংলাদেশের নাগরিক। এই হত্যাকান্ডগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করার আইনী, সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা রয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে পুরো ব্যাপারটিকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে দেখতে হবে। একটি হচ্ছে ১৬ জুলাই থেকে ৪আগস্ট- মোট ২০ দিন। ১৬ জুলাই প্রথম প্রাণহানী ঘটলো, ৪ আগস্ট শেখ হাসিনা শাসনের শেষ দিন। ৫ আগস্ট দুপুরের আগে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন, এদিন এসময়ের মধ্যে কোন ঘটনা ঘটেনি। তিনি দেশত্যাগের পর সেনাপ্রধান সবকিছুর দায়িত্ব নেয়ার ঘোষনা দিলেন, ৮ আগষ্ট ডঃ ইউনুস তাঁর উপদেষ্টাগণ সহ দায়িত্ব গ্রহন করলেন। তাহলে দ্বিতীয় টাইম লাইন হচ্ছে ৫ আগস্ট সহ পরবর্তী দিনগুলো। শেখ হাসিনার ২০ দিনে কী কী নাশকতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়েছে সেগুলো আমরা আগে আলাপ করেছি। এর মধ্যে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী রয়েছেন। শুধু ৪ আগষ্টেই আওয়ামী লীগের ১৯ জন কর্মী, ১ জন সাংবাদিক, ১৪ জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। যেহেতু তখনো শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্বে, জনগনের জীবন রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব- আমরা ধরে নিলাম এই ২০ দিনের সমস্ত হত্যাকান্ডের দায় তাঁর। এখন প্রশ্ন হলো- শেখ হাসিনার থাকার সময়ের নিহত কতো জন আর না থাকা সময়ের নিহত কতোজন? থাকার সময়ের দায় যদি তাঁর হয়, না থাকার সময়ের দায় তো অন্য কারো? জুলাই আগস্ট যারা ঘটিয়েছেন তাদের প্রানান্ত চেষ্টা ছিলো- নিহতের সংখ্যা ২ হাজার প্রতিষ্ঠা করা। এটি হয়নি শেষ পর্যন্ত। জাতিসংঘ প্রতিবেদন জানাচ্ছে- ১ লা জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা ১৪০০ জনের মত। জাতিসংঘ বলেনি এর মধ্যে ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কতোজন? কিছুদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে যে জুলাই ঘোষনাপত্র দেয়া হলো সেখানে সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার। সরকারী ওয়েবসাইটে জুলাই শহীদ ৮৪৪। কিন্তু কেউই পরিস্কার করেনি ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী দিনগুলোতে নিহতের সংখ্যা কতো? আমরা দেখেছি শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর যাত্রাবাড়ি, আশুলিয়া, বাড্ডা থানায়- এনায়েতপুর স্টাইলে ঘিরে ফেলা হয়েছে, আগুন লাগানো হয়েছে। সেনাপ্রধান সকলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কিন্তু অবরুদ্ধ পুলিশদের উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা তিনি নেননি। বরং একটি ভিডিওতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়িতে থানার সামনে থেকে সেনাবাহিনীকে সরে গেছে। পুলিশকে যখন হত্যার উদ্দেশ্যে ঘেরাও করা হয়েছে তখন পুলিশ গুলী ছুঁড়েছে এসব জায়গায়। প্রতিটি জায়গায় পুলিশ নিহত হয়েছে, পুলিশের গুলীতে বিক্ষোভকারীরাও নিহত হয়েছে। এভাবে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। ৫ তারিখ বিকেলের দায় শেখ হাসিনার নয়। হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গ থানায় অবরুদ্ধ পুলিশদের মধ্যে থেকে এএসআই সন্তোষ চৌধুরীকে সেনাবাহিনী উন্মত্ত ঘেরাওকারীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ১৬ আগষ্ট জাতিসংঘের একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো- ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট এই ২০ দিনে নিহতের সংখ্যা ৪০০ আর ৫ ও ৬ আগস্ট দুইদিনে নিহতের সংখ্যা ২৫০। ১৮ আগস্ট হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি( এইচআরএসএস) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী- ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত নিহত ৩১১ জন, আর ৪ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত নিহত ৫০৮ জন। ১২ আগস্ট প্রথম আলোর সংবাদ ছিলো- মোট ণিহত ৫৮০। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট ২১৭ জন এবং ৪ থেকে ১১ আগষ্টের মধ্যে নিহত ৩৬৩ জন। সুতরাং নিহতের সংখ্যা এভাবে দেখতে হবে। সুপ্রীম রেসপন্সিবিলিটি হিসেবে যদি শেখ হাসিনা দায়বদ্ধ হন তাঁর সময়ের পর, ৫ আগষ্ট থেকে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তারাও দায়বদ্ধ হবেন তাদের সময়ের জন্য। ৫আগস্ট থেকে সারা দেশে যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, এখনো যা চলমান তার আরেকটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ রয়েছে। শুধু যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা নয়। ৪৫০ এর অধিক থানা ও পুলিশ স্টেশন লুট করে ছয় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লক্ষ রাউন্ড গুলী লুট করা হয়েছে তাও আমরা জানি। কিন্তু একই সাথে সারা দেশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙ্গালীর ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত ভাস্কর্য, ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ২০ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী দুই সপ্তাহে সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, রিলিফ ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও উপড়ে ফেলা হয়। ৫ তারিখ বিকেলে বঙ্গবন্ধু বাড়ি ধানমণ্ডিতে ৩২ এ যেমন আগুন দেয়া হয় তেমনি লুট হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত স্বাধীনতা জাদুঘর, আক্রান্ত হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণগ্রন্থাগারে। দেশের ২২টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ তারিখ বিকেল থেকে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা শুরু হয়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫ আগস্ট থেকে দু সপ্তাহে দেশে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে ১০৬৮টি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রিপোর্টে দাবী করা হয়েছে- ৪ আগস্ট ২০ আগস্ট পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার ঘটনা ২ হাজার ১০টি, নিহত হয়েছেন ৯ জন। যথারীতি প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর বাচাল প্রেসসচিব এগুলো ডিনাই করেছেন। বলেছেন হত্যাকান্ডগুলো ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। যেনো রাজনৈতিক হলেই হত্যাকাণ্ড বৈধ হয়ে যায়। বাংলায় ইসলাম প্রচারের ৮০০ বছরে যা কখনো ঘটেনি, ৫ আগষ্টে পর তা ঘটেছে। সারা দেশে প্রায় শ খানেক মাজার, দরগা, খানকা শরিফ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ওরস। বাউলের আখড়া। অর্থ্যাৎ শুধু অমুসলিমদের নয়, মুসলমানদের মধ্যেও যারা ভিন্ন তরিকার- তাঁদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার, তাঁদের স্বাভাবিক জীবন যাপন বদলে দেয়ার সহিংস চেষ্টা হয়েছে যা এখনো বিদ্যমান। এই যে কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধমুলক কর্মকান্ড- সেটি নিজে কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। এই অপরাধের নাম হচ্ছে জেনোসাইড। আমরা শুরুতে এটির কথা বলেছি। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ গৃহীত কনভেনশনে এই অপরাধের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। অনেক মানুষ মেরে ফেলতে হয় না, আপনি যদি এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরী করেন যেখানে একটি জাতি তার পরিচয় হারিয়ে ফেলে বা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় তার ধর্ম পালনে বাধাগ্রস্ত হয় তাহলেও সেটি জেনোসাইড। জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, পাঠাগার ধ্বংস করা জেনোসাইডাল ক্রাইম। কাউকে তার ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য আক্রমন করা জেনোসাইডাল ক্রাইম। মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া, মাজার ভেঙ্গে ফেলা- জেনোসাইডাল ক্রাইম। নিশ্চয় কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। বিশ্বজুড়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জেনোসাইড প্রতিরোধে কাজ করে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এন্ড হিউম্যান সিকিউরিটি। ৫ আগস্ট থেকে চলমান বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে ২৪ সেপ্টেম্বর তারা এক বিবৃতি প্রকাশ করে সতর্কতা জারী করে যে এখানে জেনোসাইডাল প্রবণতা ফুটে উঠছে। আমি সেই বিবৃতি থেকে সুনির্দিষ্টভাবে একটি লাইন কোট করছি- “some actions of members of the interim government, as well as mobs aligned with their anti-Liberation War ideology, show ominous signs of genocidal intent towards the Awami League, towards Hindu Bangladeshis, and towards other religious minorities.” এটি থামেনি। এটি চলমান। ডঃ ইউনুস ও তার সহচরগণ জেনোসাইডের মত একটি আন্তর্জাতিক অপরাধে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন নিশ্চিত ভাবেই। এর পাশাপাশি আরেকটি অপরাধের দায় গ্রহন করতে হবে ডঃ ইউনুস ও তার উপদেষ্টা পরিষদকে। ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সকল ঘটনার জন্য তারা দায়মুক্তি প্রদান করেছেন। অর্থ্যাৎ এই সময়ে আন্দোলনকারীরা যতো হত্যা, নাশকতা, লুট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছেন সে জন্য কোন মামলা করা যাবেনা। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী যে ৪৪ জন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার বিচার দাবী করতে পারবেনা, যে পরিমান ব্যক্তি সম্পত্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হয়েছে সেসবের কোন প্রতিকার চাওয়া যাবে না। যতো সংখ্যকই হোক- এই নিহত মানুষেরা এখানে হানাদার নয়, তাঁরা এই সমাজেরই মানুষ। তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক, তাঁদের পরিবার আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। অবশ্যই তাঁদেরও অধিকার রয়েছে বিচার পাওয়ার। এই যে বিচারহীনতার নিশ্চয়তা দেয়া এটি নিজে একটি অপরাধ। স্বাভাবিক সময়ে যারা নিজে গুরুতর অপরাধের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে, শাস্তি পাবে- তারা যখন বিচারের আয়োজক হয়ে যায় তখন ন্যায় বিচারের কিছু থাকেনা। সামগ্রিক বিষয়টি হাস্যকর উপহাসে পরিনত হয়। ইউনুস দঙ্গল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত(আইসিটি-বিডি)কে নামে একটি উপহাসে পরিনত করেছে । দীপু আহকাম ‘বাংলাদেশ ২.০’ ১০১ দিন, গ্রন্থের লেখক। মেলবোর্ণ, অস্ট্রেলিয়া
