জামায়াতের ক্ষমা প্রার্থনা: তিন আমির, তিন ভাষা

১০ নভেম্বর, ২০২৫ | ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের ক্ষমা প্রার্থনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে পুরোনো প্রশ্নে: জামায়াত কি সত্যিই ক্ষমা চেয়েছে? আর যদি চেয়েও থাকে, তা কি দলগতভাবে স্বীকৃত এবং জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো পর্যায়ে পৌঁছেছে? বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে জামায়াত আমির বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আজ পর্যন্ত জামায়াতের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন আমরা বিনা শর্তে তাদের কাছে ক্ষমা চাই।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই এপোলজি আমরা মিনিমাম তিনবার দিয়েছি; গোলাম আজম দিয়েছেন, মতিউর রহমান দিয়েছেন এবং আমি দিয়েছি।’ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি: কার লাভ, কার ক্ষতিনির্বাচনে পিআর পদ্ধতি: কার লাভ, কার ক্ষতি ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে বরাবরই ভাষার ভিন্ন ব্যবহার ও অবস্থানের অস্পষ্টতা ছিল। অধ্যাপক গোলাম আযমের ‘ভুলের স্বীকারোক্তি’ ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বৈধ ঘোষণা করার পর তিনি বলেন, ‘অতীতে হয়তো আমি কিছু ভুল করেছিলাম, তার জন্য আমি দুঃখিত।’ এই বক্তব্যটিকে অনেকেই ব্যক্তিগত অনুশোচনা হিসেবে দেখেছেন, কিন্তু দলীয় আনুষ্ঠানিক ক্ষমা নয়। তৎকালীন সংবাদ বিশ্লেষণগুলোতেও গোলাম আযমের বক্তব্যকে ‘conditional apology’ বা ‘moral regret’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ তিনি নির্দিষ্ট কোনো অপরাধ নয়, বরং ‘ভুল সিদ্ধান্তের’ দায় স্বীকার করেছিলেন। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ‘অপরাধ অস্বীকার’ ‘আমি তাদেরকে বলেছি, আমি কোনো অন্যায় করিনি, ক্ষমা চাওয়ার অর্থই হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া, সুতরাং ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর এই বক্তব্যটি ফেসবুক পোস্ট করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। মতিউর রহমান নিজামী এ বক্তব্যে পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা করলেও ‘অপরাধ স্বীকার’ করেননি। একান্ত সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান নিজামী তাঁর বাসায় আমাকে বলেছিলেন, ‘৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে যাক জামায়াত তা চায়নি। ভারতের হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের বিভক্তি আমরা চাইনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর বুঝতে পেরেছি, আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ভুল ছিল। রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের জন্য যদি বিচার বা শাস্তি হয়, তাতে আপত্তি নেই। তবে, হত্যা বা ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ করেনি।’ এছাড়াও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘আমার মাঝে কোনো দুর্বলতা নেই। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছি প্রাণের মালিক আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ তাঁকে উদ্ধৃত করে তার পরিবারের দেওয়া এ বক্তব্য জামায়াতের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়। অর্থাৎ মতিউর রহমান নিজামীর দৃষ্টিতে ‘রাজনৈতিক ভুল’ হলেও ‘যুদ্ধাপরাধের মতো’ কোনো ঘটনা তারা ঘটাননি বলে তা স্বীকারযোগ্য নয়। এই অবস্থান দলটির মূল রাজনৈতিক যুক্তিকেই বহন করে। আর তা হলো ৭১-এ তাদের অবস্থান ছিল ‘রাজনৈতিক’, ‘অপরাধমূলক’ নয়। জুলাই সনদ স্বাক্ষরে এনসিপি-বামদের অনুপস্থিতির হুঁশিয়ারি: ঐক্যের ফাটল নাকি আইনি সতর্কতা?জুলাই সনদ স্বাক্ষরে এনসিপি-বামদের অনুপস্থিতির হুঁশিয়ারি: ঐক্যের ফাটল নাকি আইনি সতর্কতা? বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, জামায়াতের সাবেক দুই আমিরই তাঁদের বক্তব্যে স্বীকার করেছেন—ভুল হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কেউ সরাসরি ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ করেননি। তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান রাজনৈতিক বা কৌশলগত ভুল ছিল, যা অপরাধ নয়। ডা. শফিকুর রহমানের ভিন্ন ভাষা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে প্রথমবারের মতো ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৫’ পর্যন্ত সময়সীমা টেনে নিয়ে একটি দীর্ঘকালীন নৈতিক দায় স্বীকার দেখা যায়। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের ১০০টা সিদ্ধান্তের মধ্যে ৯৯টা সঠিক, একটা বেঠিক হতে পারে। এখন আমরা বিনা শর্তে মাফ চাইলাম, তারপরে আর বাকি থাকল কোনটা?’ এই অংশে একদিকে নৈতিক অনুশোচনা, অন্যদিকে দলীয় আত্মবিশ্বাস দুটোই একসঙ্গে উপস্থিত। ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য সেই জায়গায় এসে ভিন্ন অর্থ বহন করছে, যেখানে তিনি শুধু ‘ভুল’ নয়, ‘কষ্ট’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জামায়াতের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে বা ক্ষতি হয়ে থাকলে আমি ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই।’ যা নৈতিক দায়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক দায়কেও স্বীকার করার ইঙ্গিত দেয়। জামায়াতের দলীয় ইতিহাসে ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যটি হয়তো সবচেয়ে স্পষ্ট ‘বিনা শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা’, তবুও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। যা তিনি তাঁর বক্তব্যেও তুলে ধরেছেন। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখন মাফ চাওয়ার পর বলে, এই ল্যাঙ্গুয়েজে (ভাষা) চাইলে হবে না, ওই ল্যাঙ্গুয়েজে চাইতে হবে। আরেহ বাবা... এ আরেক যন্ত্রণা। বিনাশর্তে মাফ চাইলাম, কোনো শর্তও দিলাম না। তারপরে আর বাকি থাকলো কোনটা, এইটা তো বুঝি না। আজকে আবার একদম প্রকাশ্যে বলে দিলাম— ৪৭ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, যারা কষ্ট পেয়েছেন তাদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই। কোনো অসুবিধা নেই।’ ‘ক্ষমা’ নিয়ে দলে বিভাজন জামায়াতের ভেতরে ‘আনুষ্ঠানিক ক্ষমা’ নিয়ে আলোচনাও নতুন নয়। ২০১৭ সালে দলীয় একটি প্যানেল গঠিত হয়েছিল এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি তৈরির জন্য, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা স্থগিত বা বাতিল হয়। অর্থাৎ দলগতভাবে গৃহীত কোনো ক্ষমা বিবৃতি আজও প্রকাশিত হয়নি। জামায়াতের তিন আমির– গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও ডা. শফিকুর রহমান প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে ‘ভুল’, ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ বা ‘কষ্ট দেওয়ার দায়’ স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভাষার সূক্ষ্ম পার্থক্যে তারা তিনটি ভিন্ন পরিসরে দাঁড়ান: গোলাম আযম – ‘ভুল হয়েছিল, তার জন্য দুঃখিত।’ নিজামী – ‘রাজনৈতিক ভুল হতে পারে, অপরাধ নয়।’ শফিকুর রহমান – ‘বিনা শর্তে ক্ষমা চাই।’ অর্থাৎ সাবেক দুই আমির ভুল স্বীকার করেছেন, কিন্তু অন্যায় মানেননি। বর্তমান আমির প্রথমবারের মতো অন্যায়ের মতো কিছু স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। অর্থাৎ জামায়াতের ক্ষমা এখনো ব্যক্তিগত বিবৃতি ও রাজনৈতিক অবস্থানের মাঝামাঝি এক ধূসর এলাকায় আটকে আছে। জাতি হয়তো সেই ধূসরতারই ব্যাখ্যা খুঁজে ফিরছে আজও।