‘কঠিন কাজ’-এর দাবি প্রশ্নবিদ্ধ: শেখ আহমাদুল্লাহর সফলতা কি ধর্মীয় ব্যবসার নতুন কৌশল?

২ নভেম্বর, ২০২৫ | ১১:৫৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বিশিষ্ট ধর্মীয় বক্তা ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমাদুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, বিগত ১৬ বছর এই দেশে ইসলামের কথা বলার মতো কঠিন কাজ দ্বিতীয়টি ছিলো না। তাঁর এই মন্তব্য বিভিন্ন মহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের নিজস্ব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যে সময়কালকে তিনি 'কঠিনতম' বলে উল্লেখ করেছেন, সেই সময়কালেই তাঁর উত্থান এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক ও সাংগঠনিক প্রসার ঘটেছে। তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর শেখ আহমাদুল্লাহ সৌদি আরবে অবস্থান করেছেন। তিনি মূলত আরবি ভাষায় বিশেষ দক্ষতার কারণে পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক দাওয়াহ সেন্টারে প্রীচার ও ট্রান্সলেটর হিসেবে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার ১৫ বছর ৭ মাসের (সঠিক তথ্য অনুযায়ী) প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সময় তিনি দেশেই ছিলেন না। দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তাঁর সার্বিক কার্যক্রমে সরকারের আনুকূল্য এবং নির্বিঘ্ন অগ্রগতির চিত্র স্পষ্ট। ধর্মীয় মোড়কে নিবন্ধন: সরকারের আনুকূল্য আহমাদুল্লাহ ২০১৮ সালে দেশে ফিরে এসে ‘আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। এটি একটি স্পষ্টতই ধর্মভিত্তিক দাতব্য সংস্থা, যার নীতিবাক্য ‘উম্মাহর স্বার্থে, সুন্নাহর সাথে’। এই ধর্মীয় মোড়ক থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার সংস্থাটিকে নিবন্ধন দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি। ২০১৯ সালে ফাউন্ডেশনটি নিবন্ধন লাভ করে (নিবন্ধন নং এস-১৩১১১/২০১৯)। সংস্থাটির নিবন্ধন লাভ এবং নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন প্রমাণ করে, সরকার ধর্মভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটিকে কোনো প্রকার বাঁধা দেয়নি। বাণিজ্যিক সফলতা: ৪ লাখ বইয়ের বিক্রি যদি বিগত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে ইসলামের কথা বলা কঠিন হতো, তবে শায়খ আহমাদুল্লাহর লেখা বইয়ের বাণিজ্যিক সাফল্য কীভাবে সম্ভব হলো? আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে তাঁর লেখা দুটি বই—‘রাসুলুল্লাহ-এর সকাল সন্ধ্যার দু’আ ও যিকর’ ও ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পরবর্তী দু'আ ও যিকর’—চার লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। এছাড়া তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত ‘রমাদান প্ল্যানার’ দুই লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। এই বইগুলো শুধুমাত্র আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকেই বিতরণ করা হয়নি, একুশে বইমেলাসহ দেশের বৃহৎ প্রকাশনা প্ল্যাটফর্মগুলোতেও এসব বই নিয়মিত পাওয়া যেত। ইসলামের কথা বলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলে তাঁর পক্ষে এত বড় সংখ্যক বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে নির্বিঘ্ন উপস্থিতি ২০১৮ সালে দেশে ফেরার পর থেকে আহমাদুল্লাহ দেশের প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ধর্মীয় আলোচনায় নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে তিনি নির্বিঘ্নে লেকচার দিয়েছেন। তাঁর নিজের ওয়েবসাইটেও এমন কোনো তথ্য নেই যা প্রমাণ করে যে তিনি ওয়াজ মাহফিলে বা মিডিয়াতে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর উপস্থিতি ছিল অনায়াস। আওয়ামী লীগ সরকারের আনুকূল্যে তিনি জাপান, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, সুইডেনসহ ২৫টিরও বেশি দেশে আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমিগ্রেশন বা অন্য কোনো সরকারি সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কোনো তথ্য তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম: ধর্ম থেকে ব্যবসা আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা শুধু ধর্মীয় প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফাউন্ডেশনটি রীতিমতো বাণিজ্যিক কার্যক্রমের আদলে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করেছে এবং তা ফেসবুকে বুস্ট করেও প্রচার করেছে। ফাউন্ডেশন পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কোর্সগুলোর মধ্যে রয়েছে: স্মল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স দি আর্ট অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং কোর্স স্মার্ট টেইলারিং অ্যান্ড ফ্যাশন ডিজাইন কোর্স জুতা শিল্পে উদ্যোক্তা তৈরি কোর্স ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শেফ অ্যান্ড কিচেন ম্যানেজমেন্ট কোর্স ঢাকার আফতাবনগরে নিজস্ব কার্যালয়ে বসে এসব কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনটি কোনোদিন কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে বলে জানা যায়নি। দাতব্য কার্যক্রমের পাশাপাশি ‘দাওয়াহ ডিপ্লোমা’ ও ‘ফ্যামিলি কাউন্সেলিংয়ের’ মতো কার্যক্রমও তারা চালিয়েছেন, যা আওয়ামী লীগ সরকারের নাকের ডগায় অত্যন্ত সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে। উপসংহার: মিথ্যাচারের প্রশ্ন শায়খ আহমাদুল্লাহর আজকের যে নাম, যশ ও তারকাখ্যাতি, তা সবই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। সরকারের আনুকূল্যে তিনি একদিকে যেমন তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাঁর ফাউন্ডেশন। নিজ ফাউন্ডেশনের ডোনেশন বাড়াতে তিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডেও জড়িয়েছেন (যেমন বিদ্যানন্দের পেছনে লাগা), কিন্তু কোথাও তাঁকে আটকানো হয়নি। অথচ, নিজের অভূতপূর্ব সফলতা ও নির্বিঘ্ন কার্যক্রমের এই সময়কালকে তিনি এখন 'কঠিনতম' বলে দাবি করছেন। পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন: যে সময়ে একজন বক্তার লক্ষ লক্ষ বই বিক্রি হয়, শত শত আন্তর্জাতিক সফর হয়, এবং একটি ধর্মীয়-বাণিজ্যিক ফাউন্ডেশন বিনা বাধায় একাধিক ব্যবসা ও প্রশিক্ষণ কোর্স চালায়, সেই সময়কে 'কঠিন' আখ্যা দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? অনেকের মতে, ধর্মীয় ব্যবসার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হলো ধর্মীয় ভাবাবেগকে পুঁজি করে মিথ্যাচার করা, যার মাধ্যমে অনুদান বা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। শায়খ আহমাদুল্লাহর এই দাবি তাঁর নিজস্ব অর্জিত সফলতার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।