বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক চীনের দিকে ঝোঁকার কারণে উদ্বেগ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের
দক্ষিণ এশিয়াসহ বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মতে, বাংলাদেশ এখন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে ক্রমেই বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকছে—যা ওয়াশিংটনের কাছে সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে ঢাকায় নিযুক্ত হতে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, চীনের সামরিক সম্পৃক্ততা বাংলাদেশসহ গোটা অঞ্চলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের জন্য উদ্বেগজনক। চীনের সমরাস্ত্র বিক্রির প্রভাব রোধে যুক্তরাষ্ট্র ‘থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্ট২০২৫’ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়নের পথে। এই আইনের আওতায় কোনো দেশ যদি চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনে বা ব্যবহার করে, তবে সেটির ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। আইনটি গত ২৩ জুলাই কংগ্রেসে উপস্থাপন করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর মূল লক্ষ্য—চীনের প্রতিরক্ষা রপ্তানি কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার রোধ করা। ওয়াশিংটনের মতে, চীন অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক লাভ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রভাব, সামরিক সক্ষমতা যাচাই, রাজনৈতিক যোগাযোগ বিস্তার ও বৈশ্বিক অবস্থান শক্তিশালীকরণ—এসব কৌশলগত উদ্দেশ্যও বাস্তবায়ন করছে। গত ২৪ অক্টোবর সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে শুনানিতে অংশ নেন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন। রিপাবলিকান সিনেটর পিট রিকেটস বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে বাড়তে থাকা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন কমিউনিস্ট চীনের সামরিক সহযোগিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। চীন সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাবমেরিন ঘাঁটি সংস্কার করেছে, যা যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন রাখার উপযোগী। এছাড়া, অন্তর্র্বতী সরকার সর্বোচ্চ ২০টি চীনা জে১০ যুদ্ধবিমান, সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল ও রাডার ক্রয়ের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।’ জবাবে ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘আমার দায়িত্ব শুরু হলে আমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করব। চীনের প্রভাব ও ঝুঁকির দিকগুলো তুলে ধরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও স্বচ্ছ, পারস্পরিক লাভজনক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করব।’ সিনেটে প্রশ্নের জবাবে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন আরও বলেন, ‘আমরা এমন দেশগুলোর জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্মুক্ত করতে পারি, যাদের পক্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা সম্ভব নয়। যৌথ মহড়ার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে।’ তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র শুধু নতুন অস্ত্র নয়, চীনের তৈরি পুরোনো অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রিও ঠেকাতে উদ্যোগ নিচ্ছে। পাশাপাশি চীনা অস্ত্রের ব্যবহারকারী দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বেইজিং বাংলাদেশের স্বাধীন ও আত্মনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করে। গত শনিবার ঢাকায় অ্যাসোসিয়েশন অব ফরমার অ্যাম্বাসাডরস (এওএফএ)-এর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময়ই নিজস্ব নীতি অনুসরণ করেছে, কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশনায় নয়। চীন এ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।’ পর্যবেক্ষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মূলে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দ্রুত বিস্তার। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি ও অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন এই অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে বলে মনে করছে তারা। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও কোয়াড জোটের মাধ্যমে বেইজিংয়ের প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করতেও দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দুই পরাশক্তির মধ্যকার এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। তবে ইউনূস সরকার আমেরিকার প্রতি দুর্বলতা আছে বলে বারবার তিনি প্রমাণ দিচ্ছেন।
