*জনগণের প্রত্যাশা থেকে বিচ্ছিন্ন জুলাই সনদ, প্রতিশ্রুতির স্থলে প্রতারণা*

১১ নভেম্বর, ২০২৫ | ৭:১০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

১৭ অক্টোবর ২০২৫—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক তথাকথিত “ঐতিহাসিক দিন”। সেদিন ২৫টি রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরে ঘোষিত হয়েছিল “July National Charter 2025”, যাকে প্রবর্তকেরা জাতির মুক্তির রূপরেখা বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু বাস্তবে, এই তথাকথিত ঐকমত্যের দলিল জনগণের প্রত্যাশা পূরণ তো দূরের কথা, বরং এটি বিপ্লব–পরবর্তী রাজনৈতিক জাগরণের আত্মাকে অপমান করেছে। প্রথমেই বলা প্রয়োজন, এই সনদটি কোনো জাতীয় ঐকমত্যের দলিল নয়, বরং একদল সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শক্তির অস্থির আপসের ফসল। জনগণের রক্তে লেখা জুলাই বিপ্লবের চেতনা যেখানে ছিল “জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া”, সেখানে এই সনদ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার এক ষড়যন্ত্র। *১. সংবিধানের প্রশ্নে ভ্রান্ত দিকনির্দেশনা* বিপ্লব-পরবর্তী মানুষ চেয়েছিল একটি অপরিবর্তনীয়, জনগণনির্ভর সংবিধান, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছানুযায়ী ধারাবদল রোধ করা যাবে। কিন্তু জুলাই সনদ সেই প্রত্যাশাকে উপহাস করেছে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সীমিত করার কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো সনদে নেই। বরং “সংবিধান সংস্কার কমিশন” নামের অস্পষ্ট একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকেই পুনরায় এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যে দানবকে মানুষ বিপ্লবে উৎখাত করেছিল—রাজনৈতিক দখলদারিত্ব—তাকে আবারই বৈধতা দেওয়া হয়েছে নতুন পোশাকে। *২. সভ্য রাজনীতির প্রতিশ্রুতিতে ছলনা* মানুষ চেয়েছিল রাজনীতি থেকে সহিংসতা, প্রতিহিংসা, এবং অপশব্দের সংস্কৃতি নির্মূল হোক। অথচ সনদের ভাষা ও প্রস্তাব উল্টো দিকেই নির্দেশ করছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও নির্বাচন–বর্জনের মতো প্রবণতাকে “রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা” বলে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি সভ্য রাজনীতির প্রতিশ্রুতি নয়, বরং সহিংসতার জন্য এক প্রাতিষ্ঠানিক ছত্রছায়া। সনদে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি—যাতে নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন, ভোটের ডিজিটাল মনিটরিং, কিংবা প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ফলত, জনগণের প্রত্যাশিত “শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র” আবারও কাগজে বন্দি রয়ে গেছে। *৩. ইতিহাসের বিকৃতি রোধে ব্যর্থতা* বাংলাদেশে ইতিহাস পরিবর্তনের অভ্যাস আজ রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ চেয়েছিল ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে না দেখতে। কিন্তু জুলাই সনদ এই সংকটকে উপেক্ষা করেছে। এখানে নেই কোনো “জাতীয় ইতিহাস কমিশন”—যা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে ইতিহাসের নথি যাচাই করবে। অতএব, আগামী প্রজন্ম আরও একবার বিভ্রান্তির ইতিহাসই উত্তরাধিকার হিসেবে পাবে। *৪. জাতীয় পরিচয়ের সংকট আরও গভীর* জুলাই সনদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এখানেই—এটি জাতীয় পরিচয়ের দ্বৈততা দূর করার বদলে আরও ঘনীভূত করেছে। “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” ও “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”—এই দুই ধারার মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ার যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি সনদে একেবারেই অনুপস্থিত। বরং “নাগরিক জাতীয়তাবাদ” নামে এক বিমূর্ত ধারণা যোগ করা হয়েছে, যার কোনো সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। এভাবে রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় প্রশ্নে সনদ কেবল বিভ্রান্তিই বাড়িয়েছে। *৫. ঐক্যের প্রতিশ্রুতিতে ভাঙনের রাজনীতি* বিপ্লবের পর জাতি চেয়েছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিভাজনমুক্ত রাষ্ট্রচিন্তা। কিন্তু সনদ সেই পুরোনো রাজনৈতিক ঘরানাকেই পুনরুজ্জীবিত করেছে। বিরোধী দলের মতামত উপেক্ষা করে ডিসেন্ট নোট মুছে ফেলা শুধু রাজনৈতিক অসততা নয়, এটি নতুন এক অগণতান্ত্রিক ঐক্যের মডেল—যেখানে ভিন্নমত দমনই ঐক্যের সংজ্ঞা। “ঐক্য” নামের এই প্রহসনই প্রমাণ করে, সনদের ভিতরে আসলে “বিপ্লবোত্তর প্রতিহিংসা”ই জীবিত আছে। *৬. সংখ্যালঘু ও পার্বত্য ইস্যু: প্রতিশ্রুতির নিঃস্বতা* হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর decades-ব্যাপী অন্যায়ের প্রশ্নে সনদ নীরব। নেই কোনো “Minority Rights Commission”, নেই কোনো বাস্তবায়নযোগ্য নিরাপত্তা কাঠামো। একইভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কেও সনদ কেবল নীতিগত বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু কোনো “roadmap” দেয়নি। ফলে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র পুনর্গঠনের যে আশা ছিল, সেটি আগেই নিঃশেষ। *৭. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারে নীরবতা* অর্থনৈতিক বৈষম্য আজ বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকট। কিন্তু সনদে নেই কোনো স্পষ্ট পুনর্বণ্টন নীতি, নেই কর কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব। শুধু “অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি” ও “সমান সুযোগ”—এই দুটি অস্পষ্ট বাক্যে ৫৮.৫% সম্পদের মালিক শ্রেণিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেই বৈষম্য সমাধানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। *৮. বিচারব্যবস্থা: পুরোনো মুখ, নতুন মুখোশ* বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহার বাংলাদেশের অন্যতম গভীর ব্যাধি। কিন্তু সনদের প্রস্তাবিত “ন্যায়বিচার সংস্কার বোর্ড” রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। কমিশনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রতিনিধি রাখার অর্থই হচ্ছে বিচারব্যবস্থাকে পুনরায় রাজনীতির করায়ত্তে দেওয়া। এটি জনগণের ন্যায়বিচারের স্বপ্নের সাথে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। *৯. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনে ব্যর্থতা* বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী—এই প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু সনদ এখানে আশ্চর্যভাবে নীরব। “ধীরে ধীরে কাঠামোগত সংস্কার” নামে যে ধোঁয়াশা রাখা হয়েছে, তা বাস্তবে কোনো সংস্কারের অঙ্গীকার নয়। ফলে, রাষ্ট্রযন্ত্র আগের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোর যন্ত্র হিসেবেই কাজ করবে। *১০. পররাষ্ট্রনীতি: স্বাধীনতার ভান* জুলাই বিপ্লবের অন্যতম স্লোগান ছিল “কৌশলগত স্বাধীনতা”। কিন্তু সনদে সেই চেতনার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই। ভারত–নির্ভর নীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো ইঙ্গিত নেই; বরং “আঞ্চলিক সৌহার্দ্য” নামের সুন্দর শব্দে পুরোনো অধীনতা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পররাষ্ট্র নির্ভরতার এক নতুন সংস্করণ মাত্র। *১১. সাংস্কৃতিক ঐক্যের বদলে বিভাজন* বাংলাদেশের তিন ধারার সংস্কৃতি—পাশ্চাত্যভিত্তিক, বাংলা-মধ্যবিত্ত, এবং মাদ্রাসা-মুখী সমাজ—একীভূত হওয়ার বদলে আজ আরও বিচ্ছিন্ন। সনদে “সাংস্কৃতিক ঐক্য” বিষয়ে যে অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছে তা কেবল উৎসব, ফোরাম ও সেমিনারে সীমিত। অর্থাৎ, মূল শিক্ষানীতি ও সামাজিক কাঠামোতে ঐক্যের কোনো স্থায়ী প্রস্তাব নেই। জুলাই সনদ একদিকে বিপ্লব-পরবর্তী জনগণের স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলায় নতুন অনিশ্চয়তা যোগ করেছে। এটি জনগণের নয়, বরং রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের যৌথ আত্মরক্ষার দলিল। যেখানে জনগণের প্রত্যাশা উপেক্ষিত, ভিন্নমত বর্জিত, এবং বিপ্লবের চেতনা নির্বাসিত। জুলাই বিপ্লব জনগণকে এক নতুন সূর্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—কিন্তু জুলাই সনদ সেই সূর্যকে মেঘে ঢেকে দিয়েছে। যতদিন এই সনদে জনগণের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত না হবে, ততদিন এটি থাকবে একটি ব্যর্থতার দলিল, ইতিহাসে যার স্থান হবে “মিসড রেভল্যুশনের ম্যানিফেস্টো” হিসেবে।