খোলা বাজার থেকে ডলার কিনে ‘রিজার্ভ বৃদ্ধির’ কৃত্রিম কারিশমা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
খোলা বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার কিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির কৃত্রিম সাফল্য দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, এটি প্রকৃত অর্থে রিজার্ভ বৃদ্ধি নয়—বরং একটি কেতাবি প্রদর্শনী, যা অর্থনীতির ভেতরের দুর্বল বাস্তবতাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা মাত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ২.১৩ বিলিয়ন ডলার কিনেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উদ্বৃত্ত ডলার কেনা হয়েছে, যা রিজার্ভে যোগ হয়ে কাগজে–কলমে রিজার্ভকে “উর্ধ্বমুখী” দেখাচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই রিজার্ভ বৃদ্ধি মূলত “নিজের এক ঘর থেকেই টাকা সরিয়ে অন্য ঘরে রাখার মতো”—নতুন আয় বা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে নয়। ডলার কেনার ফলে ব্যাংকিং খাতে টাকার সরবরাহ সংকুচিত হচ্ছে, যা মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ ফেলতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক একজন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ আসলে বাজারের প্রকৃত চিত্র বিকৃত করছে। কাগজে রিজার্ভ বাড়ছে, কিন্তু তা অর্থনীতির মৌলভিত্তি মজবুত হওয়ার ইঙ্গিত নয়। বরং এটি অস্থায়ী স্থিতি সৃষ্টি করছে।” গত তিন বছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বর্তমানে উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—বাজারে অতিরিক্ত ডলার থাকলেও সেই ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক শোষণ করছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এটি একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য রাজনৈতিকভাবে অর্থনৈতিক স্থিতি প্রদর্শন করা। সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় সম্পূরক অর্থপাচারের গতি কমেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ইতিবাচকতার পেছনে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের অতিরিক্ত ডলার তুলে নিয়ে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার কৃত্রিম চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান অবশ্য দাবি করেছেন, “অর্থপাচার হ্রাস পাওয়ায় বাজারে ডলারের যোগান বেড়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ডলারের দামের স্থিতি ধরে রাখতে সহায়তা করছে।” চলতি বছরের ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে এবং আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি (বিপিএম–৬) অনুযায়ী ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও সমালোচকেরা বলছেন, এই সংখ্যাগুলো ‘আয় নয়, হিসাবের খেলা।’ অর্থনীতিবিদদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নীতি রিজার্ভের সংখ্যাকে বড় দেখাতে সফল হলেও বাস্তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। বরং বাজার থেকে ডলার শোষণ করার ফলে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট এবং বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও নীতিনির্ধারণে দূরদর্শিতার অভাবই এই ‘প্রদর্শনমূলক রিজার্ভ বৃদ্ধি’ নীতির জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে—তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি প্রকৃত রিজার্ভ বৃদ্ধি নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক নীতির কৃত্রিম সাফল্য প্রদর্শনের প্রচেষ্টা।
