জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেতরে ‘আয়নাঘর’ বানিয়ে নির্যাতন: স্বীকারোক্তি ভুক্তভোগী জুলাইযোদ্ধার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র (বৈছা) আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত জুলাইযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমকে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে জুলাই ফাউন্ডেশনের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ফাউন্ডেশনের অফিসে ‘আয়নাঘর’ নামে একটি অন্ধকার কক্ষ তৈরি করে আহতদের মারধর করা হতো এবং তাদের নামে বরাদ্দকৃত অনুদানের টাকা তুলে নিতো ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। জাহাঙ্গীরের এমন ভয়াবহ স্বীকারোক্তি জুলাই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার আড়ালে এক সুগভীর চক্রান্ত ও নোংরা উদ্দেশ্য উন্মোচিত হলো। মামলার অভিযোগ অনুসারে, গত বছরের ১৮ই জুলাই রাজধানীর কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন জাহাঙ্গীর আলম। পরে জুলাই ফাউন্ডেশন গঠিত হলে চলতি বছরের ২৭শে মে দুপুরে অনুদানের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ফাউন্ডেশনের অফিসে যান জাহাঙ্গীর। সেখানে আসামিরা তাকে একটি অন্ধকার কক্ষে নিয়ে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। জিআই পাইপ দিয়ে মাথায় আঘাত করায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে আবার মারধর চালিয়ে তারা তাকে ‘ভুয়া জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকারোক্তির জন্য চাপ দেন। মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তার ফেসবুক পোস্ট ও ছবি দেখে গণধোলাই দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিএনপি নেতার সঙ্গে তার ছবি দেখে তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা কী?’ পরে তার ডান হাতে জোর করে ইনজেকশন পুশ করা হয় এবং অচেতন অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসিবুজ্জামানের আদালতে জাহাঙ্গীর নিজেই বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মামলাটি শাহবাগ থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী সওদাগর এ্যানি এবং তাহমিনা আক্তার লিজা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলার আসামিরা হলেন: জুলাই ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ভেরিফিকেশন অফিসার ইফতেখার হোসেন, কর্মকর্তা সাগর, মেহেদী হাসান প্রিন্স, আফজালুর রহমান সায়েম, সাইদুর রহমান শাহিদ, ফাতেমা আফরিন পায়েল, রেজা তানভীর, আলিফ, জাহিদ এবং এক্সিকিউটিভ মেম্বার সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী। মামলার অন্যতম আসামী শ্রাবন্তী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নীতি-আদর্শ নিয়ে কথা বলা এবং অসততার বিরুদ্ধে প্রতিবাদীকারি হিসাবে বেশ পরিচিত মুখ। সম্প্রতি তিনি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে থুতু দিতে চেয়েছিলেন কারণ সাকিব শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এই ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয়। জাহাঙ্গীরের অভিযোগে বলা হয়েছে, ফাউন্ডেশনের সদস্যরা জুলাইয়ের আহতদের নামে বরাদ্দকৃত টাকা তুলে নিয়ে নয়ছয়ে জড়িত। বিভিন্ন সময়ে আহতদের নির্যাতনের জন্য ‘আয়নাঘর’ তৈরি করা হয়েছিল। এই মামলা জুলাই ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগের ধারাবাহিকতা। গত অক্টোবরে বৈছা কর্মী বুলবুল শিকদার ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ‘ভুয়া যোদ্ধা’ যাচাইয়ের নামে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফাউন্ডেশনের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেখানেও জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারধর, মোবাইল ছিনতাই এবং মিথ্যা স্বীকারোক্তির চাপের অভিযোগ উঠে। আদালত সেই মামলায় সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। ফাউন্ডেশনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এসব অভিযোগকে ‘ভাবমূর্তি নষ্টের অপচেষ্টা’ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু নির্যাতনের অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। জুলাই ফাউন্ডেশন ২০২৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর গঠিত হয়। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এটি আহত-নিহতদের পরিবারের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযোগগুলোতে ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, অনুদান বিতরণের স্বচ্ছতা এবং যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১২০ কোটি টাকার ফান্ড নিয়ে চালু হওয়া এই ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে শুরু থেকেই। বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার মত অর্থও নেই তহবিলে। এমনকি ব্যাংক ঋণ চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে জুলাই ফাউন্ডেশন।
