ক্যাপিটাল হিল থেকে শেখ হাসিনার ফোনালাপ: বিবিসির ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন
১১ নভেম্বর ২০২৫ঃ যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতার অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারির ভাষণের বিভ্রান্তিকর সম্পাদনার ঘটনায় বিবিসির ডিরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি এবং নিউজ বিভাগের প্রধান ডেবোরা টার্নেস পদত্যাগ করেছেন। এই ঘটনা যুক্তরাজ্যে যেমন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে বিবিসির নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। বাংলাদেশেও বিবিসি বাংলা বিভাগকে ঘিরে একই ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি কথোপকথন প্রকাশের ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিবিসি বাংলার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছে। দলের দাবি, প্রকাশিত ওই অডিওতে সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিবিসি দাবি করেছে, শেখ হাসিনা ও জয়ের কথোপকথনটি তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌশুলী তাজুল ইসলাম আদালতে বলেছেন, ওই রেকর্ডিং তাদের সংস্থার নথিভুক্ত তথ্য, যা বিবিসি নিজেদের বলে প্রচার করেছে। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, এই ঘটনায় মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক পিআর টিমের প্রভাব স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের মিডিয়া উইং জানিয়েছে, বিবিসি বাংলার বিতর্কিত প্রচার শুরু হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। তারা অভিযোগ করেছে, ঐ সময় বিবিসি “সরকারি হেলিকপ্টার থেকে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ব্যবহৃত ভিডিওটি ছিল ২০১৩ সালের হেফাজত সমাবেশের ফুটেজ। ভিডিওতে কোনো সামরিক হেলিকপ্টারের উপস্থিতি বা গুলি চালনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর প্রতিবেদনটি বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে কোনো ব্যাখ্যা বা সংশোধন প্রকাশ করা হয়নি। একই সময়ে বিবিসি বাংলায় শেখ হাসিনার নির্দেশে ‘গণহত্যা’ ঘটেছে বলে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, তাতেও তথ্যগত ত্রুটি ছিল বলে আওয়ামী লীগ দাবি করছে। সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ছিল ৭৪৯ জন, যার মধ্যে পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক ছিলেন। কিন্তু বিবিসি প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃতের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। দলের অভিযোগ, ওই তথ্য যাচাই না করে এনসিপি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বরাতেই প্রচার করা হয়। সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে আরেক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছিল, তিনি ‘পলাতক আসামি’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগের দাবি, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য, কারণ জয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। দলের আরও অভিযোগ, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন—এমন ভাষা ব্যবহার করে বিবিসি তার সফরকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেছে। তাদের বক্তব্য, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপ্রধানের প্রটোকল অনুযায়ী সরকারি হেলিকপ্টারে ভারতে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবেদনে ‘পালানো’ শব্দটি ব্যবহার করে তাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই ঘটনাগুলোর পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউনুসের আন্তর্জাতিক পিআর টিম ও বিবিসি বাংলার সাংবাদিকদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এক্স (টুইটার)-এ প্রকাশিত কিছু লিকড ইমেইলে দেখা যায়, লন্ডনভিত্তিক একটি পিআর ফার্মের সঙ্গে বিবিসি বাংলার সিনিয়র সাংবাদিকদের যোগাযোগ ছিল, যেখানে তাদের “হাসিনা-বিরোধী ন্যারেটিভ ধরে রাখার” পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া ২০২৪ সালের নভেম্বরে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক আকবর হোসেনকে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার পদে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাকেও দলটি এই সম্পর্কের উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আমিনুল হক মনে করেন, লন্ডনে ট্রাম্পের ভাষণ সম্পাদনার ঘটনাটি যেভাবে ডিরেক্টর জেনারেলের পদত্যাগ ও পার্লামেন্টারি তদন্তের পথ খুলে দিয়েছে, বাংলাদেশে বিবিসির ভুল প্রচারের ক্ষেত্রে সেই ধরনের কোনো জবাবদিহিতা দেখা যায়নি। তার মতে, “লন্ডনে উৎস ছিল অজ্ঞাত একটি মেমো ও রাজনৈতিক বিরোধিতা, কিন্তু ঢাকায় এর উৎস ছিল ইউনুসের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ও এনসিপি-সংলগ্ন সূত্র।” আওয়ামী লীগ বলছে, যুক্তরাজ্যে বিবিসি নিজ ভুল স্বীকার করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে ঘিরে ভুল প্রতিবেদন প্রচার করেও কোনো সংশোধন বা ক্ষমা চাওয়া হয়নি। দলটির পক্ষ থেকে বিবিসির কাছে দাবি জানানো হয়েছে—ভুল তথ্য স্বীকার, প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা, স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন এবং ইউনুসের পিআর টিমের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তারিত প্রকাশ।
