চট্টগ্রাম-ফতুল্লা পাইপলাইন: মাঝপথে উধাও ৪ লাখ লিটার ডিজেল, যমুনার হিসাবে ঘাপলা নাকি কারসাজি?

১৫ নভেম্বর, ২০২৫ | ১০:১৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি আবারও তেল চুরির অভিযোগে আলোচনায় এসেছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ডিপো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপোতে প্রতিষ্ঠানটি মোট ২ কোটি ৫৩ লাখ ৮ হাজার ৬৩ লিটার ডিজেল পাঠায়। তবে পথে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৮ লিটার ডিজেল কম পাওয়া যায়। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি পরিবহন হওয়া সত্ত্বেও এই ঘাটতি দেখা দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে এবং সমালোচনার ঝড় বইছে। এর মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার ডিজেল পাইপলাইনে প্যাকিং হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু বাকি ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৪ লিটার ডিজেলের কোনো হিসাবই এখনো মেলানো যায়নি। ঘটনা নিয়ে যমুনা অয়েল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ আলাদা তিনটি কমিটি গঠন করেছে। যমুনা অয়েলের অভ্যন্তরীণ কমিটি এক মাস পর প্রতিবেদন জমা দিলেও বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের কমিটি এখনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি, যদিও তাদের নির্ধারিত সময়সীমা এক মাস আগে শেষ হয়ে গেছে। কেন ডিজিটাল মনিটরিং থাকা সত্ত্বেও পাইপলাইনে এত তেল কম পড়ল— তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যমুনা অয়েলের অভ্যন্তরীণ কমিটি প্রতিবেদনে ৬ হাজার লিটারের মতো ডিজেল ঘাটতির কথা জানিয়েছে। তবে এক অভিযোগের তদন্তে একাধিক কমিটি হওয়ায় প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে এবং তদন্তের ফলাফল একে অপরের সঙ্গে না মিললে পুরো বিষয়টিই বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে। তিনি দাবি করেন, তেল কোথাও হারায়নি, রিসিভিং টার্মিনালের সিলগালা করা ট্যাংকেই আছে। তার মতে, ট্যাংকের ক্যালিব্রেশন রিপোর্টে ভুল উপস্থাপন করা হয়েছে, এবং এটি ভবিষ্যতে তেল গায়েব করারও উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ কাজ এখনো শেষ হয়নি, পরীক্ষামূলকভাবে তেল পরিবহন চলছে। তাই গণমাধ্যমে যমুনা অয়েলের বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ যেভাবে উঠে এসেছে, তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার দাবি, কোনো তেল হারায়নি, সবই ট্যাংকের ভেতরে রয়েছে। অভিযোগ ওঠায় মন্ত্রণালয় এবং বিপিসি উভয়েই তদন্ত কমিটি করেছে, তবে তারা এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। তিনি বলেন, তারা হয়তো সময় নিচ্ছে, কিন্তু পুরো বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। ট্যাংকের ক্যালিব্রেশন ডিজিটাল নাকি সনাতন পদ্ধতিতে হয়েছে— সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেননি তিনি। তিনি আরও জানান, বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধিদের সব প্রযুক্তি না থাকায় তারা তৃতীয় পক্ষের সার্ভেয়ারের সহায়তা নিয়েছিল। সার্ভেয়ারের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কি না— সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ঘটনার শুরু হয় চলতি বছরের জুলাইয়ে। তখন পতেঙ্গা ডিপো থেকে কুমিল্লা ও ফতুল্লা ডিপোতে ১ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৫ লিটার ডিজেল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু রিসিভিং ট্যাংক ক্যালিব্রেশন করে পাওয়া যায় ১ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১৩ লিটার— অর্থাৎ ঘাটতি ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯২ লিটার। এরপরের এক চালানে ৪০ লাখ ৮৬২ লিটার পাঠানো হলেও ফতুল্লা ডিপোতে পাওয়া যায় ৪০ লাখ ৬ হাজার ৭৫০ লিটার, যা নির্ধারিতের চেয়ে ৫ হাজার ৮৮৮ লিটার বেশি। দুই চালানের হিসাবে দাঁড়ায়, ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার ডিজেল পাইপলাইনে প্যাকিং হিসেবে রয়ে গেছে, এবং এর মূল্য প্রকল্প থেকে যমুনাকে পরিশোধ করার সুপারিশও করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে আবার ১ কোটি ৮ লাখ ১৫ হাজার ৬০৮ লিটার ডিজেল পাঠানো হলে ফতুল্লা ডিপোতে রিসিভিং ট্যাংক ক্যালিব্রেশন করে দেখা যায় ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৪ লিটার কম রয়েছে। একটি চালানে বেশি এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্য চালানে কম পাওয়া যাওয়ায় পুরো বিপিসিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর দ্রুত তদন্ত শুরু করে বিভিন্ন কমিটি। ২৮শে সেপ্টেম্বর যমুনা অয়েল ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকের রি-ক্যালিব্রেশনের জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি করে। কমিটির একজন সদস্য জানান, তারা শুধু টেকনিক্যাল রি-ক্যালিব্রেশন করেছেন এবং প্রথম ক্যালিব্রেশনে বেশ কিছু বিচ্যুতি পেয়েছেন, যা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তেল কমে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ৩০শে সেপ্টেম্বর যমুনা অয়েল অভ্যন্তরীণ তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা প্রায় ২৫ দিন পর রিপোর্ট দেয়। যমুনা অয়েলের জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) মাসুদুল হক জানান, প্রতিবেদনে ৭ হাজার ৭৭১ লিটার ডিজেল ঘাটতির কথা উঠে এসেছে এবং প্রথম ক্যালিব্রেশনে ভুল ছিল বলে উল্লেখ করেছেন তারা। তার মতে, ক্যালিব্রেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া উচিত। অন্যদিকে, ২রা অক্টোবর বিপিসি পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে, যার মেয়াদ ছিল ১০ দিন। আজ পর্যন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জাহিদ হোসাইন জানান, প্রতিবেদন প্রায় প্রস্তুত, দু–এক দিনের মধ্যেই জমা দেওয়া হবে। তবে তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। ৬ই অক্টোবর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগও বুয়েটের একজন অধ্যাপককে নিয়ে পাঁচ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে। অতিরিক্ত সচিব আবদুল মান্নান বলেন, তারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন এবং অচিরেই প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন, তবে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চান না। দেশে বছরে গড়ে ৬৫–৬৭ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে, যার ৭৫ শতাংশই ডিজেল। ঢাকায় ব্যবহৃত হয় মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। এত বিশাল পরিমাণ জ্বালানি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনার ক্ষেত্রে আগে নদীপথ ও সড়কপথে শতাধিক জাহাজ ও অসংখ্য ট্যাংকার ব্যবহৃত হতো, যা ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। খরচ ও ভোগান্তি কমাতে শেখ হাসিনার সরকার ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত অত্যাধুনিক পাইপলাইন নির্মাণ করে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় বিপিসির ২৩৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ার কথা। অথচ বর্তমান ইউনূস সরকারের দায়িত্বশীলদের গাফিলতিতে সাশ্রয় দূরে থাক, উল্টো রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা লোপাটের দ্বার খুলেছে, এমনটাই মনে করছেন সাধারণ মানুষ।