দিল্লিতে দোভালের সঙ্গে খলিলুরের বৈঠক: আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নানা উদ্বেগের মধ্যেই নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। ১৯ ও ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের সপ্তম বৈঠকের সাইডলাইনে এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠক এমন এক সময়ে হতে চলেছে যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের নিজস্ব কিছু উদ্বেগ রয়েছে। বৈঠকের প্রেক্ষাপট ও ভারতের উদ্বেগ: অজিত দোভালের আমন্ত্রণেই খলিলুর রহমান দিল্লি সফর করছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে নতুন সরকারের এটিই হতে চলেছে অন্যতম শীর্ষ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক। ভারতীয় নিরাপত্তা মহল এই সুযোগে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার পাশাপাশি নিজেদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ তুলে ধরবে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের প্রধান উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে সম্প্রতি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ঘন ঘন ঢাকা সফর। নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ এবং জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার মতো ব্যক্তিদের ঢাকা সফরকে নয়াদিল্লি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে দোভাল খলিলুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। আলোচনার কেন্দ্রে খলিলুর রহমানের ভূমিকা: নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর খলিলুর রহমান বিভিন্ন কারণে আলোচিত হয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ তৈরির প্রস্তাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সরাসরি সংঘাত তৈরি হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং খলিলুর রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এছাড়াও, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (RSO) মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে রাখাইনে পাঠাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে তার ‘ছায়া ভূমিকা’ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তার এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলোও ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নজরে রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচনের অনিশ্চয়তা: মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হলেও জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য কিছু দল অনাগ্রহী। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি পশ্চিমা ও ভারতীয় গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার সরকারের পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করা থেকে বিরত থাকছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার জন্য একটি ‘দর-কষাকষি’র কৌশল হতে পারে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে, বিএনপি এখন আর এ বিষয়ে আগের মতো কঠোর অবস্থানে নেই। ভারতের অবস্থান ও বৈঠকের তাৎপর্য: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব কমে যাওয়া নিয়ে ভারত কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে। তবে নয়াদিল্লি বরাবরই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এই পরিস্থিতিতে খলিলুর রহমান ও অজিত দোভালের বৈঠকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৈঠকের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের নতুন নিরাপত্তা উপদেষ্টার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে এবং নিজেদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো সরাসরি তুলে ধরবে। যদিও দুজনের মধ্যে একান্ত বৈঠক হবে কি না তা এখনও নিশ্চিত নয়, তবে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের এই পার্শ্ববৈঠক দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ এবং কৌশলগত বোঝাপড়া তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
