আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে শেখ হাসিনাঃ তিনিই জাতির কান্ডারী- সৈয়দ বোরহান কবীর
 
					 গতবছরের আগস্টে তথাকথিত মনসুন বিপ্লবের পর ভয়াবহ আতঙ্কের দিনগুলোতে অনুজের সঙ্গে কফি পান করছিলাম, ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে। অনুজ একজন মেধাবী ব্যাংক কর্মকর্তা।দেশ-বিদেশের খবর তার ঠোঁটে লেগে থাকে।কফিতে চুমুক দিতে দিতে মেধাবী অনুজ আমাকে বলছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার অধ্যায় শেষ। তিনি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন না। আওয়ামীলীগও রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। আমি ৫ আগস্টে বিভীষিকাময় রাত কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রাজনীতি নিয়ে কোন কথা বলবো না। কিন্তু মনের অজান্তে আমি বলতে শুরু করলাম, রাজনীতিতে এতো সহজে উপসংহারে পৌঁছানো যায় না। শেখ হাসিনা এতো সহজে নিঃশেষিত হবার মানুষ নন। আমি তাকে এটাও বলেছি, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। আমরা আর কথা বাড়াইনি।কফি পান শেষে নীরবেই যে যার পথে চলে যাই।এরপর আমাদের মধ্যে বহুবার দেখা হয়েছে।আড্ডা হয়েছে, সাহিত্য নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। ঠিক ১৫ বছর পর ২৯ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় অনুজের সঙ্গে আমার আবার রাজনীতি নিয়ে কথা হলো। সন্ধ্যায় ফোন করলো একরাশ আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে।শুরুই করলো এই বলে যে,ভাই আপনিই ঠিক বলেছিলেন। আমি প্রথম বুঝতে পারিনি কোন প্রসংগে সে কথা বলছে। নিজেই কফিশপের স্মৃতি সামনে নিয়ে এলো। বললো, আপনিই সঠিক ছিলেন। আমি খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললাম,এতদিন পর হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন? সে বললো, আপনি কি The Independent,Reuters সহ আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার পড়েননি? আমি জানালাম বাংলাদেশের গণমাধ্যমে দেখলাম। অনুজ আমাকে দুটো লিংক পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো পড়েন। আমাদের মিডিয়া তথ্য বিকৃত করে শেখ হাসিনার খন্ডিত বক্তব্য প্রকাশ করেছে। তিনি বললেন, শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। ফোন রেখে সাক্ষাৎকার দুটি সাক্ষাৎকার গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। ক্ষমতা হারানোর দেড়বছরের মাথায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া কেন এতো গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করলো? বিশ্ব মিডিয়ায় এরকম নির্বাসিত নেতাদের মিডিয়া কাভারেজ হয়েছে দুবার। প্রথমটি ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী।ফ্রান্সে বসে তিনি এএফপি ও রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেন।এই সাক্ষাৎকারের চারমাসের মাথায় ইরানে বিপ্লব সংঘটিত হয়। খোমেইনী নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে আসেন বীরের বেশে। অন্যটি হলেন বার্মার নেতা অং সান সুচি। ১৯৮৭ সালে লন্ডনে সুচির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল বার্তা সংস্থা এপি ও বিবিসি। ঐ সাক্ষাৎকারের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি দেশে ফেরেন এবং গনতন্ত্রের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এধরনের সাক্ষাৎকারে বক্তব্যের চেয়ে কারা এবং কোন প্রেক্ষাপটে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এই সাক্ষাৎকারে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রসঙ্গে কথা বলার আগে, বাংলাদেশের মিডিয়ার দৈন্যতা নিয়ে কিছু বলা দরকার। সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো,পুরো সত্যি বলা।অর্ধ সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমের বরাতে আমাদের মিডিয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য বিকৃতি করেছে। যেমন কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ক্ষমা চাইবে না শেখ হাসিনা। কেন এই কথা তিনি বলেছেন, তার ব্যাখা নেই এসব রিপোর্টে। এবার আসি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রসংগে। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ- প্রাণহানি এবং হত্যার দায়- শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ৫ আগস্টের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। এটা কাম্য নয়। যেকোন প্রাণহানি দুঃখজনক। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোন হত্যাকাণ্ডের দায় তার নয়। কাউকে হত্যার নির্দেশ তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেননি। শেখ হাসিনা বলেছেন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য যদি কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় তাহলে তা খারাপ নজির হবে। তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব প্রটোকল অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।তবে বিক্ষোভে সহিংসতার মাত্রা বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে হয়তো মাঠে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।কাজেই এসব প্রাণহানির ঘটনার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই অবান্তর। মৃত্যুর সংখ্যা বিতর্ক- শেখ হাসিনা ১৪শ জনের মৃত্যুর সংখ্যা সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন। এটাকে তিনি অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেন। তিনি একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের সঠিক তথ্য বের করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল কিন্তু অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে সেই তদন্ত বন্ধ করে দেয়। বিচারের নামে প্রহসন- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকে আওয়ামী লীগ সভাপতি পূর্বনির্ধারিত এবং সাজানো বলে উল্লেখ করেছেন।তিনি মনে করেন আগে থেকেই তার সাজা ঠিক করে রাখা হয়েছে।অসচ্ছ এই বিচার হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বলে তিনি মনে করেন। আগামী নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ- আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে শেখ হাসিনার তার সাক্ষাৎকারে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ এধরনের নির্বাচনে ভোট দেবে না। ঐ নির্বাচন দেশে একটি বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে এবং উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে তিনি দেশে ফিরে আসবেন এবং সরকারে বা বিরোধী দলে থেকে গনতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখবেন বলে তিনি জানান। এই সাক্ষাৎকারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল। এর একটি দার্শনিক ভিত্তি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সাক্ষাৎকারে একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আদর্শবান রাজনীতিবিদদের আবিষ্কার করা যায়। এই সাক্ষাৎকারে প্রমাণ করে দেড়বছরের সীমাহীন বর্বরতার পরও আওয়ামী লীগ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর বিএনপি জামায়াত সহ সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কাজ করছে তা হলো আওয়ামী লীগ খতম করা।কিন্তু প্রবল বানের পানিতে যেমন বাঁধের প্রতিরোধ তছনছ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ এখন সরকার ও প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক দলের জন্য আতঙ্কের বন্যা হয়ে আসছে। একমাত্র চিন্তা আওয়ামী লীগ আসলে তাদের কী হবে? গত দেড় বছরে এদেশের মানুষের কাছে সব ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়েছে।দেড় বছরের দুর্নীতি, লুটপাট আর মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ মানুষ বলতে শুরু করেছে-আগেই ভালো ছিলাম। অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে আওয়ামী লীগ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জনপ্রিয়। আর একারণেই আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের রুপকার শেখ হাসিনার দিকে।

